somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রসরচনাঃ সবার আগে

১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ৮:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যে উপজেলায় আসগর সাহেবের বদলি অর্ডার হলো সেখানে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে অফিস করা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো দূরপাল্লার এক্সপ্রেস বাসগুলো ওই উপজেলা হয়ে যায়না। ফলে লক্কর ঝক্কর লোকাল বাসই ভরসা। কিছু চাকরিজীবী লোক ওই বাসেই যাতায়াত করে। এতে সাহস পেয়ে টিফিন ক্যারিয়ারে দুপুরের খাবার নিয়ে প্রথম দিন আসগর সাহেব যে লোকাল বাসটিতে উঠে পড়লেন, তার নাম ‘সবার আগে’। চমৎকার বাংলা নাম। তবে বাসের গায়ে লেখা এই বাংলা নামের নিচে ভুল ভাল ইংরেজি বানানে লেখা আছে ননস্টপ, গেট লক ইত্যাদি। বাসের ছাদে আলু ও শুকনা মরিচের বস্তা ছাড়াও গোটা কয় ছাগল, মুরগির খাঁচা আর পুরাতন কাপড়ের গাঁটটি। লুঙ্গি পরা কিছু দেহাতি লোকজন গম্ভীর মুখে বাসের ছাদে বসে ভুস ভুস করে বিড়ি টানছে। বাসের ছাদে ক্যারিয়ারের ফ্রেমের সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে দুটো সাইকেল ঝোলানো। ছত্রিশ সিটের বাসে অন্তত সত্তর জন আদম সন্তান। ভেতরে ঠাসা ঠাসি অবস্থা। বাসের দুই দরজার হ্যান্ডেল ধরে ডারউইনের বিবর্তন তত্বের সমর্থনে ঝোলাঝুলি করছে মানুষ। আসগর সাহেবের চেহারাটা বাঁদরের চেয়ে উন্নত মনে হওয়ায় বাসের হেল্পার ছেলেটি দয়াপরবশ হয়ে তাঁকে ধাক্কাধাক্কি করে ঢুকিয়ে দিল ভেতরে। কিন্তু যেই লাউ, সেই কদু। একহাতে টিফিন ক্যারিয়ার আর একহাতে মাথার ওপর লোহার পাইপ ধরে আসগর সাহেবের অবস্থা হল সেই ঝুলে থাকার মতোই। চারপাশে ঘামের উৎকট গন্ধ আর নারী পুরুষ বাচ্চাকাচ্চার হাউ কাউ।
বাস ছাড়ার পর শুরু হল কন্ডাক্টারের সাথে যাত্রীদের ভাড়া নিয়ে ঝগড়া। সব যাত্রীর এক কথা, কন্ডাক্টার ভাড়া বেশি নিচ্ছে। কন্ডাক্টারেরও এক কথা, না পোষালে গাড়ি থেকে নেমে যান।
‘গাড়ি থাইক্যা নামুম কিল্লাই? গাড়ি কি তোমার বাপের?’
