somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মধুবালাঃ দ্যা ভেনাস অফ ইন্ডিয়ান সিনেমা

১৯ শে আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সিনেমার নায়ক নায়িকারা কাল্পনিক প্রেম ভালোবাসার গল্পে অভিনয় করে থাকেন। আমরা দর্শকরা সেসব ছবি দেখে আবেগাপ্লুত হলেও জানি যে, এসব প্রেম ভালোবাসার গল্প সত্যি নয়। কিন্তু আজ এমন একজন নায়িকার কথা বলবো, যার বাস্তব জীবনে ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। বলিউডে ৭০ টি হিন্দী-উর্দু ছবিতে অভিনয় করা সেই নায়িকার নাম মধুবালা, যাকে তার জীবদ্দশায় বলা হতো দ্যা ভেনাস অফ ইন্ডিয়ান সিনেমা।

আসল নাম ছিল মুমতাজ জাহান বেগম দেহলভী। অভিনেত্রী দেবিকা রানী তার ফিল্মি নাম রাখেন মধুবালা। ১৯৩৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি দিল্লীতে তার জন্ম (কাকতালীয়ভাবে দিনটি ছিল ভালবাসা দিবস) এবং মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যু হয়। ভেন্ট্রিকুলার সেপটাল ডিফেক্ট বা হৃদপিণ্ডে ছিদ্র রোগ ছিল তার মৃত্যুর কারণ। তাকে সমাধিস্থ করা হয় মুম্বাইয়ের (তৎকালীন বোম্বাই) সান্তাক্রুজ মুসলিম সিমেট্রিতে।

মধুবালার পিতার নাম ছিল আতাউল্লাহ খান। তারা জাতিতে ছিলেন পশতুভাষী ইউসুফজাই গোত্রভুক্ত পাঠান। ৯ বোন ও ২ ভাইয়ের মধ্যে মধুবালা ছিলেন ব্যতিক্রমী সুন্দরী। খুব ছোটবেলা থেকেই তার সৌন্দর্য ও ভুবন ভুলানো হাসি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। তিনি যখন হাসতেন, তখন মনে হতো যেন চারদিকে ফুল ফুটেছে। একজন জ্যোতিষী (কাশ্মীরিওয়ালা বাবা নামেও পরিচিত) মধুবালার হাত দেখে বলেছিলেন, ‘এই মেয়ের ভবিষ্যৎ হবে খুবই বর্ণাঢ্য ও চাকচিক্যময়। বড় হয়ে সে অনেক সুনাম ও ধন সম্পদ অর্জন করবে। কিন্তু ভঙ্গুর প্রেম ও ভালোবাসাহীন বিবাহের কারণে সে অত্যন্ত অসুখী জীবন যাপন করবে এবং খুব কম বয়সে মারা যাবে।’ কাশ্মীরিওয়ালা বাবার সবগুলো ভবিষ্যতবাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়।

পিতা আতাউল্লাহ খান পেশোয়ারে ইমপেরিয়াল টোব্যাকো কোম্পানিতে চাকরি করতেন। একবার যে কোন কারণে তার চাকরি চলে যায়। সংসারে চরম অভাব অনটন নেমে আসে। ছেলেমেয়েদের মুখে খাবারের জোগান দিতে তিনি হিমশিম খেতে থাকেন। দারিদ্র্যের কষাঘাতে আতাউল্লাহ খান সম্ভবত সাধারণ বোধ বুদ্ধিও হারিয়ে ফেলেন। মধুবালাকে সাথে নিয়ে তিনি বেশ কয়েকবার দিল্লী থেকে মুম্বাইয়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে যাতায়াত করেন এই আশায় যে, যদি তার মেয়ে সৌন্দর্যের কারণে শিশু শিল্পী হিসাবে চলচ্চিত্রে কাজ পায় তাহলে তাদের সংসারের অভাব অনটন দূর হবে। তিন বছর চেষ্টার পর অবশেষে ১৯৪২ সালে ৯ বছর বয়সে ‘বসন্ত’ ছবিতে মধুবালা সত্যি সত্যিই শিশু শিল্পীর চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান। এরপর থেকে তিনি ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ পেতে থাকেন এবং পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনেন। তিনি মাত্র ১২ বছর বয়সে ড্রাইভিং শিখে ফেলেন এবং মনের আনন্দে প্রায়ই লং ড্রাইভে চলে যেতেন।


