প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অকপটে সত্য বলেন। এ কারণে তাঁকে প্রগলভ মনে হয় অনেকের। কিছু কিছু সমালোচক আছেন যারা মুখে কুলুপ আঁটা খালেদার শিষ্য। এরা সত্য শুনতে চায় না, সত্যের জায়গায় নিজের কুৎসিত চেহারা দেখার ভয়ে শেখ হাসিনাকে শত্রু মনে করে। এই যে দেখুন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য কেমন সত্য হয়ে উঠল। মাত্র ক’দিন আগে তিনি বলেছেন, ইয়াহিয়ার প্রেতাত্মারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। পা চাটা চামচাদের কথাও বলেছিলেন তিনি। সপ্তাহ না ঘুরতেই মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগের সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী দেশের একজন পরিচিত সেনানীর কণ্ঠে ভিন্ন সুর। গোড়াতে বলে রাখি, একে খন্দকার আমার চোখে একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। বেশ কয়েক বছর আগে বিজয় দিবসের দিনে লন্ডনের এক হাসপাতালে শয্যাশায়ী অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক মেলবোর্ন এজ পত্রিকার সাবেক সম্পাদক ব্লুস উইলসনের সঙ্গে কথা হয়েছিল। তাঁর সে সাক্ষাতকারটি জনকণ্ঠে ছাপা হয়েছিল গুরুত্ব সহকারে। ব্লুস আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। বিশেষত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আত্মসমর্পণে উপস্থিত থেকে দুনিয়াকে বিজয়ের খবর জানিয়েছিলেন তিনি। বলছিলেন, একে খন্দকার অনেক কিছু জানেন। তিনিই আত্মসমর্পণের সন্ধ্যায় উপস্থিত উপ-সেনাপ্রধান। সে কারণে তো বটেই দেশের নানা সঙ্কট ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির মোকাবেলায় তাঁকে সামনে পেয়েছি আমরা। হঠাৎ এমন কি ঘটল? কেন তাঁর এমন মনে হতে শুরু করল, এই প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরী।
ইতিহাসের সে সুবর্ণ সময়ে আমরা ছিলাম বালক। ফলে মন্তব্য বা কিছু বলাটা আমাদের জন্য অযৌক্তিক। শুধু এটুকু বলতে চাই, এত বছর নীরব ও নিশ্চুপ থাকার পর শেষ বয়সে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রতি এই কটাক্ষ বা সন্দেহজনক প্রবণতা, রহস্য তৈরির চেষ্টা কি তার নিজস্ব? এ ভাবনার কারণ অনেকেই জানেন, দেশের সর্বাধিক প্রচারিত কাগজ ও তাদের মিডিয়া গ্রুপ যেনতেন প্রকারে আওয়ামী বিদ্বেষী। এরা শেখ হাসিনাকে সহ্য করতে পারে না। সবচেয়ে ভয় ও উদ্বেগের বিষয়, এরা সংগ্রাম বা ইনকিলাব না। ওই দুটো বা অমন ধারার মিডিয়াকে সহজে চিহ্নিত করা যায়। কঠিন কিছু নয় তাদের উত্তেজনা বা চক্রান্ত চিহ্নিতকরণ। অন্যদিকে মুখোশ মুখের চেয়ে শক্তিশালী। কৌশলে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের মূল জায়গাটাকে নড়বড়ে করার কাজে লিপ্ত এদের ধরা কঠিন। কারণ এরা তারেক রহমানের ভাষায় কথা বলে না। তারেক বা জিয়াউর রহমানের প্রসঙ্গ উস্কে দিলেও ফায়দা বিএনপিকে দেবে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভেতর অমীমাংসিত দ্বন্দ্বে মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নিজেদের কাজ হাসিলে ব্যস্ত মিডিয়া দুর্গ থেকে প্রকাশিত যে কোন গ্রন্থেই বিতর্ক দেখতে পাচ্ছি আমরা। এই বিতর্কগুলো মুক্তিযুদ্ধ, গণজাগরণ মঞ্চ, ইতিহাস ও প্রগতিশীলতার অর্জনকে কলঙ্কিত করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা হচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রথমবার এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের উপ-সেনাপ্রধান এ কে খন্দকারের গ্রন্থ ১৯৭১ : ভেতরে বাইরে। এর আগেও আমরা তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে এই জাতীয় প্রবণতা তৈরির অপচেষ্টা দেখেছি, যা তাজউদ্দীন পরিবারের মেধা ও অভিজ্ঞতার কারণে কাজে লাগেনি। তাঁদের নিষ্ঠা ও ত্যাগে এখনও আওয়ামী ঐক্য অটুট। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা হয় না, যেমন বই বেরুতে না বেরুতেই এ কে খন্দকারের লেখা নিয়ে জামায়াতীদের ওয়েবসাইট বাঁশের কেল্লা নেমে পড়েছে অপপ্রচারে। অন্যদিকে ঢাকার অতি উৎসাহী ট্যাবলয়েড মানব জমিনে শুরু হয়েছে ধারাবাহিক উদ্ধৃতি আর পাদটীকা, মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান বলছেন, বঙ্গবন্ধু সঠিক নির্দেশ দিলে নাকি পঁচিশে মার্চ ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হতো, আর যুদ্ধে জেতাও কঠিন ছিল না। মতিভ্রমই বটে। পাক সেনারা পূর্ব প্রান্তে সংখ্যায় কম ছিল, মানে পশ্চিম প্রান্ত নীরব থাকত। এক দেশ, এক পতাকার দখল এত সহজে ছেড়ে দিতেন ইয়াহিয়া খান বা ভুট্টো? এতে আরও দশগুণ মানুষ নিহত হতে পারত এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন থাকলেও তা হতে পারত না। আর তাই যদি ঘটত এ কে খন্দকার নিজেও উপ-প্রধান সেনাপতি হতেন না বা এই বইটি লেখারও প্রয়োজন পড়ত না। প্রসঙ্গটি টানলাম এই কারণে কি হত কি হতে পারত, বঙ্গবন্ধু কি করতে পারতেন বা করেননি সেটা তো ইতিহাস নয়, সে বিশ্লেষণ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও দায়িত্ব কর্তব্য বিষয়ে তাঁকে সজাগ করার ধৃষ্টতা আমাদের নেই। কিন্তু কার্ল মার্কসকে ভুলে গেলে চলবে না। এই ভদ্রলোক ভারতবর্ষে আসেননি। বন্ধু এঙ্গেলসকে লিখেছিলেন, ‘আমি বলে দিতে পারি, এখানে চলছে মাৎস্যন্যায়, সুবিধে মতো বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে খায়, অথচ এক পুকুরে বসবাস করে ওরা। তিনি ইতিহাস বিষয়েও নির্মোহ আর তথ্য-উপাত্তে জোর দিয়েছিলেন, সমসাময়িক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুশমন এরা বেনিফিশিয়ারিরা। এরাই আওরঙ্গজেবকে মহান বানায়, দারাশিকোকে তুচ্ছ করে জাতির কপালে দুর্যোগ এনে দেয়।
এই গ্রন্থের পরিণাম বা তর্কের শেষ আমরা হয়ত দেখে যেতে পারব না। কিন্তু যে দৃষ্টিকোণেই হোক তাঁর মতো মহান মুক্তিযোদ্ধা ও বীরের কাছে এই বিতর্ক ছিল অপ্রত্যাশিত। বঙ্গবন্ধুর জয় বাংলা স্লোগান ও স্বাধীনতার ঘোষণা স্পর্শকাতর বিষয় হলেও তাঁর জীবন বা আমাদের ইতিহাসের পরম্পরায় বঙ্গবন্ধুর জন্য নগণ্য, তাঁকে এসব বলে ছোট করা যাবে না। একটি বিশেষ মিডিয়া হাউজের ক্রীড়নকরা কিন্তু এক সময় আর থাকে না, গণরোষে ধিক্কারে অথবা আত্মদহনে একা ও নিঃসঙ্গ হয়ে বিদায় নেয়, সত্যের এটাই ক্ষমতা। তা ছাড়া আওয়ামী লীগে আর কোন নতুন খন্দকারের আর্বিভাবও কাম্য নয়। কলঙ্কিত এক খন্দকারের কারণে আমরা আজ এত তর্কবিতর্কের জালে জড়িয়ে আছি। এ কে খন্দকার সে পথে যাবেন না এই বিশ্বাস আছে আমাদের। তবুও আপাতত যে ক্ষতি সেটাও কিন্তু আকাশে ঝড় অথবা মেঘের পূর্বাভাস।