somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নপুংসক সময়ে বেঁচে আছি আমরা

০৩ রা মে, ২০১২ সকাল ১১:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
আমাদের স্পর্ধিত শ্লোগান খা-খা দুপুরকে বিদীর্ণ করে এগিয়ে যায়। টিয়ারশেলের ঝাঁঝালো গন্ধ, তীক্ষ্ণ হুইসেল, চোরাগোপ্তা ইটের আঘাতে আহতের চিৎকার আর রক্তের আখ্যান পেরিয়ে কানে আসে পেটোয়া জল্লাদদের ভারী বুটের শব্দ। পঞ্চাশজন বা তারও অধিক শিক্ষার্থীর মৃত্যুভয় উপেক্ষা করা মিছিলটি ঝঞ্ঝার গতিতে প্রদক্ষিণ করে ক্যাম্পাস। আমাদের চোখে স্বর্ণালী ভোরের দীপ্ত সূর্যের আভা। মনে অনাগত সুদিনের হাতছানি।

না, আমাদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য গ্রাম থেকে ছুটে আসেনি কোন সরল কিশোর। আসেনি অফিসগামী কলুরবলদ কিংবা বিবেকের ধ্বজাধারী সুশীল পায়রা। শিক্ষকরা দূরে থেকেছে মুলা ও মুগুরের তেলেসমাতিতে। আমাদের মিছিলে নেই কোন গার্মেন্টস কর্মী অথবা টাকার বিনিময়ে বিবেক বিকিয়ে দেয়া খুনে জল্লাদ। বিবেকের ডাকে সাড়া দেয়া সময়ের কিছু সাহসী সন্তান জুটেছি একসাথে। আমরা নেমেছি বোনের সম্ভ্রমহানি ও মৃত্যুর প্রতিবাদে।

কারো সাহায্য আমরা পাইনি। সাধারণ শিক্ষার্থীরা অমেরুদণ্ডী হয়ে অভিশাপ দিচ্ছে। সরকারের পদলেহী শিক্ষক ও ছাত্ররা মেরে ফেলতে চাইছে। পুলিশ পেটাচ্ছে যত্রতত্র। তবু বিপুল আক্রোশে দুহাত ঊর্ধ্বে তুলে জানিয়ে দিচ্ছি এ মাটিতে খুনি-ধর্ষকদের কোন ঠাঁই নেই। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, ক্ষুদ্র এ ঝড়ই বিরাট সুনামি হয়ে ভেঙ্গে ফেলবে তাসের সংসার।

সামনে নিরেট প্রাচীর তুলে দাঁড়িয়ে যায় এক প্লাটুন পুলিশ। শ্লথ হয়ে আসে মিছিলের গতি। ডানে বামে পেছনে জান্তব ক্ষুধায় হিসহিসে গর্জন তুলে ট্রিগারে আঙ্গুল চালানোর অপেক্ষায় নির্দয় খাকি। মুহুর্মুহু শ্লোগান এখনো বিদ্যমান। তেজোদীপ্ত বন্ধুদের কণ্ঠে জীবনের শেষ গর্জনের অভিলাষ। আমরা প্রস্তুত হাবিয়ার তাণ্ডব পাড়ি দেবার দৃঢ় প্রত্যয়ে।

হঠাৎ গুলির শব্দ। বাতাসে ডানা ঝাপটে উড়ে যায় কয়েকটি সাদা কবুতর। পাখিদের ভয়ার্ত হাহাকার বাজে কানে। ডানপাশের বন্ধুটি বুক চেপে ধীরে বসে পড়ছে। আমার হাত এগিয়ে ওকে ধরে ফেলে। কি ব্যাপার বসে পড়ছ কেন ? আমাদের যেতে হবে অনেক দূর। ঐ বনানীর নিবিড় সবুজ অরণ্যের ছায়া যে এত সহজে মেলেনা বন্ধু! হাসিমুখ বন্ধু আমার দিকে চোখ ফেরায়। মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করেছে। ‘একি ! তোর গুলি লেগেছে?’ আমার দৃষ্টি চারপাশে ঘোরে। আরো কয়েকজন লুটিয়ে পড়ল মুহূর্তেই। চতুর্দিকে দৌড়াচ্ছে ছাত্ররা। গুলির শব্দ তাড়া করছে ওদের। আমি অক্ষম আক্রোশে চিৎকার করে উঠি। দুঃশাসন তোকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে বুড়িগঙ্গার বিষাক্ত পানিতে ভাসিয়ে দেব।

