somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডাইরির কান্না (সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত)

১৯ শে মে, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১.
নক নক।
- এইযে শুনতে পাচ্ছেন! এত ঘুমায় কেউ? উঠুন উঠুন।
- অরুন্ধিতা আপনি? এই সময়ে!
- হুমম আমিই তো। আমার কোন কপি নাই ফর ইয়োর ইনফো।
- না মানে, এই সাত সকালে? আমার মেসে! এ সময়ে কোন সুন্দরী মেয়ের আসার কথা কি! ইমতিয়াজের সরল প্রশ্ন।
- কেন? হি হি হি আপনার কাছে আসতে হলে কি রাত্রে আসতে হবে?
- ধুর ছাই, কিসের মধ্যে কি! খালি মশকরা করাই আপনার একমাত্র কাজ। কি জন্য এসেছেন তাই বলেন।
- বিয়ে করতে যাব এখন। ডাইরেক্ট কাজী অফিস। আপনি বর। সাক্ষী রেডি করা আছে। পাঞ্জাবী আছে তো! দ্রুত পাঞ্জাবী পড়ে বের হয়ে আসুন।
- আবারো ফাজলামি! আপনাকে নিয়ে আর পারিনা। আপনি পারেন ও! সোজা করে বললে কি হয়?
- হি হি হি ফাজিলদের সাথে ফাজলামো করব নাতো কি করব? এইযে দরজায় দাড় করিয়ে এতগুলা প্রশ্ন করছেন। এইটা কি ফাজলামো নয়!
চকিতে জিভ কামরায় ইমতিয়াজ।
- তাইতো। হুমম এক মিনিট। আমি জাস্ট কাপড়টা চেঞ্জ করে আসছি। চলুন গলির মোড়ের রেস্টুরেন্টে বসে চা খেতে খেতে কথা হোক।

অরুন্ধিতা, সদ্য পাশ করা ডাক্তার। বোর্ড পরীক্ষা গুলাতে ডাবল স্ট্যান্ড। সদা লাস্যময়ী এক উচ্ছল তরুণী। তার হাসি দেখে যে কোন রোগীই কিছুক্ষণের জন্য সব জরা ভুলে ভাল হয়ে যাবে। ইমতিয়াজের সাথে তার পরিচয় ব্লাড ডোনেশনের ক্যাম্পিং এ। ইমতিয়াজ গোটা তিনেক বছর আগে মাস্টার্স করা একটা চরম ভ্যাগাবন্ড টাইপ ছেলে, যার কাজই হচ্ছে মানব সম্প্রদায়ের সেবা করে বেড়ানো। অরুন্ধিতার জাতও অনেকটা সেরকম হওয়াতে দুজনে মিলতে বেশীদিন লাগেনা। অরুন্ধিতার প্রায়ই নিজের বেতনের টাকা দিয়ে রোগীর ওষুধ কেনার অভ্যাস দেখে ইমিতায়াজ তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলে, আফামনি আজ থেকে আর আপনার পিছু ছাড়ছি না। অসুস্থ হইলে অন্তত ওষুধ পাবার এরকম গ্যারান্টি কে ছাড়তে চায় বলেন!

- ইমতি, আমরা রেস্টুরেন্টে বসছি না। নারায়ণগঞ্জের বাস ধরব এখন। ইমতিয়াজ রেডি হয়ে বের হতেই অরুন্ধিতার অন্যমনস্ক গলা।
- কি হয়েছে আপনার অরু? কেমন যেন লাগছে আপনাকে?
অরু নিজেকে ধাতস্থ করে নেয় চোখের পলকে।
- নাতো কিছু হয়নি। কি হবে আবার!
- কি হবে তা আমি কি করে বলব? কিন্তু কিছু একটা হয়েছে অবশ্যই। এখন বলবেন নাকি বাসে বসে বলবেন সেটা বলেন।
- হি হি হি আপনার প্রেমে পড়েছি ইমতি সাহেব। তাই একটু কেমন কেমন হয়ে যাচ্ছি প্রেমের প্রস্তাব কেমন করে দেব এটা ভাবতেই।
হা হা হা আপনার আবার প্রেম! ইমতি হেসে উঠে উচ্ছ্বাসে।
- আপনার শুধু রোগী আর স্টেথোস্কোপ ছাড়া আর কোন জীবন আছে কিনা এটা আইনস্টাইনও ভেবে বের করতে পারবেন না।
- এই ইমতি, আপনি এত ডাক্তারদের পিছনে লাগেন কেন? আপনি খুবই পচা। নাহ আপনার সাথে খেলব না।
- আমি পচা! আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি আপনার পথ দেখেন। আমি যাই ফিরে, ঘুমাই গিয়ে আবার।
- না না। কই যান। আপনি কত ভালো। দেখেন আজ আমার প্রেমের প্রথম দিন। আজকে আপনি আমার সাথে এরকম করতে পারেন না।
- হা হা হা। তো কি করব? ওগো সিনোরিটা তুমি আমাকে প্রেমের প্রপোজ কর বলে হাঁটু গেড়ে আপনার সামনে বসব!

