ইউনিভার্সিটি জীবনে এক সিনিয়র বড়ভাই সেকেন্ড ইয়ারে পড়তেন, আর আমরা ফার্স্ট ইয়ারে। আমরা জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তার মেলামেশা আমাদের সাথেই বেশি ছিল। তাকে আমরা ডাকতাম ‘স্বপনভাই’ বলে। তিনি থাকতেন শেরে বাংলা হলে। তার সার্বক্ষণিক পোশাক ছিল পাজামা-পাঞ্জাবি আর খদ্দরের ভেস্ট। কাঁধে একটা শান্তিনিকেতনী ব্যাগ। ব্যাকব্রাশ করা চুল। লম্বায় প্রায় ছয় ফুট। দেখে যে কেউ ভাববে তিনি সাংস্কৃতিক কর্মী অথবা কোন ছাত্র সংগঠনের নেতা। আসলে তিনি এসবের কিছুই ছিলেন না। তিনি যা ছিলেন তা’ হল ক্লাসে অনিয়মিত, বাজে রেজাল্ট করা একজন চোরা প্রেমিক। তার প্রেম নিবেদনের স্টাইলটা ছিল চোরদের কার্যকলাপের মতো।
সে যুগে সেলফোন ছিল না। তাই চিঠি লেখা অথবা নোটশিটের ভেতর চিরকুট গুঁজে দেয়াই ছিল একমাত্র ভরসা। স্বপনভাই এ কাজটা খুব দক্ষতার সাথে করতে পারতেন। ক্লাস শেষে ছেলেমেয়েরা সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামার সময় তার টার্গেট করা মেয়েটিকে সবার অলক্ষ্যে হাতচিঠি বা দলা পাকানো চিরকুট ছুঁড়ে দিয়ে নিমেষে গায়েব হয়ে যেতেন। লাইব্রেরি বা সেমিনারে বসে পাঠরত কোন মেয়েকে কখন যে চিরকুট গছিয়ে দিয়ে তিনি কেটে পড়তেন কেউ টের পেতো না। তবে এ ধরনের ঢিল ছোঁড়া প্রেম নিবেদনের ক্ষেত্রে সাধারনত যা হয়, স্বপনভাইয়ের ক্ষেত্রেও তাই হতো। তার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হতো।
তবে ব্যর্থতা নিয়ে স্বপনভাইয়ের কোন মনোকষ্ট ছিল বলে মনে হতো না। তিনি নতুন উদ্যমে শুরু করতেন। পুরনো কথা খুব দ্রুত ভুলে যেতেন। তার নিজের ইয়ারে ব্যর্থ হবার পর তিনি আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের প্রতি মনোযোগ দিলেন। তখন থেকেই আমাদের সঙ্গে তার মেলামেশা বেড়ে গেল। ফার্স্ট ইয়ারে আমাদের আট দশ জনের একটা ফাজিল গ্রুপ ছিল। আমরা মাঝে মাঝে ভার্সিটি সংলগ্ন বিনোদপুর বাজারের এক সেলুন থেকে সবাই মাথা ন্যাড়া করে ক্লাসে আসতাম এবং ক্লাসের ব্যাকবেঞ্চে সারি বেঁধে বসতাম। আট দশটি চকচকে ন্যাড়া মাথা দেখে স্যাররা যেমন বিরক্ত হতেন এবং মাঝে মাঝে ওয়ার্নিং দিতেন, তেমনি মেয়েরাও আমাদের দেখে অচ্ছ্যুৎ জ্ঞ্যানে মুখ ফিরিয়ে নিত। এতে অবশ্য আমাদের খুব বেশি কষ্ট হতো না। তবে স্যারদের ওয়ার্নিং এর কারণে কখনো কখনো মাথা ন্যাড়া করা বন্ধ রাখতে হতো। আমাদের আর একটি উল্লেখযোগ্য গুন ছিল এই যে, আমরা ক্লাসের আগে পরে অথবা ফাঁকে ফাঁকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় বসে আড্ডা দিতাম আর আকিকা না দিয়েই মেয়েদের নতুন নতুন মানানসই নাম দিতাম।
কো-এডুকেশন সত্ত্বেও এখনকার মতো তখন মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে একসাথে বসে আড্ডা দিত না। ওই কালচার তখনও গড়ে ওঠেনি। তবে মেয়েদের সঙ্গে ছেলেদের হাই, হ্যালো বা পড়াশুনা, নোট ইত্যাদি নিয়ে দু’চারটা কথাবার্তা হতো। ব্যস, ওই পর্যন্তই।
মাত্র এক বছরের সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও স্বপনভাই মাঝে মধ্যে আমাদের ওপর খবরদারি করার চেষ্টা করতেন। তিনি হঠাৎ হঠাৎ আমাদের মধ্যে চলে আসতেন এবং একজনকে টার্গেট করে বলতেন, ‘তুমি ভীষণ বেয়াদব হয়ে গেছ।’
‘কেন স্বপনভাই, এ কথা বলছেন কেন? আমি কী করেছি?’
‘কী করেছ, জানো না? নায়লাকে ওরকম একটা বাজে নামে ডাকো কেন?’
আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠতাম। আমাদের ক্লাসের নায়লা নামের মেয়েটি ছিল খুবই বেঁটে। তাকে ‘গুটি আমের আঁটি’ নামে ডাকা হতো। সেটা ছিল স্বপনভাইয়ের খুবই অপছন্দ। আর একটি মেয়ে ছিল ভীষণ ফর্সা আর তালঢ্যাঙ্গা লম্বা। তাকে ডাকা হতো ‘টিউব লাইট’ নামে। মেয়েরা স্বপনভাইকে এসব ব্যাপারে কিছু না বললেও তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে আমাদের শাসন করার চেষ্টা করতেন। যদিও আমরা তেমন পাত্তা দিতাম না। আবার আমরা তার দ্বারা শাসিত না হলে তিনিও বিশেষ কিছু মনে করতেন না। তিনি ছিলেন ফার্স্ট ও সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রীদের স্বঘোষিত কেয়ারটেকার। মেয়েরা তার এই কেয়ারটেকিং এবং সেই সুযোগে মেয়েদের প্রতি তার পত্রাঘাতে যথেষ্ট বিরক্ত ছিল। স্বপন ভাইয়ের প্রেম অভিযান ছিল চিঠিপত্র আর ছোট ছোট চিরকুটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কোন মেয়ের সাথে কথা বলতে তাকে কখনো দেখা যায়নি।
তবে একদিন এর ব্যতিক্রম হলো। আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে পারভীনের সঙ্গে স্বপনভাইকে কথা বলতে দেখা গেল। কলা ভবনের পেছনে আমগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তাদের সেই কথাবার্তা আমরা দূর থেকে দেখতে পেলাম। স্বপনভাই ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে কথা শেষ করেই দ্রুত কেটে পড়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু আমাদের জালে ধরা না পড়ে উপায় আছে?
‘কী ব্যাপার স্বপনভাই? হাই ব্লাড প্রেশারের সাথে কী কথা হলো?’
‘হাই ব্লাড প্রেশার? পারভীনকে তোমরা এই নামে ডাকো নাকি? ছি, ছি, তোমরা কী নোংরা!’
‘আচ্ছা বেশ, আমরা নোংরাই হলাম। আপনি তো পরিস্কার। এখন বলেন, কী কথা হলো?’
স্বপনভাই কিছুতেই বলবেন না। আমরাও কাঁঠালের আঠা। না শুনে ছাড়বো না। শেষে অনেক জোরাজুরির পর তিনি লুকোছাপা করে যেটুকু বললেন তা’ হলো, লাইব্রেরি থেকে পারভীন দুটো বই ইস্যু করেছিল। তার একটার ভেতর স্বপনভাই কৌশলে একটা চিঠি চালান করে দিয়েছিলেন। চিঠিটা ছিল বেনামী। পারভীন তবুও বুঝে ফেলে কাজটা কার। সেই চিঠি সে আজ স্বপনভাইকে ফেরত দিয়ে বলে, ‘চিঠিটা পড়ে দিন।’
স্বপনভাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলেন, ‘কেন, কেন, চিঠি পড়ে দেব কেন? কার চিঠি?’
‘আপনার চিঠি। অত্যন্ত জঘন্য হাতের লেখা। অনেক চেষ্টা করেও কিছু বুঝতে পারিনি। তাই আপনার কাছে নিয়ে এলাম। পড়ে দিন।’
‘আচ্ছা, তোমরাই বলো এটা কী কখনো সম্ভব?’ আমাদের উদ্দেশ্য স্বপনভাইয়ের অসহায় প্রশ্ন। আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে বললাম, ‘মোটেই না। আপনার দ্বারা এমন নোংরা কাজ হতেই পারে না। এখন বলেন তারপর কী হলো?’
‘তারপর আর কী? আমাকে আজেবাজে কথা বলল আর চিঠিটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দিল।’
‘আপনার মুখের ওপর?’
‘না, না, ঠিক মুখের ওপর না। তবে মেয়েটির খুব রাগ। ওর বোধহয় সত্যিই ব্লাড প্রেশার আছে, তাই না?’
‘এই তো স্বপনভাই, এবার বুঝতে পারছেন তো কেন আমরা ওকে হাই ব্লাড প্রেশার বলি?’
‘মেয়েটা সিনিয়রদের সম্মান দিতে জানে না। সত্যি দুনিয়াটা বদলে গেছে। বড়দের প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা সব গেছে!’ দুঃখিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেলেন স্বপনভাই।
এই ঘটনার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ক্যাম্পাসে স্বপনভাইয়ের নামের আগে ‘লাভ লেটার’ শব্দটা যোগ হলো। অর্থাৎ তার প্রসঙ্গ উঠলে সবাই বলতো, ‘ও আচ্ছা, লাভ লেটার স্বপন ভাইয়ের কথা বলছো?’
***
এই লেখাটি মাসিক মৌচাকে ঢিল পত্রিকার মে, ২০১০ (বৈশাখী ভালোবাসা) সংখ্যায় প্রকাশিত। ব্লগার বন্ধুরা যারা এটি পড়েননি, তাদের জন্য ব্লগে প্রকাশ করলাম। লেখাটিতে তারুন্যের চপলতাজনিত আচরণের ত্রুটি বিচ্যুতি থাকায় পাঠককে সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই পড়ার জন্য অনুরোধ করছি। ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ৮:১১