দ্রুতগতির বুটের শব্দে কান খাড়া হয়। আমার কাঁধে একজন আহত সহযোদ্ধা। ঠিক যেমন একাত্তরের রণাঙ্গনে আমার জন্মদাতার কাঁধে ছিল কোন আহত দেশপ্রেমিক। সেখানে চকচকে খাকির বিরুদ্ধে ছিল এদেশের খেটে খাওয়া মানুষ। এখানে খাকির বিরুদ্ধে অন্যায় না মানা আপোষহীন কিছু ছাত্র। আমার শরীর ঘাম আর আহতের রক্তে ভেজা। বিড়বিড় মুখে বন্ধুটি বলে চলেছে ‘দোস্ত আমি মইরা গেলেও তোরা ওই হারামির বাচ্চাগুলার একটা বিহিত করিস।’ ‘ না দোস্ত, তোর কিচ্ছু হবেনা। একটু ধৈর্য ধর, আমি তোকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।’

প্রচণ্ড শক্তিতে আমার মেরুদণ্ডে কিছু একটা আঘাত করে। আমি ছয় সাত হাত সামনে ছিটকে পড়ি। কাঁধ থেকে ছিটকে পড়ে অর্ধমৃত বন্ধু। ‘সব মাদারচোদরে ধইরা গাড়িতে তোল। জনমের মত অগো মিছিলের খায়েস মিটাই দে।’ আমার চোখ ভারি হয়ে আসছে। এই প্রথম মনে হলো চোখ পোড়াচ্ছে। দম নিতে পারছিনা। বাতাসের অভাবে খাবি খাচ্ছে ডাঙায় তোলা একটি মাছ। আমার বন্ধ হয়ে আসা দৃষ্টির প্রান্তসীমায় নড়ে ওঠে একটি স্বর্গ-সাদা শোভাযাত্রা। খাটিয়ায় অসংখ্য লাশ।

২.
স্বপ্নের বেলাভূমির মতই আমার এ ক্যাম্পাস। জীবনে অনেক দিন অভুক্ত অর্ধভুক্ত থেকেছি। কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করিনি। প্রতিবাদের প্রলয় ডেকে দেশ ও সমাজের বিরুদ্ধে কিছু বলিনি কখনো। স্বাধীন স্বদেশ গড়ায় বাবার ভূমিকা কতটুকু ছিল সে নিয়ে কখনো আলাপ হয়নি আমাদের। কিন্তু যখন অপঘাতে দশদিন ভুগে মৃত্যু হল, মার কাছে শুনেছি, দেশকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিলেন বাবা। বিনা চিকিৎসায় একজন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলে কার কী এসে যায়! আমার বেঁচে থাকার সংগ্রাম এবার প্রত্যক্ষ হল। হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরও মায়ের স্বপ্ন পূরণে ব্রতী হয়েছিলাম। দারিদ্র্যকে জয় করে এখানে এসেছিলাম সুন্দর আগামীর স্বপ্নে বিভোর হয়ে।

নিবিড় সবুজে মোড়া গ্রামের মতই স্বপ্নময় এই ক্যাম্পাস। এখানকার পাখিগুলোও যেন আমার পরিচিত। পুকুরের পানিতে সাঁতার কেটে অনুভব করতাম সেই দুরন্ত শৈশব। বন্ধুরা মিলে দল বেঁধে আয়োজন করতাম নানা উৎসব। টিউশনি করে জীবন চললেও ওদের কারণে কখনো দুঃখ জাঁকিয়ে বসেনি আর। সবচেয়ে বড় কথা, নিশুতি আমার সকল কান্না-হাসির নিত্য সঙ্গী। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ভুলে যেতে পারি দগ্ধ হাতের যন্ত্রণা।

এই সুখের সংসারে হঠাৎই উদয় হয় কিছু কুৎসিত প্রাণী। কদর্য রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে ওরা জড়িয়ে নিলো আমার স্বপ্নের অঙ্গন। নিত্যদিনকার কলহ আমাদের পড়ালেখার স্বাভাবিক গতিকে প্রত্যহ প্রশ্নবিদ্ধ করতে লাগল। তবু আমরা চুপ করে ছিলাম। কোনভাবে পাড়ি দিতে চেয়েছিলাম ক্যাম্পাসের দিনগুলো। হঠাৎই কালবৈশাখীর মত্ত ঝাপটা সব এলোমেলো করে দিল। আমাদের এক বড় বোন ওদের কুৎসিত লালসার বলী হলো। তার ধর্ষিত লাশ নিয়ে গর্জে উঠলাম আমরা।

