somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতিচারণঃ একজন উত্তমকুমারের বন্ধু

১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সকাল ১১:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বাংলায় ‘দৃষ্টিবিভ্রম’ বলে একটা শব্দ আছে। ইংরেজিতে যাকে বলে Illusion বা Hallucination. সাধারণত ধু ধু মরুভূমি বা কূলকিনারাহীন বিস্তীর্ণ সমুদ্রে মানুষের দৃষ্টিবিভ্রম হয়। যার এই সমস্যা হয়, সে কিন্তু বুঝতে পারেনা। মনে করে সে যা দেখছে, তা’ সত্যি। কাছাকাছি যাওয়ার পর তার ভুল ভাঙ্গে। এই কারণে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি না থাকলে মরুভূমি ও সাগরে পথ হারিয়ে ফেলা খুবই স্বাভাবিক।

কিন্তু শহরের রাস্তাঘাটে, বাড়িঘরে বা দোকানপাটে এ ধরণের দৃষ্টিবিভ্রম ঘটা অস্বাভাবিক। তারপরেও কখনো কখনো আমাদের অনেকের ক্ষেত্রে এমনটি হয়। যেমন মজিবর ভাইয়ের কথাই ধরুন। তিনি বয়সে আমার চেয়ে সাত আট বছরের বড়। আমার বড়ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, দৃষ্টিবিভ্রম মজিবর ভাইয়ের আজন্ম সমস্যা। তিনি যে চোখে কম দেখেন, তা’ নয়। ভালো করে লক্ষ্য করেন না বলে প্রায়ই তিনি ভুল দেখেন। আমার বড়ভাইয়ের মতো দেখতে কোন লোক হয়তো রেস্টুরেন্টে বসে চা খাচ্ছে। মজিবর ভাই রেস্টুরেন্টের সামনে দিয়ে যাবার সময় তাঁকে দেখে ফেললেন। ব্যস্, পা টিপে টিপে রেস্টুরেন্টে ঢুকে পেছন থেকে লোকটির পিঠে এক রাম থাবড়া মেরে তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘আবে শহীদ, একা একা চা খেতে ভালোই লাগছে, না?’
তারপর লোকটির সামনের চেয়ারে বসে মজিবর ভাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে থতমত খেয়ে গেলেন। লোকটি যে তাঁর বাল্যবন্ধু শহীদ নয় সেটা বুঝতে পেরে তিনি কাঁচুমাচু মুখে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন এবং কোনমতে ‘ভাই, কিছু মনে করবেন না’ বলে তড়িৎ গতিতে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে হাওয়া হয়ে গেলেন।

বাজারের চিপা গলির ভেতর ভাতিজা আলমকে একদিন সিগারেট খেতে দেখে মজিবর ভাই পেছন থেকে তার কান ধরে টান দিতে গিয়ে আর একটু হলেই অপদস্থ হচ্ছিলেন আর কী! শেষ মুহূর্তে ছেলেটি মুখ ফেরানোয় তিনি বেঁচে যান। মজিবর ভাইয়ের এই সমস্যার কারণে তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরাও বিড়ম্বনায় পড়ে। বিয়েবাড়িতে হৈ চৈ ভিড়ভাট্টার মধ্যে মজিবর ভাই তাঁর স্ত্রীর ঘাড়ে হাত দিয়ে হয়তো বিয়েবাড়ির আলোকসজ্জার দিকে স্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। দেখা গেল, যার ঘাড়ে তিনি পেছন থেকে হাত রেখেছেন তিনি তাঁর স্ত্রী নন। তাঁর স্ত্রী হয়তো তাঁর নিজের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। এসব ক্ষেত্রে যা হয়! অচেনা ভদ্রমহিলার হাতে ঠাস্ করে একটা চড় খেয়ে তিনি একশো আশি ডিগ্রী এ্যাঙ্গেলে ঘুরে গিয়ে নিজের স্ত্রীর মুখোমুখি হন। তারপর অচেনা ভদ্রমহিলার কণ্ঠে ভয়াবহ গালি গালাজ, ‘অসভ্য, ইতর, ছোটলোক, শয়তান! রবির আব্বা, এদিকে এসো তো। এই বদমাশ লোকটা আমার গায়ে..................।’ মজিবর ভাই তাঁর স্ত্রীর হাত ধরে পড়িমরি করে ভিড়ের মধ্যে পালিয়ে বাঁচেন।

