আমরা দুই মামা-ভাগ্নে হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলাম বিকেলবেলায়। হাঁটতে-হাঁটতে বেশ দূরেই এসে গেছি। পিচ-রাস্তা পেরিয়ে আমরা সামনের চা-বাগানের মেঠোপথে ঢুকে পড়লাম। রাস্তার একধারে একজন মুরব্বি-গোছের লোক বাদাম বিক্রি করছিল। সেদিকে তাকিয়ে ড়াড্ডিম বলল—মামা, বাদাম খাবো।
আমি বললাম—হাওয়া খেতে বেরিয়েছি, হাওয়া খাবো। বাদাম খাবো ক্যান?
ড়াড্ডিম বলল—তোমাকে খেতে বলছে কে? আমি নিজেই খাবো।
আমি বললাম—তা আর বলবি কেন! সারা জীবন শুধু আমিই বলব—ভাগ্নে, ভাগ নে। কিন্তু ‘ভাগ দে’ বললেই ভাগবি। ভাগ্নেরা খালি ভাগ নেওয়ার সময় আছে—এ তো জানা কথা। ভাগ দিতে হলেই তাদের হয়েছে! হৃদয় তাদের একেবারে ভগ্ন হয়ে যায়!
ড়াড্ডিম তবুও ঘ্যানর-ঘ্যানর করতে লাগল। আমি বললাম—ঠিক আছে চল!
বাদামওয়ালার সামনে গিয়ে বললাম—চাচা, বাদামের শ কত?
চাচা বললেন—বিশ টাকা।
—এই কটা বাদামের এত দাম?
—বাহ! দাম হবে না! ‘বাদামের’ নামের মধ্যেই তো ‘দাম’ রয়েছে!
—কম হবে না?
—ওজন করে দেব। কম হবে কেন? আমি কি ওজনে ফাঁকি দিই?
—ফাঁকি না দাও, ভালো কথা। বাকি দাও তো?
—কেন? বাকির কথা উঠছে কেন?
আমি বললাম—উঠবে না কেন? কথা, আর চোখ—দুটোই তো উঠবার জিনিস!
চাচা বলল—ওরকম বাকি বেচতে থাকলে আমার দোকানটাও উঠে যাবে।
বিশ টাকার বাদাম কিনে নিয়ে রাস্তার একধারে ঘাসের উপর বসে আমরা বাদাম খাচ্ছি, ড়াড্ডিম বলল—মামা, হিসু পেয়েছে।
আমি বললাম—পাওয়া জিনিস নিতে নেই। তারপর, দূরের একটা গাছ দেখিয়ে বললাম—ঐখানে গিয়ে ফেরত দিয়ে আয়।
ড়াড্ডিম কাজ সেরে ফিরে আসছে এমন সময় একটু দূরেই নারীকণ্ঠের তীক্ষ্ণ তীব্র একটা চিৎকার। আমি চট করে মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম বছর তেরো-চৌদ্দর একটা ছেলে একজন তরুণীর গলা থেকে টান মেরে কিছু একটা ছিনিয়ে নিল। অস্তগামী সূর্যের ম্লান আলোতে সেটার সোনালি রঙ ঝিকিয়ে উঠল। তরুণীটি হাউমাউ করে উঠে বলল—গেল রে। হারটার সাথে গলাটাও গেল। যদিও দেখলাম, তাঁর গলাটা যায়নি —সেটা যথাস্থানেই আছে!
আমি কী করব বুঝতে না পেরে ছেলেটার পিছনে একটা খিঁচে দৌড় লাগালাম। দৌড়োতে দৌড়োতে পিছন ফিরে দেখলাম ড়াড্ডিমও আমার পিছু-পিছু ছুটছে।
ছেলেটা মূল রাস্তায় না-গিয়ে চা-বাগানের আরও ভিতরে ঢুকে গেল। আমি মিনিট তিনেক ছুটেই তাকে জাপটে ধরে ফেললাম। তারপর তার মুখটা আমার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম—দেব একটা থাপ্পড়?