নয়া একাত্তর আমাদের জাগিয়ে তুলল। ধ্বংসস্তূপের নিচে শুনতে পেলাম মানবিকতার গান। জেগে উঠলাম দৃপ্ত শপথে। আমাদের ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তায় ওরা পালানোর পথ খুঁজছে। আর তখনি ত্রাতা হয়ে হাজির হলো রাজনীতি। অসদাচরণের দায়ে আন্দোলনকারী দশজনকে সাময়িক বহিষ্কার করলো প্রশাসন। আমরা ফুঁসে উঠলাম। এই সিদ্ধান্তে একমত হওয়া সকল শিক্ষকের রক্ত দিয়ে দেশ রাঙানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করলাম। ঘোষণা করলাম, ধর্ষক সন্তানের জন্মদাতা নপুংসকদের শিশ্ন কেটে ঝুলিয়ে দেয়া হবে প্রকাশ্য রাজপথে। আমাদের আপোষহীন আন্দোলন ক্যাম্পাসে স্বাগত জানালো বর্বর পেটোয়া বাহিনীকে।

গ্যালারিতে দেশ, কাল, জনগণ এবং মিডিয়া। একদিকে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী। অন্যদিকে সরকার, প্রশাসন এবং ঘুণে ধরা রাজনীতির জারজ সন্তান। কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধের মত কোন দেবতা আমাদের পক্ষ নিয়েছিল কিনা আমার জানা নেই। আমার জানা নেই দেবীর আশীর্বাদ পুষ্ট একিলিস কিংবা হেক্টরের মত কোন বীর আমাদের মধ্যে ছিল কিনা। আমি জানিনা বদরের সেই ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণের মত আল্লাহ প্রেরিত ফেরাস্তাগণ আমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছিল কিনা! আমি শুধু জানতাম স্বামীহারা এক গ্রামীণ নারী তার সন্তানের প্রত্যাগমনের জন্য অধীর প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে। আর এক শহুরে নারীর কমনীয় হাসি ঢেকে গেছে উদ্বিগ্নতার কালো মেঘে।

কাল নিশুতি বলেছিল, ‘সারা দেশেই তো খুন ধর্ষণ হচ্ছে। কয়টার বিচার করবে তোমরা। যাদের বিচার করার কথা তারা নিজেরাই ধর্ষণ করে বেড়াচ্ছে। তোমরা অল্প কয়জন মিলে কি করবে?’ ‘তোমার যদি কিছু হয় নিশুতি, কে আমার ডাকে সাড়া দিবে? আমি যদি আজ শেফালী আপুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে না পারি, কাল আমার কিংবা তোমার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার জন্য কেউ আসবেনা। এভাবে বুটের নীচের জীবন আর কতদিন! আমাদের বাবারা তো এমন দেশের জন্য প্রাণ দেয়নি। আমি এভাবে বেঁচে থাকতে পারবনা।’ ‘আমার কথাটা একবার ভাবো ! তোমাকে হারালে কী নিয়ে বেঁচে থাকব আমি?’ ‘তুমি বেঁচে থেকো নিশুতি। আমার স্মৃতি বুকে নিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানিয়ো এক কুলাঙ্গার সময়ে জন্ম হয়েছিল আমার।’

৩.
ঘোর লাগা স্বপ্নের জগত থেকে ধীরে ধীরে বাস্তবে ফিরছি। ‘পানি পানি’ কানে আসছে আমারই আর্তনাদ। কেউ একজন চরচর করে পানি ঢালছে আমার নাকে মুখে। কে তুমি দরদী! পানি দিয়ে জীবন দান করছ? কিন্তু নোনতা কেন ! বাবার কাছে শুনেছি পাকি কুত্তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করত। পানি চাইলে প্রস্রাব করে দিত কখনো কখনো। দেশ স্বাধীন হয়, প্রজা স্বাধীন হয়না! পানি দান শেষে একটি হাত আমাকে টেনে নিয়ে ফেলে আরো ক’জন আহতের শরীরে।