দুজনে রিক্সায় বসে হাসতে হাসতে আর খুনসুটি করতে করতে পৌঁছে যায় মতিঝিল। সেখান থেকে চেপে বসে নারায়ণগঞ্জের বাসে।


২.
তো আপনি বেঁছে বেঁছে নারায়ণগঞ্জকে আমাদের প্রথম ডেটিং প্লেস হিসাবে বেঁছে নিলেন কেন? নীরবতা ভেঙ্গে ইমতির জিজ্ঞাসা অরুকে। অরুর তৎক্ষণাৎ ফাজলামি মার্কা উত্তর না পেয়ে অবাক হয়ে তাকায় সে অরুর দিকে।
একি অরু। আপনি কাঁদছেন! কেন! কি হয়েছে! আমি কি কিছু অযাচিত বলেছি! ফান করছিলাম তো শুধু।
চুপ করুন। নিজেকে কি ভাবেন। চলন্ত জোকার! অরুর হিসহিস করে ওঠা কণ্ঠস্বর। আমি আপনার জন্য কাদছি না। হাতে ধরা ডাইরিটা এগিয়ে দেয় অরু। পড়ুন এটা। নারায়ণগঞ্জ পৌছাতে দুই ঘন্টা মত লাগবে। এই সময়টুকু আমি আপনাকে দান করলাম আমার ব্যক্তিগত ডাইরি পড়ার জন্য। আর প্লীজ, এই সময়ে যদি কোন কথা বলেছেন তাহলে আমি আপনাকে জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলে দেব বলে রাখলাম।

অরুর ডাইরি।

২০০৯ সাল।
১লা জানুয়ারি।
নতুন একটা বছর। নতুন একটা দিন। কিন্তু এই আমি আগের মতই পুরানো। চলন্ত একটা মানুষ। অথচ চলছি কিনা জানিনা। সবার মত আমারও ইচ্ছা করে হাসি আনন্দে বেঁচে থাকতে। কি দোষ ছিল আমার, কেন আমি আর সবার মত সব সময় হাসতে পারিনা। কান্না কেন আমার পিছু ছাড়ে না। কাঁদতে কাঁদতে কখনও যদি বন্যা বয়ে যায় আমার ঘরে, তবেই কি শুধু আমার কান্না থামবে। জানিনা...

২রা জানুয়ারি।
আজ আমার নারীত্বের কাছে প্রশ্ন করি। কি দোষ করেছিলাম নারী হয়ে জন্ম নেবার। নাকি পুরুষদেরও একই যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় কারও কারও! এমন একটা বৃত্তের বেড়াজালে বন্দী আমি, আমার মুক্তি নেই বুঝি এর সীমানা ভেদ করে। কেন এমন হবে নারীদের। আমি আজ পূর্ণবয়স্ক একজন। তাও আমার ফোন বাজলে ঝাঁকের কই মাছ দেখার মত করে চারিদিক থেকে বাড়ীর মানুষগুলো ঘিরে ধরে, কে ফোন করেছে। কি প্রেমালাপ চলছে! এটা জানার জন্য...

প্রতিদিনের এন্ট্রি আছে ডাইরিতে। ইমতি সময় বাঁচানোর জন্য দ্রুত পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে এবং শুধুমাত্র উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠা গুলাতে বিস্তারিত পড়ে।

২১ জানুয়ারি।
আমার মা। আমার তথাকথিত মা আজকে আমাকে চেপে ধরেছেন। বিয়ে করবি না কেন। এত সুন্দর একটা প্রস্তাব। বিলেতের ডাক্তার। আমার সাথে নাকি দিব্যি মানিয়ে যেত। আমি শুধু মাথা নিচু করে থেকে বলি, মা আমি বিয়ে করব না। আমার মা, প্রচণ্ড হতাশা নিয়ে ফিরে যান। হায়, আমি তাকে কি করে বুঝাই যে পুরুষ জাতটার উপর আমি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস পাইনা...

