জ্ঞানীরা বলেন ভাষা বয়ে চলে। কিন্তু আমি বলি, যত না বয়ে চলতে হয়—তারচে বেশি তাকে সয়ে চলতে হয়।ভাষা নিয়ে মানুষের জ্ঞান এত ভাসা-ভাসা যে তাকে সর্বংসহা হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
হাল আমলের ‘হুদাই’ শব্দটার কথা ধরা যাক—“কিছু-কিছু পাবলিক এখন ‘হুদাই’ লাইক মারে।” মানে,‘হুদাই’ বলতে এখন আমরা বুঝাচ্ছি খামোখা, এমনি, অকারণ ইত্যাদি।
বিশ বছর আগের একটা বাক্য দেখি—‘বেহুদা কথা বলবে না তো! ’ এখানে বেহুদা বলতে কী বুঝানো হচ্ছে? খামোখা, এমনি-এমনি, অকারণ —তাই তো?
তাহলে আগে ‘বেহুদাই’ বলতে যা বুঝানো হতো, এখন তা আমরা ‘হুদাই’ দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছি!আমাদের ‘বোধ’ কতটা ‘বেবোধ’ হলে এমন করা সম্ভব?
এই যে ভাষাকে অ্যায়সা করে একটা আছাড় দিয়ে মানেটাকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিলাম, তারপরও সে আমাদের সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে! সয়ে যাওয়ার চরম পরাকাষ্ঠা!
আরেকটা উদাহরণে আসা যাক—“দোস্ত! তোর জামাটা তো ‘জট্টিল’ হইছে!”এই বাক্যে ‘জটিল’ বলতে বুঝানো হলো ‘দারুণ’!
শব্দের অর্থকে কতটা জটিল করলে ভাষার প্রতি এই নিদারুণ আচরণ সম্ভব!
“দোস্ত! তোরে তো আজ ‘অস্থির’ লাগছে!”—বক্তার দোস্ত যে অস্থির হয়ে ছটফট করছেন, এই বাক্যে বক্তা আসলে তা বুঝাচ্ছেন না। তিনি বলতে চাইছেন—তার দোস্তকে আজ চমৎকার লাগছে, সুন্দর লাগছে!ভাষার প্রতি আমাদের এই অস্থিরতা আদৌ লোপ পাবে বলে মনে হয় না।
পরবর্তী উদাহরণে আসা যাক—‘সেই, মামা! সেই!’ বন্ধু বা সহপাঠীকে মামা বলা হচ্ছে—আমার আপত্তি এখানে নয়। আপত্তি হলো ‘সেই’টা দ্বারা উনি ‘কোনটা’কে বুঝাচ্ছেন?উনি আসলে ‘সেই’ দ্বারা বুঝিয়েছেন ‘অস্থির’, ‘জটিল’, নাইস! সেই পুরাতন মানেগুলো প্রয়োগের গ্যাঁড়াকলে পড়ে মানে-মানে কেটে পড়তে শুরু করেছে!
তো, ভাষা সম্পর্কে এত এত ভাষণ দিয়ে আমি আসলে কী বুঝালাম?কাউকে ‘অস্থির’ লাগলে তাকে কি আমরা অস্থির বলব না?কারও জামা জট্টিল লাগলে সেটাকে জটিল বলা যাবে না?
অবশ্যই যাবে।ভাষা তো আর আমার বাপ-দাদার সম্পত্তি নয়, যে আমার ইচ্ছেমতো পাবলিক সেটাকে ব্যবহার বা অপব্যবহার করবে। ভাষা হলো ভাব আদান-প্রদানের মাধ্যম।তাই অন্যরা যে শব্দ দিয়ে যে-ভাব প্রকাশ করছে, আমাকেও বাধ্য হয়ে সেটাকে সেই ভাবেই নিতে হবে। ভাব ধরে বসে থাকলে তো আর চলবে না। হাজার হলেও এখন গণতন্ত্রের যুগ।পাল্লা যেদিকে ভারি,সেদিকেই পাড়ি দিতে হবে। নইলে, চিল্লাপাল্লায় তিষ্ঠানো দায় হবে।
—আধুনিকতার বাঁধুনি
স্নিগ্দ্ধ মুগ্দ্ধতা
৩১ অক্টোবর, ২০১৭।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৪১