somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চাটগাঁইয়া বুলি - আরেকটি স্বতন্ত্র ভাষা

৩১ শে মে, ২০০৯ বিকাল ৩:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সে অনেক দিন আগের কথা।

পড়ন্ত বিকেল। সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে নেমে তিনজন বালক সিদ্ধান্ত নিল যে আজ রাতেই উন্মত্ত সাগর না দেখলেই নয়।

বেশ কিছুক্ষণ পর।

সাই সাই করে অন্ধকারাচ্ছন্ন গাছগাছালি ফুঁড়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে সমুদ্রের উদ্দেশ্যে ছুটে চলা এক বাসে বসে তিনজন বালকের মধ্যে সবচেয়ে অপরিপক্ব একজনকে মুখোমুখি হতে হল কিছু অবোধ্য বুলির।

- তুঁই হন্ডে যোর?
- (বিব্রত)
- (জোর গলায়) তুঁই হন্ডে যোর?
- (ভীত)
- (হতাশ) তোঁয়ার নাম কী?
- (স্বস্তি) জ্বী, আমার নাম অমুক।
- তুঁই কেন আছো?
- (দ্বিধা) ইয়ে মানে, সমুদ্র দেখতে। আপনি দেখেছেন? মানে সমুদ্র?
- (হতাশ) ন ন। তুঁই কেন আছো?
- (উল্লসিত) ও আমি কেমন আছি? ও আচ্ছা। জ্বী, আমি ভাল আছি। আপনি?
- (মজা লুটছে) আঁই গম আছি।
- (বোঝার ভান করা) ও আচ্ছা। (এবং জানালা দিয়ে অন্ধকারের দিকে বৃথা মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা আর মাথায় এই চিন্তা যে ভাষার নাকি সৃষ্টি হয়েছিলো মানুষের ভাবের আদান-প্রদানের উদ্দেশ্যেই!)

অনেক ভাষাবিদরা বলেন যে সাবলীল মুক্ত কথার ফুলঝুরি কখনই মনুষ্য-ভাবের প্রকৃত পরিচয় বহন করতে পারে না। হ্যাঁ, অনেক শ্রম-সাধনা করে উচ্চ পর্যায়ের ভাষা প্রকাশের গুণাবলী অর্জন করা সম্ভব হলেও, ভাষা প্রকাশকালে প্রকৃত বোধ-চিন্তা এমনকি বর্ণনাযোগ্য বস্তুজগতও শূন্যতায় পর্যবসিত হয়। ভাষার প্রকাশে আসল বা প্রকৃত ভাবখানি নাকি সব সময়ই থাকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। সেটা ভিন্ন কথা।

তাই বলে নিজ ভাষার একটি আঞ্চলিক রূপও মাঝে মাঝে তথাকথিত ‘শুদ্ধ’ বাংলা ভাষাভাষীদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকবে, সেটা কেমন কথা? কোনটা ভাষার ‘শুদ্ধ’ রূপ? একটা আঞ্চলিক রূপ কতটুকু বদলে গেলে সেটা আর আঞ্চলিক রূপ থাকে না? বাল্যকালে বিদ্যালয়ে শেখানো ‘চিটাগোনিয়ান বাংলা ভাষার একটি আঞ্চলিক রূপ মাত্র’ কথাটা কতটুকু ঠিক তাহলে?

বলা হচ্ছে, সিলটী ভাষার সাথে সাথে বাংলাদেশের আরেকটি স্বতন্ত্র ভাষা এই চিটাগোনিয়ান ভাষা। তাই ‘চাটগাঁইয়া বুলি’ শুধুই বাংলা ভাষার একটি আঞ্চলিক রূপ নয় মাত্র।

বাংলা ভাষার মত চিটাগোনিয়ানও ইন্দো-আরিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে, চিটাগোনিয়ান ভাষা পূর্ব ইন্দো-আরিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে বাংলা-আসামী শাখার একটি উপশাখায় বিদ্যমান। এর অনুরূপ ভাষাগুলো হচ্ছে বাংলা, সিলটী, আসামী, উরিয়া এবং বিহারী। অন্যান্য ইন্দো-আরিয়ান ভাষার মত এই চিটাগোনিয়ান ভাষাও তাই সংস্কৃত থেকেই উৎপত্তি লাভ করেছে বলা যায়; একেবারে শুরুতে যেটা আবার প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। একবার যখন এই ‘প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাগোষ্ঠী’ শব্দটা বলেই ফেলা হলো, তখন অবশ্যই অনেক মতবিরোধ আর হাইপোথিসিস আসবে। ‘প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর’ অনেকগুলো প্রস্তাবিত উৎপত্তিস্থলের মধ্যে রয়েছে ৭০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আনাতলীয়া, ৬০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ভারত, ৪০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আরমেনিয়া ইত্যাদি। কিন্তু সবকিছুই কীভাবে একইসূত্রে গাঁথা? ‘তুঁই হন্ডে যোর?’- কথাটার সাথে ৪০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ব্রোঞ্জ-সভ্যতার আরমেনিয়াতে কোন এক মানুষের বলা আরেকটা কথার কি যোগসূত্রতা আছে? দরকার তথ্যের পর্যাপ্ততা।