মধুবালা (১৯৬০ সালে ২৭ বছর বয়সে)

পরিচালক কেদার শর্মাঃ-
এই সময় পরিচালক কেদার শর্মা মধুবালাকে তার ছবিতে নায়িকার কিশোরী বয়সের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দেন। স্ক্রীন টেস্টের সময় মধুবালার অনিন্দ্যসুন্দর চেহারার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি তার প্রেমে পড়ে যান এবং ছবি নির্মাণ শেষ হলে মধুবালার পিতার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেন। আতাউল্লাহ খান এই প্রস্তাবে হতভম্ব হয়ে গেলেও মেয়ের বিয়ের বয়স হয়নি বলে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। তিনি প্রথম থেকেই তার মেয়েকে কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখতেন। ফলে কেদার শর্মার সাথে মধুবালার সম্পর্ক শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে যায়।

পরিচালক কামাল আমরোহীঃ-
কামাল আমরোহী পরিচালিত ‘মহল’ ছবিটি (১৯৪৯) বক্স অফিসে হিট করে। এই ছবিতে মধুবালা ও অশোককুমারের অভিনয় বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়। ছবির শ্যুটিং চলাকালে মধুবালা ও কামাল আমরোহী গভীর প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু মধুবালার পিতা আতাউল্লাহ খান এই সম্পর্কের ব্যাপারে খুব আশংকার মধ্যে ছিলেন। আমরোহী ছিলেন বিবাহিত পুরুষ। তার সাথে মধুবালার বিয়ে হলে তার জীবন যে সুখের হবে না, এটা তার পিতা বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু তিনি আমরোহীর মতো চলচ্চিত্র জগতের তৎকালীন বিশাল ব্যক্তিত্বকে সরাসরি না বলতে পারছিলেন না।
বিষয়টি সমাধানের জন্য শেষ পর্যন্ত মধুবালা নিজেই আমরোহীকে প্রস্তাব দেন প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তাকে বিয়ে করতে। এজন্য এমনকি আমরোহীকে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত দিতে চেয়েছিলেন মধুবালা। কিন্তু আমরোহী ঘৃণাভরে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ‘আমি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আমার কাহিনী, সংলাপ ও মেধা বিক্রি করি, কিন্তু কখনো আমার স্ত্রী, সন্তান ও নিজের বিবেককে বিক্রি করতে পারি না।’
এরপর তাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে যায় এবং তারা আর কখনো একজন আর একজনের সাথে দেখা পর্যন্ত করেননি।

অভিনেতা প্রেমনাথঃ-
নায়ক হিসাবে প্রেমনাথের সাথে মধুবালার প্রথম ছবি ছিল ‘বাদল’ (১৯৫১)। এই ছবির শ্যুটিং চলাকালে মধুবালা একদিন প্রেমপত্রসহ একটি লাল গোলাপ প্রেমনাথের মেক আপ রুমে রেখে আসেন। ভারত সুন্দরীর এই প্রেম নিবেদনে প্রেমনাথ অবাক হয়ে যান এবং তাৎক্ষণিকভাবে তাকে ভালোবেসে ফেলেন। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ তাদের মধ্যে সম্পর্ক চলার পর প্রেমনাথ বুঝতে পারেন যে, মধুবালা তাকে এড়িয়ে চলছেন। মধুবালা কেনই বা তাকে হুট করে প্রেম নিবেদন করেছিলেন আর কেনই বা তাকে এড়িয়ে চলছিলেন, তা’ আজও রহস্য হয়ে আছে। হয়তো প্রেমনাথের ওপর তিনি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেননি। অনেকে বলেন, মধুবালা সেই সময়ের মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় তারকা দিলীপকুমারের প্রেমে পড়েছিলেন। এটা সত্য হলেও হতে পারে। কারণ, পরবর্তীতে মধুবালা সত্যি সত্যিই দিলীপকুমারের প্রেমে পড়েছিলেন এবং তাদের সম্পর্ক তুলনামুলকভাবে বেশি দিন স্থায়ী হয়। ওদিকে অশোককুমারকে জড়িয়ে মধুবালার আর একটি স্ক্যান্ডাল প্রেমনাথকে ক্ষিপ্ত করে তোলে এবং তিনি চিরদিনের মতো মধুবালার সাথে তার সম্পর্ক শেষ করে দেন।