২২শে ফেব্রুয়ারি
উফফ খোদা আমাকে কেন অন্ধ করে দাওনা। ঐ বদমাশ নর-পিচাশটাকে দেখলাম আবার আজকে। গলা উচিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে। উফফ খোদা। কেন, কেন, কেন! হয় আমাকে অন্ধ করে দাও। নাহলে তাকে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নাও। আমাকে কোন নর খাদকী বানিয়ে দাও। ইচ্ছা করলেই আজ আমি আমার সার্জিক্যাল ছুরিটা দিয়ে ওর গলা দ্বিখণ্ডিত করে দিতে পারি। কিন্তু পারিনা খোদা। কেন এত দুর্বল করে বানালে আমাকে। কেন আগে থেকে শেখাওনি, নারী তুমি অবলা। কেন প্রত্যেক নারীকে জন্মের পর একখানা সার্জিক্যাল ছুরি হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়না। ২১ সেপ্টেম্বর ২০০৫ সাল। ঐ দিনটাতে কেন ছুরিখানা আমার সাথে ছিল না। তাহলে আর আমার জীবনের কান্নাটা চিরকালের পথ-সঙ্গী হতনা...

২৩শে ফেব্রুয়ারি
আমার কান্নাটা আজও থামছে না। যখনই মনে পড়ছে ঘটনাটা। চোখের জলে আমার দু-চোখ ভেসে যায়। আমি কাল থেকে দরজা বন্ধ করে বসে আছি ঘরে। বাইরে সবাই ভয়ার্ত কণ্ঠে ঘোরাঘুরি করছে...

২৮শে মার্চ
জীবনে এই প্রথম আনন্দিত হবার কোন একটা কারণ খুঁজে পেলাম হয়তো। আমি উনার খোজ পেয়েছি। আমি পেয়েছি আমার শিকড়ের খোজ। এতদিন খুঁজেও গোপন যে কথাটা উদ্ধার করতে পারিনি। আজ আমি সেই রহস্যের অনেক ধারে পৌঁছে গেছি। আমি জেনে গেছি আমার শুরুটা কোথায়। আমি তার ঠিকানা খুঁজে বের করবই। একবার হলেও তার কাছে যাব...

৪ঠা এপ্রিল
একি উত্তেজনা খেলা করছে আমার শরীরে। শরীরের সমস্ত সেলগুলো যেন গুমরে কেঁদে উঠছে একটু পরপর। আমি উনার ঠিকানা পেয়েছি। আমি যাব। অবশ্যই যাব। খুব শীঘ্রই যাব। কিন্তু কি হবে যেয়ে! এতদিন পরে এতদিনের বিচ্ছিন্ন একটা সম্পর্ক। কি হবে আবার জোড়া দেবার চেষ্টা করে। আমি জানিনা। থাক না হয় আমি আমার পরিচয় দেব না। দুর থেকে দেখে আসব। উনিতো চিনতে পারবেন না আমাকে...

৮ই এপ্রিল
ছাতার মাথা ডাক্তারি। কেন পড়ে মানুষ! একটু নিজস্ব সময় নেই আমাদের। সেই কবে থেকে বলছি আমাকে ছুটি দিতে এক দিনের। দিচ্ছেই না। ডাক্তারদের নাকি ছুটি থাকতে নাই। হাহ জুনিয়র ডাক্তার পেয়েছে। কলুর বলদের মত খাটিয়ে নাও যত পারো। নিজেরা তো দিনের পর দিন আরাম করে কখন আসো কখন যাও টের পাওনা...

১০ই এপ্রিল
একি। আমি এটা কি শুনলাম। আমার এতদিনের খুঁজে পাওয়া রহস্যের সমাধানের যখন খুব কাছে পৌঁছে গেছি। এটা কি জানলাম একটু আগে। উনি মারা গেছেন! যাকে আমি হন্যে হয়ে খুঁজছি আমি সেই কবে থেকে। আজ তাকে যখন খুঁজে পেলাম, উনি মারা গেলেন! আল্লাহ্‌, একি তোমার খেলা। কেন এমন করে খেল আমার সাথে। কি চাও তুমি। আমি কিচ্ছু বুঝতে পারিনা। কেন এমন হয়। সব সময়। আমি কি কাঁদব উনার জন্য...

