somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার বাবা, আমার প্রিয় বন্ধু

২১ শে মার্চ, ২০১১ রাত ২:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাবা শব্দটা খুব আপন একটা শব্দ বোধ হয় সবার কাছে।আমার মনে পড়ে সেই ছোট্টবেলার কথা, আট বছর মাত্র বয়স।শেষ বাবা ডাকটা ডেকেছিলাম হাসপাতালের ছোট্ট একটা কেবিনে ত্রিতীয় বারের মত ব্রেইন স্ট্রোক অ্যাটাকে পরাজিত আধো অচেতন আমার বাবা কে।দুই ভাই মিলে অদ্ভুত একটা কান্ড করে ফেলেছিলাম সেদিন।ভাইটা আমার দু বছরের বড়। বাসায় কেউ নেই, আমাদের রেখে সবাই হাসপাতালে।দুরন্ত দু-ভাই এর কি মনে হল, দুজনে বললাম চল হাস্পাতালে যাই বাবাকে দেখে আসি। খুলনা শহরের রাস্তা, আগে যতবার ই গিয়েছি, বড়দের সাথে রিক্সাতে। তাও কম না, প্রায় দু-তিন মাইল দূরে খুলনা সদর হাসপাতাল।সোজা রাস্তা ধরে দুই ভাই রওনা দিলাম কাউকে না বলেই। ওনেক সময় ধরে হেটে হেটে, ডানে বামে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় ঠিক ঠিক পৌছে গেলাম সদর হাসপাতালে, খুজে পেলাম কেবিন ও।আমরা উকি দিয়ে দেখলাম বাবা শুয়ে আছে আধো-ওচেতন হয়ে। মা বকা দিলেন খুব, কেমন করে এলি! হাসপাতালের ওষুধ গন্ধের মাঝে দুই ভাই বসে রইলাম চুপ করে, ভয়ে ভয়ে।এক সময় বাবা কিছুক্ষনের জন্য চোখ মেলে আমাদের দেখতে পেয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করলেন ওরা কার সাথে এসেছে। মা ঘটনা খুলে বলতেই, বাবা খুব অবাক চোখে তাকালেন আমাদের দিকে। হইতো দীঘ্রশাস ফেলেছেন সবার অগোচরে, মাকে বললেন, ওদের একটু কাছে আসতে বল, ওদেরকে কিছু খেতে দাও। ছোট্ট আমি ভয়ে ভয়ে শুধু ভাবি, কেন শুয়ে আছে আমার বাবা! কবে বাড়ি ফিরবে! এত সব প্রশ্ন নিয়ে ফিরে এলাম বাসায়। বুঝতে পারিনি একটুও, সেদিন ই ছিল আমার বাবাকে শেষ জীবিত দেখা।তার পরে একদিন বাড়িতে শুধু কান্নার রোল।সবাই কাদছে, কেন কাদছে! দেখতে পেলাম বাইরে একটা খাটিয়াতে বাবার চিরঘুমন্ত দেহ।এইটুকু আমি, একটুও বুঝতে পারিনি, বাবা আমার চিরদিনের জন্য ছেড়ে গেছেন। একটুও কাদতে পারিনি সেদিন।নিরব অথর হয়ে শুধু দেখে গিয়েছি সব কিছু।