মুঘল-এ-আজম ছবিতে মধুবালা ও দিলীপকুমার

অভিনেতা দিলীপকুমারঃ-
দিলীপকুমারের সাথে মধুবালার প্রেমের সম্পর্ক ছিল নানা উত্থান পতনে ভরা ও নাটকীয়তাপূর্ণ। তাদের সম্পর্ক ছিল কোন রোমান্টিক হিন্দী ছবির স্ক্রিপ্টের মতোই। মধুবালার মতো দিলীপকুমারও (ইউসুফ খান) ছিলেন পাঠান ও মুসলিম। জাত ও ধর্মীয় ঐক্যের কারণে তাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ ইতিবাচক হবে বলে সবাই ধারনা করতো। মধুবালার বয়স যখন ছিল মাত্র ১৭ বছর, তখন থেকে দিলীপকুমারের সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। কিন্তু এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে আতাউল্লাহ খান ছিলেন প্রধান বাধা। মধুবালা ছিলেন তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য। তার আয়ের উপরেই পরিবারটি টিকে ছিল। আতাউল্লাহ খান মনে করতেন, দিলীপকুমারের সাথে মধুবালার বিয়ে হয়ে গেলে তার পরিবার মধুবালার আর্থিক সমর্থন থেকে বঞ্চিত হবে এবং তারা আবার দারিদ্র্যের কবলে পড়বে। ঐ সময়ের দিকে মধুবালা চলচ্চিত্রে অভিনয় করে অনেক টাকা পয়সা রোজগার করতে শুরু করেছিলেন। তবে তার আর্থিক ব্যবস্থাপনা ছিল তার পিতার হাতে। বিয়ের পরে সেটা দিলীপকুমারের হাতে চলে যাবে এই ভয় তার সব সময়ই ছিল। ওদিকে দিলীপকুমার কখনোই আতাউল্লাহ খানকে পছন্দ করতেন না এবং মধুবালার ওপর তার সার্বক্ষণিক খবরদারীতে ত্যক্ত বিরক্ত ছিলেন। খান তার কন্যাকে শুধুমাত্র স্টুডিওর সেটে দিলীপকুমারের সাথে অভিনয়ের অনুমতি দিতেন, স্টুডিওর বাইরে আউটডোরে নয়। খানের এরকম অযাচিত ও অযৌক্তিক মনোভাবের কারণে পরিচালক প্রযোজকরাও তার ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। অবশ্য আতাউল্লাহ খানের কঠোর নজরদারি সত্ত্বেও মধুবালা ও দিলীপকুমার সেটের বাইরে গোপনে মেলামেশা করতেন।
যাই হোক, তাদের এই সম্পর্ক কয়েক বছর ধরে অব্যহত ছিল। কিন্তু একটি ঘটনায় তা’ ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। ১৯৫৭ সালে ‘নয়া দৌড়’ ছবির জন্য তারা দু’জনেই প্রযোজক পরিচালক বি, আর, চোপড়ার কাছ থেকে সাইনিং মানি গ্রহন করেছিলেন। এই ছবিতে ভূপালের আউটডোর লোকেশনে ৪০ দিন শ্যুটিং করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আতাউল্লাহ খান মেয়েকে দিলীপকুমারের সাথে আউটডোর শ্যুটিং-এ যেতে দিতে রাজি ছিলেন না। এ নিয়ে অনেক টানা হেঁচড়ার পর বি, আর, চোপড়া তার ছবি থেকে মধুবালাকে বাদ দিয়ে বৈজয়ন্তীমালাকে সাইন করান। তার আগে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত আদালতের বাইরেই এর মীমাংসা হয়। কিন্তু ততদিনে মধুবালা ও দিলীপকুমারের সম্পর্ক তিক্ততার শেষ সীমায় পৌঁছে যায়।
মধুবালা কে, আসিফের ‘মুঘল-এ-আজম’ ছবিতে দিলীপকুমারের বিপরীতে অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। দিলীপকুমারের সাথে প্রায় ব্রেক আপ এবং শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। ‘মুঘল-এ-আজম’ ছবিতে আনারকলি ও শাহজাদা সেলিমের চরিত্রে মধুবালা ও দিলীপকুমারের রোমান্টিক অভিনয় ছবিটিকে সর্বকালের সেরা হিট ছবির মর্যাদা এনে দেয়। কিন্তু বাস্তব জীবনে তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক ছিল খুবই তিক্ততাপূর্ণ। দিলীপকুমার শেষ চেষ্টা হিসাবে মধুবালাকে শর্তযুক্ত বিয়ের প্রস্তাব দেন। তিনি বলেছিলেন, মধুবালা যদি তার পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে, তাহলে তিনি তাকে বিয়ে করবেন। কিন্তু মধুবালা দিলীপকুমারের এই শর্ত মেনে নিতে রাজি হননি। ফলে চিরকালের মতো তাদের দু’জনের সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়।
উল্লেখ্য যে, ‘মুঘল-এ-আজম’ ছবিতে একটি ধ্রুপদী নাচে পারফর্ম করার সময় মধুবালা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। তার হার্টে ছিদ্রজনিত সমস্যার কারণে এরকম হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও তিনি ঐ নাচ সহ পুরো ছবি সম্পূর্ণ করতে পেরেছিলেন। তার শ্রদ্ধাভাজন পরিচালক কে, আসিফকে তিনি ভোগাতে চাননি। ছবির দর্শকরা মোটেই বুঝতে পারেনি যে মধুবালা বাস্তবে কী কঠিন শারীরিক ও মানসিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে ছবির কাজ শেষ করেছিলেন! মধুবালা শুধু সৌন্দর্যের দেবীই ছিলেন না, ছিলেন জাত অভিনেত্রীও বটে।