ডায়রিটা বন্ধ করে ইমতিয়াজ সোজা হয়ে বসে। আজ ১১ই এপ্রিল সকাল বেলা। গতকাল রাত পর্যন্তই এন্ট্রি আছে ডাইরিতে। অরুর দিকে অন্যমনস্ক হয়ে তাকায় ইমতিয়াজ। যা ভেবেছিল ঠিক তাই। কান্না দেবী আজ মর্তে নেমে এসেছেন। অঝর ধারায় ঝরছে চোখের জল। ইমতিয়াজের সাহস হয়না নিষ্পাপ পবিত্র সেই স্রোতধারায় হাত বুলিয়ে মুছে দিতে। বরং ভাবে, থাক কাঁদুক। ভেতরের যা কষ্ট আছে, সব বের হয়ে যাবে কান্নার দমকে। কিন্তু কত কষ্ট আছে ঐ বুকে! ইমতিয়াজ বুঝতে পারেনা। কতটুকু কাঁদলে তা মুছে যাবে! বুঝতে পারেনা তা ও। ইমতিয়াজের মনে জেগে ওঠা কয়েকটা প্রশ্ন নিয়েই সে আপন মনে আবার ডায়রির পাতা খোলে নতুন কিছু জানার আশায়।


৩.
বাস থামে গন্তব্য-স্থলে।

অরু এরমধ্যেই চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিয়েছে। বাস-স্ট্যান্ডে নেমে অরুর স্বাভাবিক গলায় চমকে ওঠে ইমতিয়াজ। এইযে খালি হা করে দাড়িয়ে থাকলে হবে! একটা বেবিট্যাক্সি ঠিক করেন। ভুলতা, রূপগঞ্জ।

তিন চাকার যান ছুটে চলেছে রূপগঞ্জের দিকে। অরু নীরবতা ভেঙ্গে বলে।
- কি ইমতি খিমতি আপনাকে চিমটি দিতে হবে নাকি স্বপ্ন থেকে বাহির হবার জন্য। কি হইল আপনার?
- অ্যা মানে। না। ভাবছি।
- আপনি কি ভাবছেন আমি জানি। নিন আরও দুটো ডায়রি দিলাম। ২০০১ আর ২০০৫ এর ডায়রি। বুকমার্ক করা আছে। ওখানে গেলেই আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।

২০০৫ এর টা আগে বেঁছে নেয় ইমতিয়াজ।

২০০৫, ২৬শে সেপ্টেম্বর
এই প্রথম আমি কয়েকদিন কোন ডায়রি লিখিনি। আমার সাথে যা হয়েছে। এরপর ডাইরি লেখা তো দূরের কথা। বেঁচে আছি কিভাবে জানিনা। কিছুক্ষণ পর পরই মনে হচ্ছে এই দুর্গন্ধের জীবন আর রাখব না। এমনিতেই কালিমা লেগে আছে আগে থেকেই। এরপর আবার এটা কেন! উফফ কেন আমি বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করছিলাম। মেডিকেলের হস্টেলে থাকলে আজ আর আমার এটা হতনা। চাঁচার বাড়িতে থেকে পড়ার শাস্তি আমি পেয়ে গেছি। আমি আর ভাবতে পারছিনা। আমার আপন চাচাতো ভাই। সেদিন বাসার সবাই বিয়ের দাওয়াতে বাইরে গিয়েছে। আমার পরীক্ষা চলছে দেখে যায়নি। পাষণ্ডটা কখন পিছন থেকে এসে জাপটে ধরে আমাকে। আমি কিছু বোঝার আগেই তুলে নিয়ে ফেলে বিছানাতে। অসুরের প্রচণ্ড শক্তির কাছে পরাজিত আমি শুধুই চিৎকার করে ক্ষমা চেয়েছি। একটুও ক্ষমা দেখায়নি সেই দানবটা। ঘণ্টা ধরে সমস্ত কিছু লুণ্ঠন করে অজ্ঞান-প্রায় আমাকে ফেলে যায় পশুটা। চেতনা ফিরে পেতে আমি শুধুই ভাবি এটা কোন দুঃস্বপ্ন। এলোমেলো আমাকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠি সব হারানোর শোকে। চাচি আসলে কেঁদে সব বলি চাঁচিকে। বিহ্বল চাঁচি আমাকে বলে চুপ যা হবার হয়ে গেছে। সব ভুলে যা এখন। পরিবারের মানসম্মানের ব্যাপার এটা। চাঁচি একি বল তুমি! একটু সাপোর্ট কি আশা করা যায়না তোমার কাছ থেকে। চাঁচির একটাই কথা। দেখ মা, আমি বুজতেছি কি ক্ষতি হয়ে গেছে তোর। কিন্তু এটা জানাজানি হলে আরও বড় ক্ষতি হবে তোর। তোর কোন ভাল বিয়ে আমরা দিতে পারবনা। আমার ছেলেটা বদমাশ। এরপরেও তার কিছু হবেনা। মাজখান থেকে তোর জীবনটা নষ্ট হবে। সে রাতেই আমি ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ হোস্টেলে উঠে আসি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইমতিয়াজ পরবর্তী ডাইরিটা তুলে নেয়।

