আমরা সবাই বাঙালি
১৯৭১ এ তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের নয় মাস ধরে যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংগঠিত হয়, তাতে পাকিস্তানি সেনারা আমাদের মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে। আমরা পাই বাংলার মাটি ও মানুষের স্বাধীনতা। কষ্টার্জিত এ স্বাধীনতার সুফল বাস্তবে পেতে প্রথমত: মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে ধরে রাখা আবশ্যক। দ্বিতীয়ত: মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক চেতনায় ধর্মীয় চিন্তাধারা ও আদর্শকে মূল্যায়ন।
স্বাধীনতার সময় আমার প্রকৃত বয়স মাত্র তিন বছর। সনদের সাথে বছরের অমিল রয়েছে। ঐ সময়ে তেমন কিছু না বুঝলেও পরবর্তী সময়ে যখন বড় হতে থাকি তখন আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার লোকজনদের কাছে স্বাধীনতা সংশ্লিষ্ট বাস্তব ঘটনাসমূহ শুনেছি। এমন কি, যুদ্ধের পরে টাংগাইল জেলার- ডিষ্ট্রিক পার্ক এলাকা পেরিয়ে যেতে যুদ্ধে আত্মদানকারী জানা-আজানা অসংখ্য শহীদের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হাড় পড়ে থাকতে দেখে ভয়ার্থ হয়েছি। যা আবছা আবাছা মনে পড়ে। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলার স্বাধীনতা অর্জিত হলেও যুদ্ধের ঘটনাবহুল ইতিকথার রেষ ছিলো ঐ সময়কার মানুষের মুখে মুখে অনেক দিন পর্যন্ত। ফলে; আমি উক্ত ঘটনা প্রবাহ সমূহের চাক্ষুষ সাক্ষী না হলেও শুনতে শুনতে মনে হয়; বাস্তবে আমি্ও যেন ছিলাম- তাদের সাথে।
বাংলাদেশের পরবর্তী ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ: বলতে গেলে; কখনো কখনো বিভিন্ন মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ভাবে অবলোকন এবং কখনো কখনো বুদ্ধি দিয়ে উপলব্ধি করেছি। ১৯৯০ এর গণ-আন্দোলনে আমিও ছিলাম সক্রিয়। আন্দোলনের পক্ষে পত্র-পত্রিকায় কবিতাও লিখেছি। ইচ্ছা রাখি; সম্ভব হলে আমার চিন্তা- চেতনায় বাংলার স্বাধীনতা থেকে গণআন্দোলন এবং পরবর্তী ঐতিহাসিক ঘটনাবলী সম্পর্কে কিছু লিখবো ইনশা-আল্লাহ। যা দেশ ও জাতিকে প্রকৃত তথ্য দিতে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে। কথা বলতে বলতে প্রসংগ থেকে কিছুটা দূরে চলে এসেছি।
প্রসংগটা ছিলো মূলত: প্রবন্ধের প্রথম অনুচ্ছেদে বর্ণিত দ্বিতীয় আদর্শ ভিত্তিক কথা। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালির ধর্মীয় চেতনা সম্পন্ন একটি পোষ্টার। পোষ্টারটি সম্পর্কে আমি বিশদ কিছু অবগত নই। ঐ সময়ে সংশ্লিষ্ট সম্মানিত ব্যক্তিগণই বলতে পারবেন বিস্তারিত।
এস,এস,সি পাশ করে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ চারুকলা ইনস্টিটিউটে ভর্তি হতে আসি। তখন লিখিত পরীক্ষায় টিকলেও পরে মৌখিকে বাদ পড়ে যাই। নিজের কাছে খুব খারাপ লাগে। ঐদিন সর্ব প্রথম ঢাকাস্থ শাহবাগ এর জাতীয় যাদুঘরে বেড়াতে যাই। তখনই সম্ভবত: প্রথম চোখে পড়ে উপরোক্ত পোষ্টারটি। পোষ্টার এর লেখাগুলো পড়ে আমার খুবই প্রশান্তি লাগে এবং আশান্বিত হই। আমার কাছে সেদিন স্বাধীনতা কেন্দ্রিক ঐতিহাসিক ধর্মীয় চেতনার কথা- স্পষ্ট হয়ে উঠে।
একাত্তরে যুদ্ধ বেঁধে ছিলো মূলত: পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পেতে। এর বিস্তারিত প্রমান বহন করে; ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে তাদের দেশি-বিদেশি হর্তাকর্তারা ভুল বুঝায়। তারা বুঝায়- এ যুদ্ধ ধর্মীয় যুদ্ধ। এ দেশের মানুষ সব বেঈমান তথা বিধর্মী হয়ে গেছে। এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শেষ করে দেয়া ঈমানদারের কাজ। এ জন্যই বোধ হয়; ঐ সময়কার পাকিস্তানি সৈনিকরা বাঙালিদের ধরে নিয়ে প্রথমেই বলতো- কালেমা বাতাও। কিন্তু উল্লেখিত পোষ্টারটাই প্রমান করে; বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা ছিলো না। এ প্রেক্ষাপটে ছিল মূলত: প্রত্যেক ধর্মই হলো যার যার গণতান্ত্রিক আদর্শ ভিত্তিক একটা নৈতিক অধিকার।