চারপাশে আহতদের কাতর চিৎকার। একজন আমার হাত ধরে বলে ওঠে ‘দোস্ত তুই বাইচা আছস! আমি তো ভাবছিলাম মইরা গেছোস। জানস, নাহিদ না মইরা গেছে। ওরে আরেকটা গাড়ীতে তুইল্যা নিতে দেখছি। অন্তত সাত-আটজন মরছেরে।’ আমার অনুভূতি নেই। বেঁচে থাকায় আনন্দ না বেদনা উপলব্ধি করতে পারছিনা। ‘হুদাই ফাল পারলাম আমরা। কোন শালায় আমাগো লগে যোগ দিলোনা। আমরা হুদাই মাইর খাইলাম। ওই শয়তানের বাচ্চা মাদীগুলারে ইচ্ছা করতাছে মাইরা কচুকাটা কইরা ফালাই।’ ‘তুই চুপ কর। সবাই তো একই রকম চিন্তা করেনা।’

শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। মেরুদণ্ড অবশ হয়ে আছে। হাতে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। মাথা ঘুরে উঠে। সবখানে ব্যথা। আমাকে কি পরেও মেরেছে? ‘এখন কয়টা বাজে?’ ‘এশার আজান দিছে ঘণ্টা দুয়েক হইব।’ ‘এখন পর্যন্ত আমাদের জন্য কেউ আসে নাই?’ ‘কে আইব ? আমাগো লাইগা ভাবার টাইম আছে কারো?’

আমার মোবাইল উধাও। মানিব্যাগ নেই। পেটে ক্ষুধা চির জাগরুক। বাড়িতে মা এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। এশার নামাজের পর ছেলের জন্য পরওয়ারদিগারের কাছে মুনাজাত করে এখন হয়তো ঘুমের ঘোরে কাঁদছেন। মা যে সন্তানের সব কিছুই টের পেয়ে যান! দোহাই আল্লাহ! মাকে জানতে দিওনা আমার এ অবস্থার কথা। আমার মাকে কাঁদিওনা খোদা। তার মনে তৈরি করে দাও জান্নাতুল ফেরদাউসের মিষ্টি বাতাসের ঢেউ। তাকে ভাবতে দাও তার ছেলে ভাল আছে, খুব ভাল আছে।

হঠাৎ একটা মিষ্টি গন্ধে তন্দ্রাহত হয়ে পড়ি। আমার চোখের ভিজে কোণে লেপ্টে থাকে একটি কোমল ওড়নার প্রান্ত। কপালে মিষ্টি স্পর্শ অনুভব করি। ‘নিশুতি তুমি এসেছ ?’ ওড়না সরিয়ে চাঁদের হাসিতে ভরিয়ে দেয় ভুবন। একটি স্বর্গীয় উদ্যানে আমরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছি। বাতাসে ভাসছে ফুলের পাপড়ি। রঙিন প্রজাপতির ডানায় কাঁপছে স্বর্গীয় আলো। আমাদের চারচোখের কোণে স্থির হয়ে পড়ে থাকে সনাতনী সময়। ওর চোখের পাপড়ি আস্তে আস্তে ক্ষয়ে পড়তে থাকে। একসময় চোখদুটো উধাও হয়ে সেখানে তৈরি হয় কালো গহ্বর। সুন্দর মুখটি ধীরে ধীরে বিকট হয়ে প্রচণ্ড শব্দে হেসে ওঠে। আমি চিৎকার দিয়ে বাস্তবে ফিরে আসি।

আমাদের ধারণাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে হলের কোন কোন সাহসী বন্ধু পুলিশকে ঘুস দিয়ে খাবার পাঠায়। দুজন সাংবাদিক বন্ধু এসে দেখা করে যায়। কয়েকটি পত্রিকার সাংবাদিক কথা বলতে চেয়েছে, পুলিশ অনুমতি দেয়নি। সাংবাদিক বন্ধুরা জানিয়েছে আরো বড় আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে ক্যাম্পাসে। সাতজন ছাত্র নিহতের খবরে ক্ষোভে ফুঁসছে সারা দেশ। কয়েকটি ছাত্র সংগঠন হলে হলে জানিয়ে গেছে কাল দেশ অচল করে দেবে তারা। কোন আপোষ নয়। হত্যার বদলে হত্যা, মারের বদলে মার। এসব ভাবতে ভাবতে আশায় আমার চোখে পানি চলে আসে। আমার মুষ্টিবদ্ধ হাত শরীরে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দেয় । আমি বিপুল আক্রোশে চিৎকার করে উঠি ‘জালিমের মৃত্যু, আর বেশি দূরে নয়।’ আমার সাথে ধীরে ধীরে আহত গোঙানিগুলো তাল মেলাতে শুরু করে। আমাদের বিপুল গর্জনে গভীর রাতের নীরবতা খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়ে।

