somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ নরক থেকে ফেরা

১৯ শে জুন, ২০১৭ রাত ৯:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এটি একটি শোনা কাহিনী। আমি নিজেই বিশ্বাস করিনি। তাই অন্যদের বিশ্বাস করানো প্রায় অসম্ভব। তবে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস থেকে নয়, মহামতি সেকশপিয়রের অমর বানী ‘দেয়ার আর মেনি থিংস ইন হেভেন এ্যান্ড আর্থ.........’ স্মরণ করে কাহিনীটি লিখে ফেললাম। আশা করি, আমার মতো আপনারাও বিশ্বাস করবেন না।

আমাদের এই শহরে ‘ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড সার্ভে ইন্সটিটিউট’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে (রুয়েট নয়)। জমি জমা জরীপ এবং হাল্কা প্রকৌশল বিষয়ে শিক্ষা দানের জন্য সরকারি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ব্রিটিশ আমলে ১৮৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত। আমি যে সময়ের কথা বলছি, সেটি সম্ভবতঃ ১৯৬৯ সালের ঘটনা। কাশেম নামে একটি গ্রাম্য ছেলে এই প্রতিষ্ঠানের হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করতো। তখন এই বিষয়ে মেয়েরা পড়তো না। তাই ইন্সটিটিউটের ক্যাম্পাসে ছেলেদের জন্য একটিই দোতলা হোস্টেল ছিল। কাশেম থাকতো হোস্টেলের দোতলায় ২২ নম্বর রুমে।

কোন এক ইয়ারে ফেল করে ছেলেটি আত্মহত্যা করে। বেলা এগারোটার দিকে রুমমেটরা যখন ক্লাসে, তখন সবার অলক্ষ্যে হোস্টেল রুমের সিলিং ফ্যানের সাথে দড়ি ঝুলিয়ে সে গলায় ফাঁস নেয়। তার মৃতদেহ নামানোর পর থানায় মামলা, পোস্ট মর্টেম ইত্যাদি নানা ঝামেলা শেষে লাশ পাঠিয়ে দেওয়া হয় গ্রামের বাড়ি বাগমারা থানার ভবানীগঞ্জে। কিন্তু সেখানে মসজিদের ইমাম বা মৌলবি মৌলানারা কেউ কাশেমের জানাজা পড়াতে রাজি না হওয়ায় তার দরিদ্র কৃষক পিতা উপায়ন্তর না দেখে জানাজা ছাড়াই ছেলের লাশ দাফন করে দেয়। আত্মহত্যাকারী নিশ্চিত দোজখে যাবে। এমন মানুষের জানাজা পড়াবে কে?

ঘটনা শুরু হয় এর এক সপ্তাহ পর। ইন্সটিটিউটের ছাত্ররা একদিন এক ক্লাস থেকে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বেরিয়ে দিক বিদিক ছুটাছুটি শুরু করে। অন্যান্য ক্লাসের ছাত্র ও শিক্ষকরাসহ পথচারী লোকজন জড়ো হয়ে যায়। আতংকিত ছাত্রদের কাছে জিজ্ঞেস করে জানা যায় যে, ক্লাস চলার এক পর্যায়ে শিক্ষক অলোকনাথ সরকার হঠাৎ ক্লাসের পেছন দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। ছাত্ররা হতচকিত হয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে, একদম শেষ বেঞ্চে একা বসে আছে কাশেম।

হোস্টেল সুপার রাজ্জাক সাহেবের সিনেমা দেখার খুব নেশা। সাথে পরিবার পরিজন না থাকায় হোস্টেলের নিচ তলায় একটা রুম নিয়ে তিনি থাকেন। আর সুযোগ পেলেই সেকেন্ড শো সিনেমা দেখার জন্য হলে চলে যান। সেদিন সিনেমা দেখে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে ফিরে তিনি দেখলেন, হোস্টেলের দোতলায় সেই ২২ নম্বর রুমে আলো জ্বলছে। ব্যাপার কী? এরকম তো হবার কথা নয়! কাশেমের আত্মহত্যার পর থেকে ২২ নম্বর তো বটেই, পুরো হোস্টেলই প্রায় ফাঁকা। ছেলেরা হোস্টেল ছেড়ে দিয়ে মেসে বা আত্মীয়স্বজনের বাসায় চলে গেছে। তিন চারজন ছাত্র নিরুপায় হয়ে নিচ তলায় হোস্টেল সুপারের কামরা সংলগ্ন একটি রুমে ভয়ে ভয়ে থাকে। অন্যান্য সব রুম তালাবদ্ধ। তাহলে ২২ নম্বর রুম খুললো কে?