জুলফিকার আলী ভুট্টোঃ-
হাঁ, আপনি ঠিকই পড়েছেন। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের চিরশত্রু জুলফিকার আলী ভুট্টোর কথাই বলছি। খুব কম মানুষই জানে যে, ১৯৫০ সাল পর্যন্ত জুলফিকার আলী ভুট্টো একই সাথে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশেই বসবাস করতেন। ভুট্টো অত্যন্ত ধনী মানুষ ছিলেন এবং মুম্বাইতে তার প্রচুর ভূ-সম্পত্তি ছিল। মুম্বাইয়ের বান্দ্রায় তার ‘My Nest’ নামে একটি প্রাসাদোপম অট্টালিকা ছিল। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর ভারত সরকার এই প্রাসাদ সহ তার সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে।
আর্থিক সংকট ও নানারকম প্রতিবন্ধকতার কারণে ‘মুঘল-এ-আজম’ ছবিটির শ্যুটিং ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ দশ বছর ধরে করতে হয়েছিল। তখনকার দিনে এই ছবিটি তৈরি করতে ব্যয় হয় ৩ কোটি টাকা। শুধুমাত্র মধুবালাকে দেখার জন্য ভুট্টো স্টুডিওতে গিয়ে ‘মুঘল-এ-আজম’ ছবির সেটে বসে থাকতেন। ধনী ও অভিজাত মানুষ হওয়ায় স্টুডিওতে তার প্রবেশে কেউ বাধা দিত না। মধুবালার সৌন্দর্য ও ভুবনমোহিনী হাসি ভুট্টোকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলে। তিনি মধুবালাকে ভালোবেসে ফেলেন এবং মধুবালাও সুদর্শন ভুট্টোকে পছন্দ করতে শুরু করেন।
ভুট্টো সিনেমা জগতের কেউ ছিলেন না। তিনি ব্যারিস্টার ছিলেন এবং মুম্বাই হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করতেন। আর সময় পেলেই মধুবালাকে দেখার জন্য স্টুডিওর সেটে এসে বসে থাকতেন। তিনি বিবাহিত ছিলেন। তার দুই স্ত্রীর একজন ছিলেন লারকানার একজন ভূ-স্বামীর মেয়ে শিরিন বেগম এবং আর একজন ছিলেন করাচীতে বসবাসকারী ইরানী মেয়ে নুসরাত (সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টোর মা)। ফলে ভুট্টো লারকানা, করাচী ও মুম্বাই এই তিনটি শহরে ঘন ঘন যাতায়াত করতেন। কিন্তু তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খার কারণে তিনি শেষ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিয়ে মুম্বাইয়ের পাট চুকিয়ে দিয়ে চলে যান।
মধুবালা তার জীবনের প্রায় সব ঘটনাই ডায়েরীতে লিখে রাখতেন। ভুট্টো সম্পর্কেও লিখেছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু কী লিখেছিলেন, তা’ জানা যায়নি। কারণ, মধুবালার মৃত্যুর পর তার অতি সতর্ক পিতা আতাউল্লাহ খান মধুবালার লাশের সাথে সাথে ডায়েরীটিকেও সমাধিস্থ করে দেন।