৪.
আরেকটি ঝলমল সূর্যের আলোকদীপ্ত টানটান উত্তেজনার দিন। সকালেই জামিনে মুক্ত হয়ে ব্যথানাশক ইনজেকশন নিয়ে চলে এসেছি আন্দোলনে। আজ আমাদের সাথে সহস্র শিক্ষার্থীর মিলিত মিছিল। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তারা এসেছে আমাদের সাথে একাত্মতা জানাতে। চারদিক থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল এগিয়ে আসছে। প্রতিবাদের উত্তাল ঢেউয়ে কাঁপছে ক্যাম্পাস। আমাদের আন্দোলন ধীরে ধীরে গণআন্দোলনে পরিণত হচ্ছে।

কয়েকজন ছাত্রের জানবাজী চেষ্টায় একটি গণআন্দোলন তৈরি হয়ে গেল! ছাত্রীদের একটি মিছিল আসছে আমাদের ছাত্র-গণজমায়েতের দিকে। তাদের কণ্ঠের উচ্চকিত আওয়াজ হার মানাচ্ছে আর সব শব্দসমষ্টিকে। আমি অজানা প্রত্যাশায় মিছিলটির দিকে তাকিয়ে থাকি। দু’সারি পেছনে একটি মুষ্টিবদ্ধ হাত নেতৃত্ব দিচ্ছে মিছিলের। আরো কাছে আসতে বুঝতে পারি ওটা নিশুতি। প্রিয়জনের নির্যাতন তার ভেতরকার কোমল হৃদয়টাকে পরিণত করেছে বিপ্লবীতে। আমাদের চোখাচোখি ওর স্বরে কোন প্রভাব ফেলেনা। পরিণত কণ্ঠস্বরে জালিমের প্রাসাদ পুড়িয়ে দেবার আগুণ আর চলার ভঙ্গিতে গোখরো পাড়িয়ে মারার দৃপ্ত অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে আসছে নিশুতি।

খবর রটে গেল, রাষ্ট্রপ্রধান স্বয়ং আমাদের কথা শুনবেন। তার দলের কর্মীরা জানিয়ে গেছে, অন্যায়কারীর বিচার হবেই। যা হয়ে গেছে তা ভুলে যেতে হবে। রাতে আমাদের জন্য খাবার পাঠানো, শেষ মুহূর্তে পুলিশের ভাল ব্যবহার, জামিনে মুক্তি-সবই তারা করেছে। আমাদের শুধু এখন চুপ করে থাকতে হবে। রাষ্ট্রপ্রধানের সামনে বেয়াদবি করলে এবার ক্রসফায়ার থেকে মুক্তি নেই! আমি বুঝতে পারি, ছিনতাই হয়ে যাওয়া এক আন্দোলনের রূপকার আমরা! ব্যর্থ আক্রোশে দেখি ধর্ষক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে গণজমায়েতের সবগুলো পয়েন্ট। সারা শহর থেকে ওদের নেতৃত্বেই এসেছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী!

শত শত পেটোয়া বাহিনীর নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী নিয়ে উপস্থিত হন দেশপতি। নির্যাতিত ছাত্রদের একজন হিসেবে মাইক্রোফোনের সামনে উচ্চকিত হয় আমার কণ্ঠ, ‘মহামান্য রাষ্ট্রপ্রধান! আপনার কোমল ব্যক্তিত্বের আদৌ কোন মূল্য এ রাষ্ট্রে আছে কিনা আমাদের জানা নেই। আমরা জানিনা একজন দেশপতি কতটা উদাস হলে ঘটে চলে বিবেকের মহামারী। এমন একটি অলংকৃত পদে বসা কতটা প্রয়োজন একজন নপুংসকের সেও আমাদের জানা নেই। আমরা শুধু জানি আপনার অথর্ব শাসনে দিশেহারা একটি দেশ। জনগণের ঘৃণার দাবদাহ চারদিকে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যার পানি আজ গুম হয়ে যাওয়া মানুষের পচা লাশে বিষাক্ত দুর্গন্ধ। ঘৃণার শক্তি কতটুকু হলে আপনার বুকে বুটের দাগ পড়বে...’