২০০১, ১১ই জুন
তারুণ্যের জোয়ারে যে আমাকে ভেসে যাবার কথা। সে আমার জীবনে এ কোন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হল। এটা কি সত্য! নাকি শুধুই গুজব। জানিনা। তবে সেই ছেলেবেলা থেকে ঘরের ঝি বুয়াদের মুখে শুনছি আমি নাকি কুড়িয়ে পাওয়া। আমাকে কেনা হয়েছে এই সংসারে। এতদিন ভাবতাম এ এক নিছক কল্পকাহিনী। কিন্তু কাল যে নির্ভরযোগ্য সূত্রের থেকে পেলাম কথাটা। সেটা ফেলি কি করে। আজকের বাজারে এক কেজি চাল ৩০ টাকা দরে নাকি আমি বিক্রি হয়েছিলাম এই পরিবারে। কটি মাত্র টাকার মাধ্যমে একটা জীবনের ঠিকানা বদলে যায়! এটা কি আসলেই সত্য। আমি জানিনা। আমাকে খুঁজতে হবে। সত্যটা। রহস্যটা। কেউ কিছু বলতে চায়না। সবাই এটাকে কাহিনী বানিয়ে হেসে উঠে। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয় ঘটনা সত্য। দুদিন পরে আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা। হায় খোদা, এটা তুমি কি শোনালে আমাকে। আমার যে পড়ায় মন বসছে না।

২০০১, ২রা ডিসেম্বর
পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হয়েছে। ২ মার্কের জন্য রেকর্ড মার্ক পাইনি। থাক কি হয়েছে। কি করব আমি রেকর্ড মার্ক দিয়ে। যার জন্ম নিয়ে এতো কাহিনী। তার এত সুখের কি দরকারই বা আছে। আমায় যে দিন দিন অসুখে ধরছে। কান্নার অসুখ। কি ওষুধে এর চিকিৎসা আছে! আমার জানা নাই। আচ্ছা। আমাকে যদি ৩০ টাকা দিয়ে না বিক্রি করত! তাহলে আজ বোধ হয় আমি পাতা কুড়ানি কোন মেয়ে হতাম। অভাবের সংসারে ছেড়া জামা কাপড় পড়ে পাতা কুড়িয়ে বেড়াতাম সারা শহর ধরে। এর থেকে এইযে কোটিপতির বিলাসবহুল সংসারে দারুণ ভাবে জীবন যাপন করছি। এটাই বা কজনের ভাগ্যে জোটে। হুমম ভাগ্য। হায়রে ভাগ্য। কার যে কিসে ভাগ্য লেখা থাকে। তা কে জানে!!! কি হত যদি আমার জন্ম পরিচয়টা ঠিক ঠিক থাকত। কি করব আমি এই বিলাসিতা দিয়ে। পাতা কুড়ানি জীবন হলেওতো জানতে পারতাম এই যে যাকে মা বলে ডাকছি। ইনিই আমার মা, যার নাড়ি ছিঁড়ে জন্মেছি। শুধু মাত্র ৩০টি টাকা, ৩০টি টাকা কি এই নাড়ি ছেড়া বাধনকে মুক্ত করে নতুন পৃথিবী তৈরি করে দিতে পারে কারও জন্য!!!