মধুবালা ও কিশোরকুমার

অভিনেতা/গায়ক কিশোরকুমারঃ-
দিলীপকুমারের সাথে ব্রেক আপ হওয়ার কিছুদিন পর শ্রান্ত, ক্লান্ত ও অসুস্থ মধুবালা কিশোরকুমারের আগ্রহে তাকে বিয়ে করেন। কিশোরকুমার এই বিয়ের জন্য ধর্মান্তরিত হয়ে করিম আবদুল নাম গ্রহন করেন। মধুবালার হার্টে জন্ম থেকেই ছিদ্র ছিল, যে কারণে মাঝে মাঝেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তেন। ‘মুঘল-এ-আজম’ ছবির সেটে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে তার হার্টে ছিদ্র থাকার কথা জানা যায়। চিকিৎসার জন্য তিনি লন্ডনেও যান। কিন্তু তখনকার দিনে হৃদরোগের চিকিৎসা সারা পৃথিবীতেই খুব পশ্চাৎপদ অবস্থায় ছিল। ফলে মধুবালা অসুস্থ অবস্থাতেই মুম্বাই ফিরে আসেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, তিনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না। জীবনের বাঁকি দিনগুলোতে একটুখানি ভালোবাসা পাওয়ার আশায় তিনি কিশোরকুমারকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যান। কিন্তু তাদের বিয়ে হলেও দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না।
আসলে কিশোরকুমার মধুবালাকে ভালোবেসে এই বিয়ে করেননি। সেই সময় তিনি দেনার দায়ে জর্জরিত ছিলেন এবং বিশাল অংকের বকেয়া ট্যাক্স পরিশোধের জন্য ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট তার উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। এমনকি তার বাড়িটিও নিলামে উঠার উপক্রম হয়েছিল। মধুবালা আর্থিক সহযোগিতা করে তাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন, এই আশায় তিনি তাকে বিয়ে করেছিলেন।

মধুবালা তার অসুস্থতার কারণে জীবনের শেষ কয়েকটা বছর পুরোপুরি শয্যাশায়ী ছিলেন। দাম্পত্য সুখ কেমন, তা’ কখনো অনুভব করার সৌভাগ্য হয়নি তার। ভালোবাসা পাওয়ার আশায় বার বার হাত বাড়িয়েছেন তিনি, কিন্তু প্রতিবারই শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে তাকে। অবশেষে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিক্ত জীবনের অবসান ঘটিয়ে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তিনি এই দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চলে যান।
প্রকৃতপক্ষে মধুবালা ছিলেন ভালোবাসার কাঙাল। অসংখ্য ছবিতে ভালোবাসার অভিনয় করলেও নিজের বাস্তব জীবনে তিনি কখনো ভালোবাসার নাগাল পাননি। পাঠক মাত্রেই জানেন যে, শুধু বলিউড নয়, পৃথিবীর সকল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে নায়ক নায়িকাদের প্রেম ভালোবাসার স্ক্যান্ডাল অতি সাধারণ বিষয়। কিন্তু মধুবালার ক্ষেত্রে স্ক্যান্ডালকে ছাপিয়ে হাহাকারের আওয়াজই বেশি শোনা যায়।