আমার বাবা, আমার দেখা প্রিথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ। সবার বাবা হয়তো তাদের কাছে আইডল হিসাবে থাকে। কিন্তু আমার বাবা ছিলেন আসলেই যেন অনেকটা আর দশজন বাবার চেয়ে ভিন্ন। খুব ছোট ছিলাম, তাই স্মিৃতীও অনেক কম বাবাকে নিয়ে। যেটুকু মনে পড়ে, বাবা আমাকে কুটে বলে ডাকতেন সব সময়। পরিবারের ছোট হওয়ার মজাই হয়তো এটা ছিল, অফিস থেকে ফিরে বাবাকে যেন ডাকতেই হবে, কইরে আমার কুটেটা কই। ছোট্ট আমি, খুব অবাক হয়ে সব সময় আমার বাবার কাজ কারবার দেখতাম। আমার অ্যাকাউন্টেন্ট ম্যানেজার বাবা, আমাকে বাস এ করে তার জুট মিলের অফিস এ একদিন নিয়ে গেলেন। অবাক বিষ্ময়ে আমি আমার বাবার রাজত্ত দেখতে লাগলাম।বাবার অফিস রুম, উনার পিওনকে বল্লেন যাও আমার ছেলেটার জন্য কিছু নিয়ে এসো।নাবিস্কো বিস্কুট নিয়ে আসলো লোকটা।মজা করে বাবার টেবিল এ বসে খেলাম বিস্কুট।বাবা আমাকে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন বাসায়। শুক্রবারের কান ধরে দুই ভাইকে নিয়ে যেতেন বাজারে। আমার বোনদের ও নিয়ে যেতেন। ভাই বোন যাকেই নিয়ে যেতেন, বাজারে গিয়ে ডিমওয়ালার পাশে দাড় করিয়ে দিয়ে নিজে বাজার করতেন ঘুরে ঘুরে। আমরা ভাই-বোনেরা দূর থেকে ভিড়ের মাঝে বাবার মাথা খুজে বেরাতাম, আর দেখা মাত্রই চিতকার ঐ দেখ ঐ দেখ বাবা ঐ দিকে। বাজার থেকে ফিরেও রক্ষা নাই, এক শুক্রবার বাদ দিয়ে আরেক শুক্রবারে দুই ভাইকে আবারও কান ধরে নিয়ে যেতেন নাপিত এর কাছে, চুল ছেটে সুন্দর করে যেন রাখতেই হবে সব সময়।

আমার বাবা, তখন বুঝিনি যে চেয়ারটাতে তখন তিনি বসতেন, ওটা ছিল অবৈধ সম্পদ আহোরনের খুব ভালো একটা জায়গা।অথচ তিনি! বড় হয়ে শুধু ভাবি, ছোট বেলাতে এই বাবাকে আমি নিজে দেখেছি অল্প জামা কাপড়ের বেশি কখনো কেনেননি।মাঝে মাঝে দেখেছি, পয়সা বাচানোর জন্য উনি কম দামি সিগারেট খেতেন। সবচেয়ে অবাক করা কান্ড আমার এখনও মনে পড়ে, একবার আমার দাদার থেকে পাওয়া বসত বাড়িটাকে এক্সটেন্সনের কাজ শুরু করলেন। তখন অফিস থেকে ফিরে উনি প্রতিদিন একটা কাজ করা শুরু করলেন, সেটা হল ইট ভাংগা। সারা সন্ধ্যা তিনি নিজ হাতে ইট ভাংতেন, একের পর এক, বিরামহীনভাবে ভেংগে ভেংগে তিনি ইট এর বিশাল স্তুপ জমালেন। এরপর সেই ইট দিয়ে বাড়ির ছাদের ঢালাই দিলেন। আজও বাবার ম্রত্যুর ২০ এর অধিক বছর পর যখন আমার শিকড়ের কাছে ফিরে যায়, রাস্তাতে কোন কোন বয়স্ক লোক হঠাত আমাকে ডেকে বলেন এই তুমি কাজী সাহেবের ছেলে না! আমি নীরবে মাথা সাই দেই হা। লোকটা একটুও না থেমে বলতে থাকেন, তোমার বাবা খুব ভাল মানুষ ছিলেন, এলাকায় এরকম সত মানষ খুব কম আছেন। আমার বুক গব্রে ভরে যায়, এই না হলে আমার বাবা, যিনি তার ম্রত্যুর ২০ বছর পরও আজও বেচে আছেন মানুষের মাঝে।

আমার বাবা, বিলাসহীন সাদামাটা জীবন যাপন করে গেছেন সারাটি বছর। অবাক লাগে যখন ভাবি, প্রচন্ড মিতব্যয়ী একজন মানুষ অথচ শখ পুরনে ছাড় দিবেননা একটুও। প্রচন্ড শৌখিন মানুষ ছিলেন উনি, সীমিত পোশাকের মধ্যেই একধরনের আভিজাত্য ফুটে উঠতো তার শরীরে। ১৯৬০ এর দশকে যে কজন স্যুট পড়া সভ্য বাঙ্গালী ছিলেন, তার একজন আমার বাবা। মাছ ধরার নেশা ছিলেন উনার প্রচন্ড। বিশাল বিশাল ছিপ নিয়ে চলে যেতেন মাছ ধরতে, একবার বিসাল এক মাছ নিয়ে ফিরলেন যেটা তখনকার আমার থেকে সাইজ এ বড়। একশ এর উপর ফুল গাছের টব ছিল উনার, অফিস থেকে ফিরে এক দৌড়ে ছাদে চলে যেতেন গাছ গুলার পরিচয্রা করতে।