সে যাই হোক, বাংলা ও চিটাগোনিয়ান ভাষার মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক সমঝোতার অভাব। Linguistics এর ভাষা অনুসারে, lack of mutual intelligibility। বাংলাভাষা থেকে চিটাগোনিয়ান আলাদা মূলতঃ ঘর্ষণজাত ধ্বনির (fricative sounds) প্রাধান্যে, যেখানে বাংলার চেয়ে চিটাগোনিয়ান ভাষায় রয়েছে প্রচুর ঘর্ষণজাত ধ্বনির সমাহার। পূর্ব-ইন্ডিক ভাষার মত চিটাগোনিয়ান ভাষায় নাসিক্য-স্বরধ্বনির প্রয়োগ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। শুধুমাত্র মৌখিক (oral) স্বরবর্ণের নাসিক্য (nasal) স্বরবর্ণে রূপান্তর একটি শব্দের সংজ্ঞা পালটে দিতে পারে (‘আর’ – ‘এবং’ থেকে ‘আঁর’ – ‘আমার’)। ব্যাকরণের প্রয়োগে চিটাগোনিয়ান আর বাংলাকে প্রায় একই বলা হচ্ছে; যেখানে পার্থক্য মূলতঃ সংখ্যা, কাল, ব্যক্তি ইত্যাদির প্রয়োগে (inflectional morphology) এবং শব্দের ক্রমে। বলা হচ্ছে, আসামী ভাষার মত চিটাগোনিয়ান ভাষাতেও ক্রিয়াপদ-পূর্ব না-বোধক শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয়, বাংলায় যেখানে না-বোধক কিছু বোঝাতে তা ক্রিয়াপদের পরেই সাধারণত ব্যবহৃত হয় (বাংলা - আমি খাই না; চিটাগনিয়ান – আঁই ন খাই)। শব্দের ভাণ্ডারে বেশীরভাগ শব্দের উৎপত্তি ঐ সংস্কৃত থেকেই। তাছাড়া বৈদেশিক শব্দের প্রাচুর্যতা চিটাগোনিয়ান ভাষায় খুবই লক্ষণীয়। রয়েছে প্রচুর আরবী, ফারসী, তুর্কি শব্দ। পর্তুগীজ শব্দও রয়েছে বেশ কিছু। আর আছে প্রচুর ইংরেজী শব্দের সমাহার। বন্দর-শহর চট্টগ্রাম!

কিন্তু সিলটী ভাষার মত চিটাগোনিয়ান ভাষার কোন নিজস্ব হস্তলিপি ছিল না। তাই বলা হচ্ছে এটা একটা unwritten language। লিখিতরূপে চিটাগোনিয়ান ভাষার প্রকাশ তাই বাংলা হস্তলিপি অনুসারে। এরও পূর্বে চিটাগোনিয়ান ভাষা কিন্তু আরবী হস্তলিপিতেই লেখা হত। আরবী কেন?

চিটাগাং বন্দরের উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে যখন মালয় ইতিহাস বলছে যে নাবিক বুদ্ধগুপ্ত ঐ সময়েই চিটাগাং থেকে মালয় পৌঁছান। চিটাগাং বন্দরের কথা উল্লেখ করেছেন টলেমী, হিউয়েন-সাঙ, ইবনে-বতুতা প্রমুখ। তারপর খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীতেই এই বন্দরের ব্যবহার বেড়ে যায় আরবদের সৌজন্যে। তারা একে বলতো ‘সমুন্দর’ বা ‘সমন্দর’। এটা বর্তমান বন্দরের অবস্থানে নাও হতে পারে। সেই সমন্দর বন্দরের অবস্থান আজও আবিস্কৃত হয়নি ।* এটা আরবদের শাসনেই ছিলো। আরবরা নাকি ভেবেছিলো যে চিটাগাং গঙ্গার এক ব-দ্বীপ (delta)। এক হিসেবে তাই বলা হচ্ছে চিটাগাং এসেছে আরবী শব্দ Shetgang থেকে যেখানে Shet মানে হচ্ছে delta আর gang মানে Gang the river। অবশ্য এ রকম আরও উৎপত্তিগত ধারণা বিদ্যমান এই নামকরণের।* তারপর খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগীজদের আগমন - কাপ্তান জোওডা সিলভেরা আর তার জাহাজ ‘লোপো সোয়ানা’। তারা এর নামকরণ করে Porte Grande বা গ্রেট পোর্ট। কিন্তু তার আগেই আরবদের কয়েক শতাব্দীর বিচরণ চিটাগোনিয়ান ভাষার লিখিত রূপে আরবী ভাষার ব্যবহারকে অবাক করে না আর।


* চট্টগ্রাম শব্দের উৎপত্তি - ইমন জুবায়ের
___________________________________________________
সিলেটী - একটি স্বতন্ত্র ভাষা
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১:০২
৪৫টি মন্তব্য ৪২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×