‘গাড়ি আমার বাপের না হইলে এত ট্যাকার গাড়ি আমগো হাতে ছাইড়া দিয়া মহাজন আব্বা বাড়িত্ ঘুম পাড়ে ক্যামনে? প্যাচাল না পাইরা জলদি ভাড়া বাইর করেন।’
এক গ্রাম্য মহিলার কোলে পাঁচ ছয় বছরের একটি ছেলে। তার কথা, এত ছোট বাচ্চার আবার ভাড়া কিসের? কন্ডাক্টারের সাফ কথা, ‘দাঁত উঠলেই ভাড়া দেওন লাগবো। পোলার দাঁত উঠছে কি না দেখান।’
‘আরে ব্যাডা কয় কি? পোলা তো আমার কোলে বইয়া যাইতাছে। অর লাইগ্যা তো কোন সিট লই নাই।’
‘বহুত প্যাচাল পারতাছেন খালা। এতগুলা লোক খাড়াইয়া যাইতাছে। অগো ভাড়া নিয়া কোন ভ্যাজাল নাই। আর আপনার পোলা কোলে বইয়া ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া যাইতাছে, হ্যার ভাড়া দিবেন না? প্যাচাল রাখেন, ভাড়া দ্যান। ’
বাজারের মতো একটা জায়গায় এসে বাস থামতেই কমপক্ষে এক ডজন লোক ঝাঁপিয়ে পড়লো বাসের ওপর। কিছু লোক তর তর করে উঠে গেল বাসের ছাদে। একজন মাথামোটা বামন লোককে চ্যাংদোলা করে তুলে গাড়ির জানালা দিয়ে ভেতরে গলিয়ে দিল তার সঙ্গীরা। বাঁকিরা মোষের মতো গুঁতোগুঁতি করে বাসের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লো ভেতরে। পায়ে আঘাত পেয়ে ককিয়ে উঠলো একজন। এক বৃদ্ধের প্রতি করুনাবশতঃ হেল্পার ছোকরা টানাটানি করে তাকে বাসে তুলতে গিয়ে ব্যর্থ হল। তবে বৃদ্ধের দুর্বল জামা থেকে বুক পকেটটা খুলে থেকে গেল তার হাতে। বৃদ্ধের হৈ চৈ এর মধ্যেই রওনা হয়ে গেল গাড়ি। হেল্পার ছোকরা পকেটটা দলা পাকিয়ে বৃদ্ধের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিয়ে মন্তব্য করলো, ‘বুইড়া ননসেন্’
বাসের সামনের দিকে এক দম্পতি তাদের দশ বার বছরের ছেলে সাথে নিয়ে বসেছিলেন। লোকজনের ভিড়, বাসের ধীরগতি আর ঘন ঘন বাস থামানো নিয়ে স্বামী স্ত্রী দুজনেরই এন্তার অভিযোগ। একটানা বক বক করছিলেন তারা। এক পর্যায়ে ওয়াক ওয়াক করে বমি করে ফেললেন ভদ্রমহিলা। তার দেখাদেখি ছেলেটিও। বাসের মেঝে বমিতে সয়লাব। যাত্রীদের জুতা স্যান্ডেল মাখামাখি। কারো কারো কাপড় চোপড়ে বমি থেকে ছিটকে আসা সাদা ভাত। এবার অভিযোগ শুরু করলো যাত্রীরা, ‘এইডা কি করলেন আফা?’ স্বামী ভদ্রলোক চরম বিব্রত। তিনি অত্যন্ত বিরক্তির সাথে বললেন, ‘এই জন্য তোমাদের নিয়ে কোথাও যাইনা। মান সম্মান থাকেনা। ছিঃ।’ বলতে বলতে ভদ্রলোক নিজেই অতি দ্রুত বাসের জানালা দিয়ে মাথা বের করে বিচিত্র শব্দে বমি করে ফেললেন। চলন্ত গাড়ির বিপরীতমুখী বাতাসের তোড়ে সেই বমির অধিকাংশ গিয়ে পড়লো বাসের পেছন দিকের দরজায় হনুমানের মতো ঝুলে থাকা যাত্রীদের মুখে। সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো তারা, ‘এ্যাই ড্রাইভার, গাড়ি থামাও, গাড়ি থামাও।’
হতচকিত ড্রাইভার কড়া ব্রেক কষে গাড়ি থামাতেই ঘটলো আরেক ঘটনা। বাসের পেছন দিকে টানা পাঁচ সিটের মাঝামাঝি গুটি সুটি মেরে বসে ছিল কলেজ পড়ুয়া দুটি গ্রাম্য মেয়ে। বাসের হৈ হট্টগোলের মধ্যেই মোবাইল ফোনে নিম্নস্বরে তারা কথা বলছিল আর নিজেদের মধ্যে হেলেদুলে হাসাহাসি করছিল। তাদের একেবারে সামনে লোহার পাইপ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন টাক মাথার বেঁটেখাটো গড়নের এক মাঝ বয়সী ভদ্রলোক। কড়া ব্রেকের ফলে নিজেকে সামলাতে না পেরে তিনি ছিটকে গিয়ে বসে পড়লেন একটি মেয়ের কোলে। সাথে সাথে ‘ঠাশ্’ করে একটা চড়ের আওয়াজ শোনা গেল। মেয়েটি বলল, ‘অসভ্য!’ তার সঙ্গী মেয়েটি বলল, ‘ইতর কোথাকার!’