আমার কথা শেষ হয়না। পুলিশ-সেনার যৌথবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার উপর। কিছু সাহসী শিক্ষার্থী লাফিয়ে উঠে আসে স্টেজে। তাদের স্বতঃস্ফূর্ত স্পর্ধিত হুংকারে পিছু হটে খাকি। রাষ্ট্রপ্রধান ইঁদুরের মত একপাশে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। শুরু হয় ভয়াবহ গোলাগুলি। দেশ কি তবে আরেকটি যুদ্ধের দিকে এগিয়ে গেল! যে যুদ্ধটির জন্য আমরা এতদিন অপেক্ষা করছিলাম!

কয়েকটি বুলেট আমাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। আমি আবারও অপার্থিব শোভাযাত্রায় নিজেকে আবিষ্কার করি। অসংখ্য খাটিয়ার একটিতে শুয়ে আছি। আমার চোখের উপর থেকে সাদা কাপড় সরিয়ে উঁকি দেয় নিশুতির মায়াভরা চাহনি। টপটপ ঝরে পড়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু। আমি কায়াহীন হাতে ওর চুল স্পর্শ করি। কানে কানে বলি ‘একেবারে বৃথা যায়নি আমাদের আত্মত্যাগ। তাকিয়ে দেখো ভুখা-নাঙ্গা মানুষের মিছিলে প্লাবিত শহর-নগর-জনপদ। জালিমের দিন শেষ। এবার দেখো ঠিকই আসবে কাঙ্ক্ষিত সুসময়।’ নিশুতির চোখের পাপড়ি কাঁপে। মুক শব্দে সেও যেন জানিয়ে দেয় ‘বৃথা আশায় কী লাভ বল? এ বড় দুঃসময়। একমাত্র নপুংসকরাই বেঁচে থাকে এখন।’


গল্পটি এখানে প্রকাশিত
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১২ সকাল ১১:৫৯
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিশ্বাসীকে লজিকের কথা বলার দরকার কি?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ দুপুর ২:১৭




হনুমান দেবতা এবং বোরাকে কি লজিক আছে? ধর্ম প্রচারক বলেছেন, বিশ্বাসী বিশ্বাস করেছেন ঘটনা এ পর্যন্ত। তাহলে সবাই অবিশ্বাসী হচ্ছে না কেন? কারণ অবিশ্বাসী বিশ্বাস করার মত কিছু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের শাহেদ জামাল- ৭১

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ দুপুর ২:৫৪



শাহেদ জামাল আমার বন্ধু।
খুব ভালো বন্ধু। কাছের বন্ধু। আমরা একসাথেই স্কুল আর কলেজে লেখাপড়া করেছি। ঢাকা শহরে শাহেদের মতো সহজ সরল ভালো ছেলে আর একটা খুজে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভাবছিলাম ২ লক্ষ ব্লগ হিট উপলক্ষে ব্লগে একটু ফান করব আড্ডা দিব, কিন্তু এক কুৎসিত অপব্লগার সেটা হতে দিলোনা।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:০৫



এটি ব্লগে আমার ২৬০ তম পোস্ট। এবং আজকে আমার ব্লগের মোট হিট ২০০০০০ পূর্ণ হয়েছে। আমি আনন্দিত।এই ছোট ছোট বিষয় গুলো সেলিব্রেট করা হয়তো ছেলে মানুষী। কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শয়তান বন্দি থাকলে শয়তানি করে কে?

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:২০



রমজানে নাকি শয়তানকে বেধে রাখা হয়,তাহলে শয়তানি করে কে?

বহুদিন পর পর ব্লগে আসি এটা এখন অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। বেশ কিছু বয়স্ক, মুরুব্বি, সম বয়সি,অল্প বয়সি একটিভ কিছু ব্লগার... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কট বাঙালি

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৯ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:২৪



কদিন পরপরই আমাদের দেশে বয়কটের ঢল নামে । অবশ্য তাতে খুব একটা কাজ হয় না । বাঙালির জোশ বেশি দিন থাকে না । কোন কিছু নিয়েই বাঙালি কখনই একমত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×