প্রতিশ্রুতির বাজারে একগাদা বিলাপ
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১২০০ মানুষের লাশের উপর দাঁড়িয়ে মেয়র নির্বাচন নিয়ে চলছে অবিরাম লাফালাফি। প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভেসে যাচ্ছে নগরী। জড়পদার্থ আর পশুপাখি মার্কা নিয়ে কাড়াকাড়ি শেষে একেকটা নামের পাশে জুটেছে দেয়াল ঘড়ি, টিফিন বক্স, হাতি ইত্যাদি আজব চিহ্ন। হাসিমুখে ডান হাত, বাম হাত তুলে সুযোগ্য প্রার্থীরা তাদের অবস্থান বুঝিয়ে দিচ্ছেন, আত্ম-জয়গানে ভরিয়ে তুলছেন রাজপথ। রাজপথের আনাচে-কানাচে বাজছে নানা গানের ভোট-প্যারোডি। বিভিন্ন ইন্টারেক্টিভ মার্কেটিং পলিসি নিয়ে মাঠে নামা মানুষগুলো জনগণের ভবিষ্যৎ চিন্তায় ভয়ানক মগ্ন, মিটিংয়ে-মিছিলে ভাসছে ভবিষ্যৎ গড়ার প্রতিজ্ঞা। হে মানুষ, ভবিষ্যৎ গড়তে গেলে অতীত জানতে হয়। দূর অতীতে যেতে বলছিনা, অত কষ্ট করার দরকার নেই, নিকট অতীতটাতেই ঘুরে দেখুন না একবার।
২৪ এপ্রিল, ২০১৩
বাসায় বসে ছিলাম, সংবাদ মাধ্যম মুখরিত হল ইতিহাসের কাল ছোপে, ধ্বসে পড়ল রানা প্লাজা। আমি আর কয়েকজন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম যাওয়া লাগবে ওখানে যেভাবেই হোক। ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে কিছুই যায় আসে না মৃতপ্রায় মানুষগুলোর। সহায়-সম্বল যা যোগাড় করতে পেরেছিলাম নিয়ে চলে গেলাম সাভার। সাভার ঢুকার আগেই থমকে দাঁড়াতে হল। পচা মাংসের উৎকট গন্ধ ভাসছে বাতাসে। এক বন্ধু বুদ্ধি করে আগে থেকেই মাস্ক নিয়ে এসেছিল, পড়ে নিলাম। সরাসরি চলে গেলাম এনাম মেডিক্যাল কলেজের দোরগোড়ায়। পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারছিলাম না। এ কেমন বাতাস, মানুষের হুড়াহুড়িতে সাক্ষাৎ নরক দেখলাম চোখের সামনে। এক বড় ভাইয়ের স্ত্রী এনাম মেডিক্যাল কলেজে কর্মরত ডাক্তার। কটকটে লাল চোখ নিয়ে নরকের দ্বারপ্রান্তে স্বাগত জানালেন তিনি। আমরা হতবিহবল, “কি করব?”
তারপর যা হল আর বিস্তারিত লিখতে চাইনা, রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপের সামনে দাঁড়িয়ে মহাকালের বহুমাত্রিক শূলে বিদ্ধ হতে লাগলাম একের পর এক। নাকে আর গন্ধ লাগছিল না; আক্ষেপ, দুঃখের এক মহাজাগতিক সমীকরণ বুকে নিয়ে ঘরে ফিরে এলাম অবশেষে। নাকে ঐ গন্ধ লেগেই থাকল- মরা লাশের গন্ধ। এখনো মাঝে মাঝে লাগে ওই তীব্র গন্ধ। সবকিছু ভুলতে নেই। আমি ভুলতেও চাইনা। সেদিনের ঐ মাস্ক এখনও রেখে দিয়েছি। মাঝে মাঝে বের করে দেখি। পৈশাচিক সত্যের গাঢ় সাক্ষী হয়ে ওটা জাতীয় সত্যের অবিরত জানান দেয়, প্রশ্নবিদ্ধ করে আমাকে- "মানুষ?"
জানতাম, সবাই ভুলে যাবে। তবুও আমরা একটা তহবিল গঠনের চেষ্টা করি। যারা পরলোকগত হয়েছেন, তাদেরকে নিয়ে ভেবে কোন সমাধা হবেনা, তবে যারা এখনো আছেন , ঐ ১২০০ লাশের পরিবারকে দু’মুঠো অন্ন জুগানোর কথা ভেবেছিলাম। দুই একদিন সাড়াও পেয়েছিলাম বেশ। তারপর ধীরে ধীরে ঢিমাতালে হারিয়ে গেল ঐ অতল গহবরে যেখানে হারিয়ে যায় এ জাতির সব বিপর্যয়, যেখানে হারিয়ে যায় হলমার্ক কেলেঙ্কারী, যেখানে হারিয়ে যায় শেয়ার বাজারের নিষ্ঠুর পতন, যেখানে হারিয়ে যায় তাজরীন ফ্যাশনের গগনবিদারী আর্তনাদ।
আমরাও আর উদগ্রীব হলাম না। কী হবে এগুলা করে? গুলশান এলাকা দিয়ে চলুন যাতায়াত করি একদিন। রাজকীয় গাড়িবহরে কিছু সত্য খুঁজে বেড়াই। রাজকীয় একেকটা গাড়ির দামে ঐ ১২০০ পরিবারের ১ মাসের থাকা খাওয়া দিব্যি চলে যায়। তবে উনারা ঐ ১২০০ মানুষকে নিয়ে চিন্তিত নন। নিজের জন্য, সন্তানের জন্য, বৌ-এর জন্য চাই আলাদা আলাদা গাড়ি। ভোগ্যতার ইতিহাসের নগ্নসাক্ষী এদেশের একেকজন বুর্জোয়া শুয়োর-সন্তান সেদিন কিছুই করেননি। সব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রদের জমানো টাকায় এসেছিল ঔষুধ, নিজের শরীরের রক্তে থলী ভরেছিল সাধারন মানুষ।
যাই হোক, মরা ঘটনাকে গলা টিপে আরো গন্ধ বানাতে চাই না। প্রতিশ্রুতির বাজারে মিথ্যা হলেও আশা করেছিলাম রানা প্লাজায় মৃত শ্রমিক ভাইদের কথা আসবে, আসবে তাদের পরিবার-পরিজনদের কথা। আসেনি, কষ্ট লাগল। তাই আজাইরা বিলাপ করলাম। এতক্ষণ অবধি কষ্ট করে যারা পরেছেন, ধন্যবাদ।
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=
©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!
একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন
অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪
চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন
আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?
ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম
যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।