ইমতিয়াজের নিজের চোখের কোনাটা ভিজে আসে এবার। ডাইরির পাতা বন্ধ করে এক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে থেকে ভাবে। তাইতো, মানুষের এক জীবনে এত কষ্ট কেন হবে।


৪.
তিন চাকা ছুটে চলে ভাঙ্গা রাস্তা ধরে। গাড়ির ভিতরে কারও মুখে কোন শব্দ নেই। প্রচণ্ড ভোঁ ভোঁ শব্দের মাঝেও ইমতিয়াজ প্রচণ্ড পিনপতন নীরবতাকে উপলব্ধি করতে পারে। থাকুক এই নীরবতা।

গন্তব্যে পৌঁছে ইমতিয়াজ অরুর দিকে তাকায়। আমরা কি উনাকে দেখতে যাচ্ছি এখন?
হুমম। একটা ঠিকানা ধরিয়ে দিয়ে অরু বলে, এই ঠিকানাটা খুঁজে বের করে ওখানে আমাকে নিয়ে যাওয়াই আপনার একমাত্র কাজ।

একটা ছিমছাম ছনের জীর্ণ বাড়ি। লোকে লোকারণ্য বাড়ির উঠানটাতে। একটি খাটিয়া শোয়ানো উঠানের মাঝে। সবার শোকার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আদ্র হয়ে যায় ইমতিয়াজের মন। ভিড়ের পিছে চুপ করে দাড়িয়ে থাকে সে আর অরু। অরু হঠাত এগিয়ে যায় ইমতিয়াজকে টপকে। খাটিয়ার পাশে দাঁড়ানো এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করে, আমি কি একটু উনার মুখ দেখতে পারি? জি অবশ্যই আপনি পারেন, বলে মুখটা অনাবৃত করে দেয় উনি সাদা কাফন সরিয়ে। অরু অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে দেখে বলে ঠিক আছে আপনি ঢেকে দেন এবার। বলেই অরু সরে আসে ছিটকে ভিড় থেকে। ঝটিকে বের হয়ে যায় বাড়িটা থেকে। ইমতিয়াজ পিছু নেয় অরুর।

ইমতি প্লীজ আপনি আমার পিছন পিছন আসবেন না। প্লীজ।
অরু আপনি শান্ত হন প্লীজ। আমি বুঝতে পারছি আপনার মনে কি চলছে।
অগ্নিমূর্তি ধারণ করা অরু এবার ঝঙ্কার দিয়ে উঠে, আপনি কিছুই বুঝতে পারছেন না ইমতিয়াজ। আপনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। উনি আমার মা। আর আমি উনাকে দেখছি যখন উনি সব কিছুর ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছেন। আমি কাকে জিজ্ঞাসা করব মা তুমি আমাকে বেঁচে দিয়ে কি একটু কেদেছিলে!
অরু শান্ত হন। ওটা জিজ্ঞাসা করেই বা কি হত।
কি হত তার আপনি কি বুঝবেন ইমতি? কখনও কি শেকড়-বিহীন এক শেওলা হিসাবে নিজেকে নদীর স্রোতে ভেসে যেতে দেখেছেন? কখনও কি আশ্রিত পরিবারে ধর্ষিত হয়েছেন? আপনি কি বুঝবেন কিসে কি হত! আপনি আমার পিছনে আসবেন না আর। আমি একলাই ঢাকা যেতে পারব। আমাকে একটু একা থাকতে দিন প্লীজ।


জনম জনম ধরে
একা আমি একলা ভোরে
ছায়াবীথিতলে ঝরাফুল কুড়াব।
ভালবাসার সুতায় মালা গেথে
অচিনপথের অসীমে হেটে
মাগো তোমায় একদা ঠিক ঠিক পড়াব।

গাঁ এর মেঠো পথ ধরে অরুকে একা হেটে চলে যেতে দেখে ইমতিয়াজ। চারিদিকে আবার সেই পিনপতন নীরবতা ঘিরে ধরেছে। বাতাস বইতে ভুলে গেছে, পাখিরা ডাকা থামিয়ে দিয়েছে। প্রচণ্ড নীরবতার মাঝে অজানা পথের অজানা দিকে হেটে চলেছে সারা জীবনের এক দুঃখীনি মেয়ে অরুন্ধিতা।


উৎসর্গঃ মানব সেবাতে নিজের জীবন উৎসর্গকারী কোন এক অরুন্ধিতাকে (ছদ্মনাম), যার প্রতিদিনের কান্না ডাইরির পাতায় জমা হয়। পুনর্জনমে অরুন্ধিতার নাড়ির বাঁধন অটুট থাকুক এই প্রত্যাশায়...
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০১১ রাত ১:২৮
৮টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×