আমার বাবা, আমার ছোট্ট বেলার বন্ধু। আমার এই জীবনে আমি আ্যত্তো ভাল বন্ধু হয়তো কোনদিন ই পাবনা। আমার এই বন্ধুটা আমার সাথে সবসময় খেলতেন, এটা ওটা খেলনা নিয়ে আসতেন। শুধু আমার জন্য না, আমার ভাইটার জন্যও। মনে পড়ে একদিন একটা খেলনা লঞ্চ নিয়ে আসলেন। এসেই দুই বেটাকে নিয়ে চলে গেলেন পানির ট্যাংকি এর পাড়ে, অতি উতসাহে আমার বাবা লঞ্চ এ তেল ভরলেন, এরপর আগুন দিয়ে ইঞ্জিন চালু করে দিলেন। অবাক হয়ে বাপ বেটা মিলে ভটভট শব্দে লঞ্চ চলা দেখি। একবার সপরিবারে ঢাকাতে বেড়াতে গেলাম বড় ভাইটার অসুস্থতাতে ডাক্তার দেখানোর জন্য। সারাদিন দুই ভাই এক আত্মীয়ের বাসাই থাকি চুপচাপ, বাবা কাজে এদিক ওদিক দৌড়ান শুধু, আর সেই রাতে ফিরেন। আমার মনে নেই, বাবাকে কি বলেছিলাম নাকি যে বাবা বড্ড একলা লাগে, একটা খেলনা এনে দাও, জানিনা। এক সন্ধ্যায় দুই ভাই অপেক্ষা করছি বাবার ফেরার অপেক্ষাতে, মন কেন যেন বলছিল বাবা আজ নিশ্চয়ই কিছু আনবেন। অনেক রাতে বাবা ফিরলেন, দুই ভাই গিয়ে ঘিরে ধরলাম বাবা এসেছে বাবা এসেছে বলে। অবাক হয়ে দেখি বাবা ব্যাগ থেকে একটা হেলিকপ্টার বের করে আমাকে দিলেন, আর ভাইয়াকে দিলেন একটা প্লেন। প্রচন্ড আনন্দে দুই ভাই ওই বাড়ির আঙ্গিনাতে গিয়ে রাতের আধারে চাবি দেওয়া প্লেন আর হেলিকপ্টার নিয়ে দুই ভাই যুদ্ধে নেমে গেলাম।

তখন একদম জানতামনা, ওটাই ছিল আমার বাবার দেওয়া শেষ খেলনা। আমি হারালাম আমার প্রিয় বন্ধুটিকে, হারালাম হাসি আনন্দে কাটানোর ছোট্ট ছোট্ট কারন গুলো। মানুষ বলে, আমি নাকি আমার বাবার মত হয়েছি দেখতে একদম। আমার মন ত্রিপ্ত হয়না এতে, আমিযে আমার বাবার মত শুধু দেখতে নয়, আমার বাবার প্রতিটি জীবনধারা অনুসরন করতে চাই। আমি পারিনা উনার মত হতে, উনার মত হতে পারাটা সাত জনমের ভাগ্য হতে হয়। দুরন্ত আমি আরও দুরন্ত হয়েছি, ছুটেছি ভবঘুরের মত কোন বাধা না মেনে। শুধু যখন দেখি কোন শিশু, কিশোর, তরুন তার বাবার হাত ধরে চলছে একান্ত নিশ্চিন্তে, এলোমেলো হয়ে যাই কিছুক্ষনের জন্য। চোখের কোনাটা ভিজে যায় নিজের অজান্তে। আমার বাবা, তুমি এখন কোথায় আছ জানিনা। যেখানেই থাকো, যেমন ই থাকো, ভালো থেকো বাবা। আর জেনে রেখো, আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি আমার প্রিয় বন্ধু।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০১১ রাত ৩:১৪
৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×