ছেলেটা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল—পারেন তো শুধু ওই একটা জিনিসই দিতে। কোনওদিন দুটো টাকা দিয়েছেন?
ছেলের কথা শুনে আমি তো স্তম্ভিত! বলে কি! আমি বললাম—দিনে না দিই—রাতেও কি দিই নি?
ছেলেটা উত্তর না দিয়ে কেমন চ্যাং মাছের মতো আমার হাত পিছলে বেরিয়ে গেল। তারপর এক ছুটে চা-বাগানের কোন কোণায় যে মিলিয়ে গেল আবছা অন্ধকারে ঠিকমতো ঠাওর করতে পারলাম না।
ড়াড্ডিম এসে হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল—গেল কই ছেলেটা?
আমি বললাম—বাগে এনে বাগানোর পরেও ক্যামনে যে বাগানের কোথায় গিয়ে লুকালো টের পেলাম না।
ড়াড্ডিমের কথা শেষ হতেই অনেক দূর থেকে মাগরিবের আজান ভেসে এল। সন্ধ্যে নেমে এসেছে। আমি বললাম—তায়াম্মুম করে আয়। নামাজটা এখানেই পড়ে নি।
নামাজ শেষ করে ফিরতি পথ ধরতেই বাঁধল বিপত্তি। পথ হারিয়ে ফেললাম আমরা। তিন মিনিট ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে যে এত ভিতরে আসা যায় আমার কোনও ধারণা ছিল না।
আর চারদিকে এত-এত সুঁড়িপথের ঘোরপ্যাঁচ যে মাথার মধ্যে প্যাঁচ লেগে যায়! মোবাইলের চার্জও প্রায় শেষ। ফ্ল্যাশটা অফ করে দিতেই অন্ধকার ঘিরে ধরল। অন্ধ হয়ে যেতে হয় বলেই বোধহয় অন্ধকারের নাম অন্ধকার।
কোনদিকে যাব বুঝতে পারছি নে এমন সময় সামনে দিয়ে এক দাঁড়িওয়ালা বয়স্কলোকের অবয়বকে আসতে দেখা গেল। তিনি আমাদেরকে দেখে অবাক হয়ে বললেন—তোমরা যাবে কোথায়?
আমি বললাম—রাস্তায়।
মুরব্বি আশ্চর্য হয়ে বললেন—মানে? তোমরা তো রাস্তায়ই আছ! এটাকে কি রাস্তা মনে হচ্ছে না?
আমি বললাম—না, আসলে বলছিলাম—বড়ো রাস্তায় যাব—পিচ-রাস্তায়।
ভদ্রলোক বললেন—ও! তাইলে সোজা পুব দিকে যাও।
আমি অন্ধকারাচ্ছন্ন আঁকাবাঁকা সুঁড়িপথগুলোর দিকে তাকিয়ে বললাম—এই বাঁকা পথ দিয়ে সোজা যাব ক্যামনে? আর তাছাড়া পুব দিক কোনটা সেটাও তো জানি নে।
ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন—তুমি এতো বড়ো একটা মানুষ, পুব দিক কোনটা জানো না! কেন, যেদিকে সূর্য ওঠে, যে-দিকে পেছন দিয়ে মানুষ নামায পড়ে ওটাই তো পুবদিক।
আমি বললাম—আহা! ওটা তো জানি। মানে, বলতে চাইছি—এখানে কোনটা পুবদিক সেটাই বুঝতে পারছি নে।
ভদ্রলোক বললেন—ও! তা চলো। আমিই তোমাদেরকে না-হয় পৌঁছে দিয়ে আসব। তবে এগুলো আগে বাড়ি রেখে আসতে হবে—ভদ্রলোক তার হাতের দুটো ব্যাগের দিকে ইশারা করলেন।
বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। আমি বললাম—চলুন, আপনার বাড়িতেই না হয় আপাতত যাওয়া যাক।
আমরা ভদ্রলোকের পিছু-পিছু তাঁর বাড়ির দিকে চললাম। বিশাল-বিশাল বড়ো চা-বাগানগুলোতে মাঝে-মাঝে চা-শ্রমিকদের পাড়া আছে। ভদ্রলোক নিশ্চয় কাছাকাছি কোনও একটা পাড়াতে থাকেন।
ভদ্রলোকের সাথে তাঁর বাড়ির উঠোনে পা দিয়েই আমি আর ড়াড্ডিম—দুজনেই ‘তব্দা’ মেরে গেলাম। দেখলাম, ঘরের বারান্দায় হারিকেন জ্বালিয়ে বসে বই পড়ছে —আর কেউ নয়, আমাদের সেই হার-মানা-হার—যার কাছ থেকে হার উদ্ধার করতে গিয়ে ঘণ্টাখানেক আগেই হার মানতে হয়েছে! এমনকি শুধু হার হারানোই না, যার পাল্লায় পড়ে রাস্তাও হারাতে হয়েছে!
