সর্বনাশা পদ্মা নদীই সফর মিয়ার শেষ সম্বল পৈতৃক ভিটাটিও কেড়ে নেয়। উপায় না পেয়ে,গফুর
চাচার পুরনো বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বাড়িটা মেরামত করে ছোট্ট একটা কুঁটির গড়ে তুলে সে। স্ত্রী রাহেলা আর পাঁচ বছরের মেয়ে অন্তুকে নিয়ে সংসার চালাতে বেশ হিমশিম খাচ্ছিল সফর মিয়া। তার উপর রাহেলা চার মাসের অন্তস্বতা। চারদিকে অভাব তার উপর নতুন মেহমানের আগমন সফর মিয়ার চিন্তায় রাতের ঘুম হারাম।
অনেক ভেবে, জীবিকার তাগিদে ঢাকার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালো সফর মিয়া। ঢাকায় নাকি টাকা উড়ে। এখানে এসে সফর মিয়া টাকা উড়ার কোন নাম গন্ধ পায় না। বরং ,সাথে করে যে টাকা নিয়ে এসেছিল, সেই টাকার থলের ওজন দিন দিন কমতে লাগলো। কাজের আশায় প্রতিদিন সকালে বের হতো,আর রাতে ম্যাসে ফিরতো।
এমনি করে দিনকাল চলতে থাকে। পরিবারের জন্য এখনো কোন টাকা পাঠাতে পারে নি সফর মিয়া। চিন্তায় কপালে ভাজ পড়ে সফর মিয়ার। লজ্জায় রাহেলার খোঁজ নিতে পারছে না। আবার, বাড়ির কথা মনে পড়লে হুহু করে কেঁদে উঠে মন। স্ত্রী , সন্তান কি খাচ্ছে নাকি খাচ্ছে না, কিছুই জানতে পারছে না।
অভাবের বাজারে শেষমেস বাদাম ফেরী করতে বাধ্য হয়। সারাদিন বাদাম বিক্রি করে , যা লাভ হয় তার অর্ধেকটা নিজেরই থাকা খাওয়ার পিছনে খরচ হয়ে যায়। মাস শেষে যে টাকা বাড়ীতে পাঠায় , তাতে কোন রকম মাস পার করে রাহেলা।
সেদিন গফুর চাচার নাম্বারে ফোন করে রাহেলার সাথে কথা বলে। রাহেলার শরীর বেশি ভাল না। আর মেয়েটা মিষ্টি করে বায়না ধরে বলে,"বাজান, ঈদে আমার জন্য দামি দেইখা লাল ফ্রক কিন্না আনবা কিন্তু। যদি না আন তোমার লগে কথা নাই।"
সামনে ঈদ ,মেয়ের এমন অসাধ্য বায়না পূরণ করবে কিভাবে?? যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। সেদিকে এমন বায়না তো আকাশ-পাতাল কল্পনা।
দেখতে দেখতে রোযা প্রায় ১০টা শেষ। রোযার মাসে বাদাম বিক্রিতে সুবিধে হচ্ছে না।তাই দিনের বেলা ভাড়ার ভ্যান গাড়িতে করে কাচাঁ তরকারি বিক্রি করে, কিছু অর্থ উপার্জন করে।
সেদিন,তরকারি বিক্রি করতে সায়দাবাদের দিকে যায় সফর। ম্যাসের টুনু দাদার দোকানে ঝুলানো লাল ফ্রকটা দেখে খুব নজর কাড়লো তার। সামনে গিয়ে দাম জিজ্ঞেস করতেই মাথায় হাত সফর মিয়ার। সামান্য এই ফ্রকটার দাম ২০০০/- টাকা। ড্রেসটা ধরছিল আর কল্পনায় বারবার মেয়ের মুখ খানা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। মেয়েটা ফ্রকটা পড়লে লাল পরীর মত লাগবে একদম। টুনু দাদার ডাকে কল্পনার জগত থেকে ফিরে আসে সফর।
সেদিনই,টুনু দাদার পকেটে সেদিন ১০০ টাকা গুজে দিয়ে বললাম,জামাডা পছন্দ হইছে টুনু দাদা। টাকাডা জমা রাখিও আমানত স্বরূপ। তিনি আবার শর্ত দিছেন,২৫ রোযার আগে টাহা পরিশোধ করতে হইবো।তিনি সেদিন বাড়ি চলে যাবেন।
আজ রোযা ২৪টা হলো। কোনোভাবেই টাকার অংক মেলাতে পারছে না সফর মিয়া। কপালে ভাজ তুলে সন্ধ্যায় ম্যাসে বসে বারবার টাকা গুনছিল। সবমিলিয়ে মাএ ১২০০/- টাকা হইছে। আরো ৭০০টাকার টান।
একদিনে এত টাকা কোথা থেকে যোগাড় করবে সে। ভাবতে ভাবতে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল , সে তার নিজের শরীরের রক্ত বিক্রি করবে। যেই কথা সেই কাজ। আজ ২৫ রোযা,টাকা জমা দেয়ার শেষ তারিখ। সকালে ঘুম থেকে উঠেই রেডি হয়ে পাশের ক্লিনিকে গেল রক্ত দিতে।
কর্তৃপক্ষ সফর মিয়া রোগা আর দূর্বল হওয়ার কারনে রক্ত নিতে অমত জানায়। হতাশ হয়ে সফর মিয়া কাঁদতে শুরু করে। অনেক অনুরোধ করার পর একব্যাগ রক্ত নিতেই রাজি হয়। বিনিময়ে তারা সফর মিয়াকে ৮০০ টাকা দেয়।
সফর মিয়া টাকাটা হাতে নিয়ে যেন স্বর্গ হাতে পেল। দেরি না করে টাকাটা নিয়ে সোজা টুনু দাদার দোকানে যায়। যে করেই হোক, মেয়ের মুখে সে হাসি ফোটাবেই।
মেয়ের জন্য টুনু দাদার দোকান থেকে লাল জামা কেনা হয়েছে। শরীরটা প্রচন্ড দূর্বল। সেই দূর্বলতা নিয়ে সফর মিয়া বাসের ছাদে চড়ে বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিল।মেয়ের মুখের হাসির সামনে এই দূর্বলতা তো কিছুই নয়। বাসে বসেই, আবার কল্পনা করতে লাগলো লাল ফ্রক পরা পরীটার কথা।
বিঃদ্রঃ সন্তানের এক ফালি হাসির জন্য বাবা-মায়ের জীবনের পরবাও করে না। তবুও,কিছু সন্তান সে ত্যাগ ভুলে যায় অবলীলায়। ঈদ বয়ে আনুক প্রতিটি মানুষের মনে সফর মিয়ার মত খুশি আর আনন্দ।
লিখা: প্রান্তিক চৌধুরী