এবার এমন একজন মানুষের কথা বলে এই প্রবন্ধটি শেষ করবো, মূলতঃ যার জন্যই এই প্রবন্ধটি লেখা। ভদ্রলোকের নাম লতিফ। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার নামের আগে বা পরের পদবী সম্পর্কে আমি কোন তথ্য উদ্ধার করতে পারিনি। তো আসুন, শোনা যাক সেই লতিফের কথা।

লতিফঃ-
লতিফ ছিলেন মধুবালার শৈশবের বন্ধু। তারা দিল্লীতে একই মহল্লার পাশাপাশি দুটি বাড়িতে থাকতেন। তখন তাদের দু’জনের বয়স ছিল মাত্র ৬ বছর। খেলার সাথী হিসাবে লতিফ ও মধুবালা একে অন্যকে পছন্দ করতেন। তবে প্রেম বা ভালোবাসা বলতে যা বুঝায়, সেটা অনুভব করার মতো বয়স তাদের তখনো হয়নি।
মধুবালা যখন তার বাবার হাত ধরে মুম্বাইতে চলে যান, তখন লতিফ মনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। মধুবালাকে হারিয়ে লতিফ একা হয়ে যান এবং শিশু বয়সেই শূন্যতা বোধ করতে থাকেন। মহল্লার অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে খেলতে যেতে তার মন চাইতো না। মুম্বাই যাওয়ার আগে মধুবালা লতিফকে কাগজের তৈরি একটা লাল গোলাপ উপহার দিয়ে যান। লতিফ সেই গোলাপটি অত্যন্ত যত্নসহকারে মধুবালার মৃত্যু পর্যন্ত সংরক্ষণ করেন এবং ৩০ বছর পর মধুবালার মৃত্যু হলে মুম্বাইতে গিয়ে গোলাপটি নিরবে তার সমাধিতে রেখে আসেন। এরপর থেকে তিনি প্রতি বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি (মধুবালার মৃত্যু দিবসে) দিল্লী থেকে মুম্বাই গিয়ে একটি করে লাল গোলাপ মধুবালার সমাধিতে রেখে আসতেন। রিটায়ার্ড আই, এ, এস অফিসার লতিফ ১৯৬৯ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর এইভাবে মধুবালার সমাধিতে লাল গোলাপ রেখে এসেছেন। এই ৩৮ বছরে একবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ২০০৭ সালের পরে লতিফ সাহেব সম্পর্কে অনেক চেষ্টা করেও আর কোন তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তার নামটি ইতিহাসের পাতায় এতই স্বল্পালোচিত (বা বলা যায় অনালোচিত) যে তার সম্পর্কে এখানে উল্লেখিত তথ্যের বাইরে আর কিছু জানা সম্ভব হয়নি। খুব সম্ভবত ২০০৭ সালের পরে তিনিও এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন।


মধুবালার সমাধিতে পৃথ্বীরাজ কাপুর শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন।

মধুবালা তার স্বল্পায়ু জীবনে একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য নিরন্তর হাহাকার করেছেন। পার্থিব জগতের জটিল হিসাব নিকাশ এবং স্বার্থপরতা ও প্রতারণা ভালোবাসার পরিবর্তে কাঁটা হয়ে তাকে ক্ষত বিক্ষত করেছে। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়েই তিনি চলে গেছেন দুনিয়া থেকে। কিন্তু এই দুনিয়াতেই তাকে যে একজন সত্যি সত্যিই নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতেন, সেটা জেনে যাওয়ার সৌভাগ্য তার হয়নি। আফসোস!
******************************************************************************************************************
তথ্যসূত্রঃ
১) উইকিপিডিয়া
২) টেলিভিশন চ্যানেল মাস্তি
ছবিঃ নেট

সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৫৯
৫২টি মন্তব্য ৫২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×