ছেলেটাও আমাদের দেখে পুরো ভ্যাবাচ্যাকা মেরে গেছে! কী করবে বুঝতে না-পেরে সে ঘাড় গুঁজে বই পড়ার ভান করতে লাগলো।
দশ মিনিট পর। ঘরের দাওয়াতে বসে আমি আর ড়াড্ডিম বিনা-দাওয়াতেই আখের গুড় দিয়ে রুটি খাচ্ছিলাম। সেই নিবিড় চা-বাগানের মাঝে মাটির ঘরের দাওয়ায় হারিকেনের আলোয় বসে আখের গুড় দিয়ে রুটি খাওয়া যে এত মজার হতে পারে—তা, যে খায়নি তাকে হাজার অঙ্ক কষে বুঝালেও বুঝবে না। এমনকি অঙ্ক না-কষে কষে একখান থাপ্পড় দিলেও বুঝবে কি না সন্দেহ।
আসার সময় হারটা পকেটস্থ করে ছেলেটাকে কথা দিলাম—তার বাবাকে ঘুণাক্ষরেও হারের কথা বলব না, বিনিময়ে সে আর কখনও এমন কাজ করবে না। অবশ্য, সেটাকে কাজ না বলে অকাজ বলাই ভালো।
পরদিন সকালবেলা ড়াড্ডিমকে বললাম—বিকেলে বেড়াতে যাওয়ার সময় হারের কথা মনে করিস তো। মালিককে খুঁজে বের করে হারটা ফেরত দিতে হবে।
ড়াড্ডিম বলল—বিকেলে কেন? ওটা তো এখনও দেওয়া যায়।
আমি বললাম—মানে?
ড়াড্ডিম বলল—যার হার চুরি হয়েছে উনি তো আমাদের বাংলা ম্যাডাম।
আমি বললাম—ও! কিন্তু, ভাষার ক্ষেত্রে খালি ইংরেজি-বাংলা হয় জানতাম। ম্যাডাম আবার বাংলা হয় কী করে?
ড়াড্ডিম কিছু না বলে হারটা পকেটে পুরে স্কুলে চলে গেল।
বিকেল বেলা আমি যখন বাসায় ফিরলাম, ড়াড্ডিম বলল—মামা, ম্যাডাম তোমাকে একটা চিঠি দিয়েছে। চিঠিটা খুলে দেখলাম গোটা-গোটা অক্ষরে লেখা—
ডাক্তার সাহেব,
হারানো হার ফিরিয়ে দেওয়ায় আপনাকে হৃদয়-নিঙড়ানো শুভেচ্ছা। তবে এতো কষ্ট করে হারটা উদ্ধার না-করলেও চলত। আমি গতকালই ‘সিটি গোল্ডের’ দোকান থেকে নব্বই টাকা দিয়ে আরেকটা হার কিনে নিয়েছি।
আপনার গুণমুগ্ধ,
লিনিয়া আফরোজ।
—রাস্তা ভুলে পস্তানো
স্নিগ্ধ মুগ্ধতা।
১৬ নভেম্বর, ২০১৭।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:৩২