ছোট মেয়েটি কলেজে পড়ে। উঠতি বয়স। প্রেম ভালোবাসা করবে এটাই স্বাভাবিক। মজিবর ভাই বাড়িতে তাঁর এই মেয়েটির উদ্দেশ্যে ভীষণ তর্জন গর্জন করছেন। কালো মতো বখাটে একটা ছেলের সাথে মেয়েকে দেখা গেছে। ঐ ছেলেকে মজিবর ভাই ভালো করেই চেনেন। মুরুব্বীদের সামনে সে ভুস ভুস করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে। আদব লেহাজ বলে কিছু নেই। এমন বাজে একটা ছেলের সাথে তাঁর মেয়ে............? ভাবা যায় না। ভাবতে গেলে মজিবর ভাইয়ের কান গরম হয়ে যায়।
মেয়ের মা বললেন, ‘তুমি কখন দেখলে?’
‘এই তো ঘণ্টাখানেক আগে। বাজার থেকে ফেরার সময়।’
‘ঝর্ণা তো সকাল থেকে বাড়িতেই আছে। তাকে তুমি বাইরে দেখলে কীভাবে?’
‘কেন, সে আজ কলেজে যায়নি?’
‘কলেজ আজ বন্ধ।’ ঘর থেকে বেরিয়ে ঝর্ণা তার বাবার সামনে দাঁড়িয়ে ডুকরে কেঁদে ফেললো। বললো, ‘শবে মেরাজের ছুটি।’
‘ওহ্ হো! তাহলে বোধ হয় অন্য কেউ হবে।’ ভুল দেখাটা খুবই স্বাভাবিক। তাই মজিবর ভাই নির্বিকার চিত্তে মা ও মেয়ের সামনে থেকে সরে গেলেন।

ছেলে অর্ণবকে সিনেমা হলের সামনে দেখা গেছে। বাড়িতে টেলিভিশনে এত সিনেমা দেখেও ছেলের মন ভরছে না। রিক্সাওয়ালা কুলি কামিনদের সাথে হলে বসে সিনেমা দেখতে হবে কেন? অর্ণব এক ঘণ্টা ধরে ধ্বস্তাধস্তি করেও তার বাবাকে বোঝাতে পারছে না যে, সে হলে সিনেমা দেখতে যায়নি। এই জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা হলে সিনেমা দেখতে যায় না। সিডি, ডিভিডি, পেন ড্রাইভ, ইন্টারনেট এসব থাকতে ছারপোকার কামড় খেতে কেউ হলে যায়? কিন্তু মজিবর ভাই ছেলের সাফাই শুনে সন্তুষ্ট নন। তিনি ছেলের মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘সিনেমার কী জঘন্য নাম! পীরিতি কারে কয়! নাম শুনলেই বমি আসে। কেন বাবা, বাড়িতে বসে ইটিভি জিটিভিতে উত্তম সুচিত্রার সিনেমা দেখা যায় না?’
মজিবর ভাই উত্তম সুচিত্রার খুব ভক্ত। আমার বড়ভাই মারা যাবার পর একদিন তিনি আমাকে বললেন, ‘একজন উত্তমকুমার চলে গেল রে! তোর বড়ভাই দেখতে অবিকল উত্তমকুমারের মতো ছিল।’
আমি বললাম, ‘ভাই, আমার মনে হয় এ জন্যেই আপনার মানুষ চিনতে ভুল হয়। আমার বড়ভাই দেখতে সুশ্রী ছিলেন সেটা ঠিক। কিন্তু উত্তমকুমারের মতো না।’
মজিবর ভাই আমার সাথে তুমুল তর্ক জুড়ে দিলেন। বললেন,‘তুই শহীদের ভাই হতে পারিস। কিন্তু আমার চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠভাবে তাকে দেখিস নি। আমি শহীদের ছোটবেলার বন্ধু। আমার চেয়ে তুই বেশি জানিস?’
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, ‘জি না।’
‘তাহলে চুপ করে থাক।’

পঁয়ষট্টি বছর বয়সে স্ট্রোক করার পর মানুষকে চিনতে ভুল করার এই সমস্যা আরও প্রকট হলো মজিবর ভাইয়ের। ছেলে মেয়ে কাউকেই আর চিনতে পারতেন না। আত্মীয়স্বজন হাসপাতালে তাঁকে দেখতে গেলে তিনি শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। তারপর একদিন তিনি চলে গেলেন তাঁর ছোটবেলার বন্ধু একজন উত্তমকুমারের কাছে। তাঁর দৃষ্টিবিভ্রমের জন্য এখন আর কেউ বিব্রত হয়না। তিনিও যাকে তাকে দেখে সোল্লাসে 'কী রে কেমন আছিস' বলে ভুল করার পর আর বিব্রত হয়ে কেটে পড়েন না।
( সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
**************************************************************************************************************************
রি-পোস্ট
ছবিঃ নেট
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সকাল ১১:৪০
২৫টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটা গাছ কাঠ হলো, কার কী তাতে আসে গেলো!

লিখেছেন নয়ন বড়ুয়া, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:০৬



ছবিঃ একটি ফেসবুক পেইজ থেকে

একটা গাছ আমাকে যতটা আগলে রাখতে চাই, ভালো রাখতে চাই, আমি ততটা সেই গাছের জন্য কিছুই করতে পারিনা...
তাকে কেউ হত্যা করতে চাইলে বাঁধাও দিতে পারিনা...
অথচ... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কালবৈশাখী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৪



গত পরশু এমনটি ঘটেছিল , আজও ঘটলো । ৩৮ / ৩৯ সে, গরমে পুড়ে বিকেলে হটাৎ কালবৈশাখী রুদ্র বেশে হানা দিল । খুশি হলাম বেদম । রূপনগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×