ভিয়েতনাম যুদ্ধ বা দ্বিতীয় ইন্দোচীন যুদ্ধ
ভিয়েতনাম যুদ্ধ বা দ্বিতীয় ইন্দোচীন যুদ্ধ -- ভিয়েতনামীরা অবশ্য এই যুদ্ধকে বলতো আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ বা সংক্ষেপে আমেরিকান যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ভিয়েতনাম ছাড়াও লাওস ও কম্বোডিয়াও জড়িয়ে পরে। ১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর এই যুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সাইগনের পতনের মাধ্যমে এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে এই যুদ্ধ হলেও, উত্তর ভিয়েতনামকে সমর্থন দেয় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, এবং অন্যান কমিউনিস্ট মিত্ররা। অপরদিকে দক্ষিণ ভিয়েতনামকে সমর্থন দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সাউথ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড ও অন্যান কমিউনিস্ট-বিরুধী দেশগুলি। এই যুদ্ধকে স্নায়ু যুদ্ধকালীন প্রক্সি যুদ্ধও বলে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ভিয়েতনাম ছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ। কিন্তু ১৯৪১ সালে জাপান ফ্রান্সের কাছ থেকে ভিয়েতনাম দখল করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা চাচ্ছিলো না ইউরোপীয়ানরা কোথাও কোনো উপনিবেশ স্থাপন করুক । সেই কারণে ভিয়েতনাম আবারো ফ্রান্সের কাছে ফিরে যাক এটা আমেরিকা চায় নাই। কিন্তু ফ্রান্স চাচ্ছিলো তারা আবারো ভিয়েতনাম শাসন করবে। কমিউনিস্ট গেরিলারা ফ্রান্সের এই পদক্ষেপের প্রবল বিরোধিতা করে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্নায়ু-যুদ্ধ বা শীতল-যুদ্ধ (Cold War) শুরু হয়ে গেলে ভিয়েতনামীদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সহানুভূতি কমে যায়। উল্টা ১৯৫০ সালে ফ্রান্স যাতে ভিয়েতনাম শাসন করতে পারে সেই জন্য আমেরিকা ফ্রান্সকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করতে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ফ্রান্স ১৯৫৪ সালে ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট গেরিলাদের কাছে দিয়েম বিয়েন পহুতে পরাজিত হয়। এতে ভিয়েতনাম উত্তর ও দক্ষিণ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। উত্তর ভিয়েতনাম হো চি মিনের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট গেরিলাদের দখলে থাকে; দক্ষিণ ভিয়েতনাম ফ্রান্সের দখলে থাকে। ১৯৫৭ সালের অক্টোবর মাসে কমিউমিস্ট গেরিলারা দক্ষিণ ভিয়েতনামে প্রবেশ করে আমেরিকার স্থাপনার উপর হামলা চালালে, আমেরিকার সরকার দক্ষিণ ভিয়েতনামের সরকারকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দিতে শুরু করে।
বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত আমেরিকার পরাষ্ট্র নীতি ডোমিনো থিওরি 'domino theory' দ্বারা প্রভাবিত ছিল। ডোমিনো থিওরি হলো, কোনো রাষ্ট্রে যদি কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে পার্শবর্তী রাষ্ট্রেও কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। যেহেতু উত্তর ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, দক্ষিণ ভিয়েতনামেও কমিউনিস্ট সরকার আসন্ন, এই বিবেচনায় প্রেসিডেন্ট কেনেডি ১৯৬১ সালে ভিয়েতনামে প্রথম আমেরিকান সৈন্যদল পাঠান।
১৯৬৪ সালে আগস্ট মাসে উত্তর ভিয়েতনামের টরপেডো বোট আমেরিকার যুদ্ধজাহাজকে আক্রমণ করলে আমেরিকা সক্রিয় ভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পরে। মার্কিন কংগ্রেস প্রেসিডেন্টকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ক্ষমতা প্রদান করে। এরফলে আমেরিকা দক্ষিণ ভিয়েতনামে দ্রুত সৈন্য পাঠাতে শুরু করে। ১৯৬৭ সালের মধ্যে দক্ষিণ ভিয়েতনামে আমেরিকার সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ লক্ষে। কিন্তু কমিউনিস্ট গেরিলাদের বিরুদ্ধে আমেরিকান সৈন্যরা সাফল্য অর্জন করতে পারছিলো না। এদিকে আমেরিকানদের জনমতও যুদ্ধের বিপক্ষে চলে যায়। আমেরিকার বড়বড় শহরগুলিতে যুদ্ধ-বিরোধী সমাবেশ হতে থাকে। এদিকে ভিয়েতকংগরা (National Liberation Front) দক্ষিণ ভিয়েতনামের শহরগুলিতে ব্যাপক গেরিলা আক্রমণ শুরু করে। আমেরিকার জনমত যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠলে ১৯৬৮ সালের ৩ এপ্রিল শান্তি আলোচনা শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৭০ সাল থেকে মার্কিন সৈন্য পর্যায়ক্রমে ভিয়েতনাম থেকে প্রত্যাহার করা শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে সর্বশেষ মার্কিন সৈন্য ভিয়েতনাম ত্যাগ করে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৭ রাত ১:১৪