চায়ের কাপে বড় একটা চুমুক দিয়ে টুটুল বলল—দেশে কবি আর কাকের সংখ্যা যে সমান—এই বিষয়ে অনেকের আপত্তি থাকলেও কারও সন্দেহ নেই। চুম্বকের আশেপাশে থাকলে খানিকক্ষণ পরই লোহাও চুম্বক-চুম্বক আচরণ শুরু করে। আর বাংলাদেশে জন্মালে কয়েক বছর পরই মানুষ কবি-কবি ভাব ধরে।
টুটুল সবসময় এইরকম বড়-বড় বুলি ঝাড়ে। এটা অবশ্য, বলতে গেলে, ওর জন্মসূত্রে পাওয়া। ছেলে বড়ো দার্শনিক হবে—এই রকম একটা আশা নিয়ে বাবা নাম রেখেছিলেন ‘অ্যারিস্টটল’। সেই অ্যারিস্টটলই কালক্রমে ‘টুটুল’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই নামের মহিমা বজায় রাখার জন্যই ও বোধহয় এইরকম বড়ো-বড়ো লেকচার দেয়!
আমি বললাম—হঠাত্ কবিদের নিয়ে পড়লি?
টুটুল বলল—কেন কবিতা পড়া যাবে, আর কবিদের নিয়ে পড়া যাবে না?
আমি ত্যক্ত হয়ে বললাম—কথা প্যাঁচাস ক্যান?
টুটুল বলল—আরে হাল-আমলের উঠতি কিছু কবিদের কবিতা পড়ছিলাম। তা, যেভাবে তারা কবিতা লিখছে তাতে করে ওইসব উঠতি কবিরা উঠতে-উঠতে কবিতাও উঠে যাবে!
আমি বললাম—তাদের কবিতায় সমস্যা কোথায়?
টুটুল বলল—প্রথম কথা হলো—এরা গদ্য আর পদ্যের মধ্যে পার্থক্যটাই বোঝে না! গদ্য-কবিতা লিখছিস, মিল-ছাড়া কবিতা লিখছিস ভালো কথা। কিন্তু, তাই বলে ছন্দ ছাড়াও কবিতা লিখবি? সব এইরকম করে ছাড়তে থাকলে তো কয়দিন পর কবি ছাড়াও কবিতা লেখা হয়ে যাবে!
আমি চায়ের কাপ ঠকাস করে টেবিলে নামিয়ে রেখে বললাম—তাহলে তাদেরকে তুই কী করতে বলিস?
ও বলল—তাঁদের উচিত আগে বিখ্যাত সব কবিতাগুলো টানা পড়ে যাওয়া। বিদ্রোহী পড়তে পারে, সাত সাগরের মাঝি পড়তে পারে, আর রবীন্দ্রনাথ তো আছেই! আল মাহমুদ আছেন, শামসুর
রাহমান আছেন।
আমি ভুরু কুঁচকে বললাম—তোর কি মনে হয় কবিতা পড়তে থাকলেই ছন্দজ্ঞান সবার চলে আসবে?
টুটুল বলল—তবে কি না-পড়লে আসবে? আর ছন্দজ্ঞান আরও টনটনে করতে হলে ওদের উচিত জাদুকরের কাছে যাওয়া।
আমি বললাম—জাদুকর?
টুটুল বলল—ছন্দের জাদুকরের কথা বলছি। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর কবিতা পড়লেই দেখ না কেমন ঢেউ খেলে যায় মাথার মধ্যে—
আজকে তোমায় দেখতে এলাম জগৎ-আলো নূরজাহান,
সন্ধ্যা-রাতের অন্ধকার আজ জোনাক পোকায় স্পন্দমান!
বাংলা থেকে দেখতে এলাম মরুভূমির গোলাপ ফুল,
ইরান দেশের শকুন্তলা, কই সে তোমার রূপ অতুল?
আবৃত্তি শেষ করে ও বলল—ছন্দের জাদুটা দেখেছিস? থামার পরও কেমন রেশ রয়ে যাচ্ছে?
আমি অবশ্য এইসব রেশফেশ কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু, আর যাই হোক কবিতার ব্যাপারে টুটুলের উপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। কাজেই মাথা নেড়ে বোঝার ভান করলাম।
টুটুল ওর চা শেষ করে বলল—আর ছোটদের নিয়ে ছড়া-কবিতা যে লেখা যায়—ওটাতো সবাই ভুলেই গেছে! যাও দু-একজন লিখছে ওতে শুধু জ্ঞানের কথা ছাড়া আর কোনও রস নেই।
আমি বললাম—জ্ঞানের কি দরকার নেই?
টুটুল বলল—জ্ঞানের দরকার নেই, তা বলেছি নাকি? আমি বলেছি ‘শুধু জ্ঞানের’ দরকার নেই। মানে, জ্ঞানের সাথে একটু লবণও মিশিয়ে দিতে হবে। নইলে বাচ্চারা খাবে কেন?
আমি বললাম—তো তুই-ই লেখ না!
চায়ের বিল মিটিয়ে দিয়ে টুটুল বলল—লিখছি তো। এই দ্যাখ, বাচ্চাদের জন্য একটা ছড়া লিখেছি—
‘আপনাকে বড়ো বলে বড়ো সেই নয়,
আমাকে যে বড়ো বলে বড়ো সেই হয়।
বড় হওয়া সংসারে কঠিন ব্যাপার—
নিয়মিত খেতে হয় নানান খাবার!
খেয়েদেয়ে হাতি হলে বড় বলে সবে,
বড় যদি হতে চাও—বেশি খাও তবে!’
দেখবি এই ছড়া পড়লে যে-সব বাচ্চারা খেতে চায় না, তারা না-খেয়ে থাকতে চাইবে না। আর বড়ো হয়ে আসল কবিতাটা যখন তারা পড়বে, তখন বুঝবে আগে-পড়া কবিতাটা ছিল ছোটোবেলার জন্য, আর এখনকার কবিতাটা জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য।
মোক্ষম যুক্তি। অতএব, আমি সায় দিয়ে মাথা নাড়লাম।
—কাক না কি কবি?
স্নিগ্ধ মুগ্ধতা।
৯ নভেম্বর, ২০১৭।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:০৯