ভদ্রলোকের হাতে ছিল ঠোঙ্গা ভর্তি ডালের বড়ি। ঠোঙ্গাটা হাত থেকে ছিটকে পড়ে বড়িগুলো ছড়িয়ে গেছে বাসের মেঝেতে। ভদ্রলোক লোকজনের পায়ের ফাঁকে হামাগুড়ি দিয়ে বড়িগুলো কুড়াতে লাগলেন।
এই ঘটনার কিছুক্ষণ পর আবার থেমে গেল গাড়ি। একজন যাত্রী খুব দ্রুত ছাতা হাতে নেমে গেল বাস থেকে। কিন্তু বাস আর ছাড়ে না। রাস্তার দুপাশে জনবসতিহীন বিল এলাকা। এখানে বাসটা থেমে আছে কেন কে জানে! যাত্রীরা অধৈর্য হয়ে হৈ চৈ শুরু করলো, ‘এ্যাই ড্রাইভার, গাড়ি ছাড়ো।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা। জগদ্দল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে ‘সবার আগে’। বাসের সামনের দিকে কন্ডাক্টারের সাথে কিছু যাত্রীর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শোনা গেল।
‘আরে ভাই, মানুষের বিপদ আপদ আছে না!’
‘ওই মিয়া, কিয়ের বিপদ?’
‘তাকাইয়া দ্যাখেন। প্যাটে নিম্নচাপ লইয়া বহুতক্ষন ধইরা কষ্টে ছিল বেচারা। অহন কি আরামে ডাউন দিতাছে, দ্যাখেন।’
সত্যিই তাই। বাসের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখা গেল বিলের মধ্যে ছাতা ফুটিয়ে মাটিতে রেখে লোকটা তার আড়ালে বসে পেটের নিম্নচাপ থেকে খালাস হচ্ছে।
বিলে পানি প্রায় নেই বললেই চলে। এ কাজের জন্য মোটামুটি উপযুক্ত জায়গাই পেয়েছে সে। এদিকে যাত্রীদের ক্রমাগত হৈ চৈ এর ফলে বিরক্ত হয়ে কন্ডাক্টার জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে হাঁক দিল, ‘ওই মিয়া, আর দেরি কইরেন না। কিছু থাকলে বাড়িত্ গিয়া ডেলিভারি দিয়েন। আইয়েন, আইয়েন, জলদি আইয়েন।’
লোকটি সম্ভবতঃ ডেলিভারি সমাপ্ত করেই বিলের অপর্যাপ্ত ঘোলা পানিতে ফিনিশিং দিয়ে লজ্জা লজ্জা মুখে বাসে ফিরে এলো এবং বাস ছেড়ে দিল। আসগর সাহেব মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন আর লোকাল বাস নয়। প্রয়োজনে প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোণ নিয়ে হলেও তিনি একটা মোটর সাইকেল কিনবেন।

[লেখাটি মাসিক উত্তর বার্তা পত্রিকার নভেম্বর/ ২০১০ সংখ্যায় প্রকাশিত। ব্লগার বন্ধুরা যারা পড়েননি, তাদের জন্য ব্লগে প্রকাশ করলাম।]
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×