রাজ্জাক সাহেব সাহসী মানুষ। তিনি দারোয়ান আদম আলির নাম ধরে উচ্চস্বরে ডাক দিলেন। ঘটনার পর থেকে আদম আলি হোস্টেলের গেটে ডিউটি করতে চায় না। সে একটু দূরে দূরে থেকে পাহারা দেয়। রাজ্জাক সাহেবের ডাকে টর্চ লাইট জ্বেলে হাজির হলো সে। বললো, ‘আমাকে ডাকছেন,স্যার?’ রাজ্জাক সাহেব হোস্টেলের দোতলার দিকে নির্দেশ করে বললেন, ‘বাইশ নম্বর রুমের কোন ছাত্র ফিরেছে নাকি? ওই রুমে লাইট জ্বলছে কেন?’
আদম আলি সেদিকে তাকিয়ে ঘাবড়ে গেল। ২২ নম্বর রুমের খোলা দরজা দিয়ে লাইটের আলো এসে পড়েছে বাইরে। অথচ আজ হোস্টেলের কোন ছাত্রই ফিরে আসেনি। এলে তো আদম আলির কাছ থেকে তাকে রুমের চাবি নিতে হতো। সে আতংকিত স্বরে বললো, ‘না স্যার, কোন ছাত্র তো আসেনি!’
রাজ্জাক সাহেব আদম আলির কাছ থেকে টর্চ লাইট নিয়ে ওকে সাথে আসার জন্য ইঙ্গিত করে হোস্টেলের সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতলায় উঠে গেলেন। সারি সারি সব রুম তালাবদ্ধ। বারান্দায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। ছাত্ররা কেউ না থাকায় বারান্দার আলো জ্বালানো হয়না। অথচ ২২ নম্বর রুমের দরজা খোলা এবং সে রুমে আলো জ্বলছে। আশ্চর্য!

রাজ্জাক সাহেব কুসংস্কারমুক্ত আধুনিকমনা মানুষ। তিনি টর্চের আলো জ্বেলে বারান্দা দিয়ে হেঁটে ২২ নম্বর রুমের সামনে এসে দাঁড়ালেন। খোলা দরজা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, রুমের ভেতর একটি টেবিলের সামনে পেছন ফিরে বসে একজন ছাত্র উচ্চস্বরে পড়া মুখস্থ করছে। তিনি একটু থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে? কে পড়ছে এই রুমে?’
সাথে সাথে বিদ্যুৎ চলে গেল এবং পড়া মুখস্থের শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। রাজ্জাক সাহেব শক্ত মানুষ। প্রথমে একটু চমকে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে টর্চের আলো ফেললেন সামনে। কিন্তু অবাক কাণ্ড! ২২ নম্বর রুমের দরজা বন্ধ, এক মুহূর্ত আগেও যা’ খোলা ছিল। এখন বন্ধ দরজায় দু’ দুটো তালা ঝুলছে। রাজ্জাক সাহেবের মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে গেল। এই প্রথম ভয় পেলেন তিনি। তাঁর হাত থেকে টর্চ লাইট পড়ে গেল। অনেকটা দৌড়ের মতো করে দোতলা থেকে নামতে গিয়ে সিঁড়িতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তিনি জ্ঞান হারালেন।

পরদিন বিকেলবেলা ক্লাস শেষে ইন্সটিটিউটের প্রিন্সিপাল রুমে শিক্ষকদের জরুরী মিটিং ডাকা হয়েছে। ষোল জন শিক্ষকের মধ্যে দু’জন নেই। অলোকবাবু ছুটিতে এবং রাজ্জাক সাহেব হাসপাতালে। মিটিংয়ে শিক্ষকরা যে যার মতো করে বক্তব্য দিলেন। কিন্তু প্রায় তিন ঘণ্টা আলোচনা করেও কোন সিদ্ধান্তে আসা গেল না। প্রিন্সিপাল সাহেব এসব ঘটনা বিশ্বাস করতেই রাজি নন। ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন করার জন্য কয়েকজন শিক্ষকের দাবীকে তিনি হেসে উড়িয়ে দিলেন। তাঁর যুক্তি হলো, তিনিও তো ক্যাম্পাসের ভেতর কোয়ার্টারে থাকেন। কিন্তু তাঁর সাথে তো এসব কিছু ঘটছে না! তাহলে কী দু’জন দায়িত্বশীল শিক্ষক ও এতগুলো ছাত্র সবাই মিথ্যে কথা বলছে? এ প্রশ্নেরও কোন সদুত্তর নেই তাঁর কাছে। কোন রকম সিদ্ধান্ত ছাড়াই রাত আটটার দিকে মিটিং শেষ হলো।

শিক্ষকরা চলে গেলে প্রিন্সিপাল সাহেব অফিস পিওন সোহরাবকে দিয়ে দারোয়ান আদম আলিকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘আচ্ছা আদম আলি, গত রাতে ঠিক কী হয়েছিল বলো তো?’
আদম আলির চোখে মুখে ভয়। সে বললো, ‘স্যার, সুপার সাহেব আমার টর্চ লাইট নিয়ে হোস্টেলের দোতলায় চলে যান। কিন্তু আমি তার সাথে যাইনি স্যার। বাইশ নম্বর রুমে লাইট জ্বলছিল এবং দরজা খোলা ছিল। সেখানে কি হয়েছিল আমি জানিনা স্যার।’
ঠিক এই সময় প্রিন্সিপালের অফিস রুমের বাইরে থেকে কে যেন ভারি গলায় বলে উঠলো, ‘আমি জানি, স্যার।’
‘হু ইজ দেয়ার?’ প্রিন্সিপাল সাহেব আদম আলি ও সোহরাবকে বললেন, ‘এই, দেখো তো বাইরে কে?’
ওরা বাইরে গিয়ে দেখলো, কেউ নেই। ওদের পিছে পিছে প্রিন্সিপাল সাহেব নিজেও বেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু আশে পাশে কাউকে না দেখে তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থেকে তিনি সোহরাবকে বললেন, ‘অফিস বন্ধ করো। আর শোন, তোমরা দু’জন আমাকে একটু কোয়ার্টারে পৌঁছে দাও তো!’
*******************************************************************************************************************
ছবিঃ নেট
রি-পোস্ট।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুন, ২০১৭ রাত ৯:১৮
৩৮টি মন্তব্য ৩৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×