আমার মতে; একটি দেশের সব মানুষই যে একই সাথে কোন না কোন ধর্মীয় আদর্শের হয়ে যাবে তা কিন্তু চিরস্থায়ী ভাবে কোনদিন আশা করা যায় না। দুনিয়াতে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, মত এর মানুষ থাকবে। ধর্মহীনতাও থাকবে। এটা পূর্বেও ছিলো। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও এটা ব্যতিক্রম নয়। ধর্মহীনতা বিষয়টা কিন্তু কিছু মানুষের মস্তিষ্কগত একটা জটিল অবস্থা। দুনিয়াতে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে; কতো আস্তিক নাস্তিক হয়ে গেছে, কতো নাস্তিক আস্তিক হয়ে গেছে। কেউ কেউ হয়েছে– ধর্মান্তরিত। এটা যার যার চিন্তা-চেতনাগত ধর্মীয় অধিকার। আমার ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ না করলে সমস্যা কোথায়? মনে রাখা প্রয়োজন; হিদায়াত সৃষ্টিকর্তার হাতে। এতে মানুষের কোন হাত নাই। প্রচুর প্রমান দুনিয়াতে বিদ্যমান রয়েছে।
কেউ কেউ হয়তো বলতে চাইবেন; তাহলে আমাদের কি কোন দায়িত্ব নাই? হ্যাঁ; আছে। আমার মতে প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত দায়িত্ব হলো; আগে নিজে সংশোধন হওয়া তথা নিজ নিজ ধর্মীয় আদর্শের ভিত্তিতে নৈতিক চেতনা সম্পন্ন হওয়া। ধর্মের প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করে তা ব্যক্তিগত জীবনে সুন্দর ভাবে প্রতিষ্ঠা করা। সম্ভব হলে; পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য উপকারী বিষয়সমূহ যথাযথ ভাবে তুলে ধরে মানুষকে প্রকৃত মানুষ করে গড়ে তুলবার শান্তিময় প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।
ব্যক্তি থেকেই পরিবার। পরিবার থেকে সমাজ। সমাজ থেকে রাষ্ট্র। ধর্ম কারো উপর চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়। বর্তমানে আমাদের দেশের অধিকাংশ নাগরিক মুসলমান। একজন মুসলমান হিসাবে আমিও চাই; রাষ্ট্রধর্ম 'ইসলাম' থাকুক। ২০১১ সালে সংবিধানে প্রতিস্থাপিত ২ (এ) অনুচ্ছেদে বর্ণিত- “প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবে” আইনটি বেশ উপযুক্ত মনে হয়। যদিও ভবিষ্যত রায় এখন নির্ভর করছে; মহামান্য হাইকোর্টের চিন্তা-ভাবনার উপর।
দেশ প্রেমিক নাগরিক হিসাবে আমাদের উচিত; স্বাধীনতার অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে; মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অক্ষুন্ন রেখে ধর্মীয় চেতনার ক্ষেত্রে সহনশীল হওয়া। যেখানে আমরা সবাই বাঙালি; ধর্মীয় পরিচয় যাই হোক যার যার। এছাড়াও জাতীয়তার ভিত্তিতে আমরা সবাই বাংলাদেশি। আদিবাসি মানুষ হিসাবে পরিচিত ভাই-বোনেরা আমাদের মানুষ তথা আমাদের দেশের নাগরিক। দেশ প্রেমিক প্রতিটি নাগরিকের প্রতি প্রতিটি নাগরিকের রচিত হোক পারস্পরিক-সম্মানবোধ। এ আশা ব্যক্ত করে শেষ করছি; আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা সবাই বাঙালি।
* জানিনা লেখাটি কেমন হলো! নিজের চিন্তা-ধারা দেশ ও জাতির স্বার্থে প্রকাশ করলাম। কাউকে হেয় করার উদ্দেশ্যে লিখিনি। তদুপরি ভুল ত্রুটি মনে হলে সুন্দর ভাবে জানালে মেনে নিবো ইনশা-আল্লাহ। দু'আর দরখাস্ত।
ধন্যবাদান্তে:
মো: মিজানুর রহমান ওরফে হাকীম আল-মীযান।
লেখার তারিখ: ২৬/০৩/২০১৬ ইং ।
সময়: সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১ টা।
কৃতজ্ঞতা: ছবি: সামহোয়্যার ইন ব্লগ।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মে, ২০১৬ সকাল ৮:৫০