হাকীম আল-মীযান।
মহান আল্লাহপাক সৃষ্ট অগণিত মাখলুকাতের মাঝে মানুষ হলো-‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে মানুষকে তার কিছু স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে চলতে হয়। তাকে খেতে হয়, ঘুমাতে হয়, প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে হয়- ইত্যাদি। এমন কি একদিন মৃত্যুকে স্বাগত জানিয়ে দুনিয়া থেকে চলে যেতে হয়। এ সব স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের দিক বিবেচনা করলে পৃথিবীর কোন মানুষই কোন মানুষের উর্ধ্বে নয়। বিপরীতে কোন মানুষই কোন মানুষের নিম্নেও নয়। সুতরাং আমরা নারী-পুরুষ যেই হই না কেন, সবাই কিন্তু মানুষ ভিন্ন অন্য কিছুই নই।
পুরুষ ও নারী আলাদাভাবে; পুরুষেরা যেমন পুরুষদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের উর্ধ্বে বা নিম্নে নয়, নারীরাও তেমনি নারীদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের উর্ধ্বে বা নিম্নে নয়। পুরুষেরা যেমন তাদের স্বকীয় মন ও দৈহিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে চলছে; নারীরাও তেমনি তাদের স্বকীয় মন ও দৈহিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে পৃথিবীতে অবস্থান করছে। পুরুষ ও নারীর মধ্যে নারীদের চেহারা, গলার স্বর, স্তন, লজ্জাস্থান তথা সন্তান ধারণ ক্ষমতার দিক দিয়ে যদিও পুরুষের সাথে পার্থক্য লক্ষণীয় তবুও আত্মিক দিক বিবেচনা করলে আমরা সবাই একই মানব জাতির অন্তর্ভুক্ত।
মানব সমাজে পুরুষ ও নারী উভয়েই মানুষ হয়েও লিঙ্গগত কারণে পুরুষের কিছু কাজ আছে; যা নারীর দ্বারা সম্ভব নয়। তেমনি নারীদের কিছু কাজ আছে; যা পুরুষের দ্বারা সম্ভব নয়। বিপরীতে উভয়েই মানুষ হবার সুবাদে লিঙ্গগত পার্থক্যের মাঝেও ‘মানুষ’ শব্দটার সাথে অমিলের কোন অবকাশ নাই। পুরুষ ও নারী যেই হোক না কেন, মানুষ হিসাবে উভয়েই জন্মগ্রহণ করে প্রত্যেকেরই মাতৃ উদরে। দৈহিক ভাবে উভয়ের হাত, পা, চোখ, কান ইত্যাদি আছে। এমন কি কথা বলা, চিন্তা-ভাবনা করা, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, প্রশ্রাব-পায়খানা ইত্যাদি সুযোগ সুবিধাসমূহ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে উভয়ের মাঝেই বিস্তর সাদৃশ্য বা মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
এখন কথা হলো, আমরা মানুষ নারী অথবা পুরুষ; দুনিয়াতে আসার আগে জানতাম না; আমরা একদিন দুনিয়াতে আসবো। মানব সৃষ্টির শুরুতে একদিন আলমে আরওয়াহ-তে মহান আল্লাহপাক যখন আমাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন- আমি কি তোমাদের রব নই? তখন আমরা উত্তরে; হ্যাঁ, বলে স্বীকার করেছিলাম। তবে এই রব বলে স্বীকার করার বিষয়টি দুনিয়াতে মানুষ হিসাবে আসার অনেক পূর্বের এবং রূহ জগতের ঘটনা বিধায়, এখন আমাদের তা মনে নাই। শুধু কুরআন ও হাদীস থেকে জেনে; আমাদের তা বিশ্বাস করতে হয়।
আমরা এটাও জানতাম না; দুনিয়াতে কে পুরুষ আর কে নারী হিসাবে আসবে। পুরুষ বা নারী হিসাবে আসার কথাটা বুঝতে অর্থাৎ লিঙ্গগত পার্থক্য বুঝতে একজন মানুষের জন্মের পর থেকে অনেক দিন সময় লেগে যায়। জন্মের অন্তত: চার থেকে পাঁচ বছর পর সে জানতে পারে; সে ছেলে না মেয়ে! শুধুমাত্র এই কথাটুকু। কিন্তু তখনই সে পুরুষ বা নারী হিসাবে দুনিয়াতে আসার লিঙ্গ ভেদের প্রকৃত হকীকত বুঝে উঠতে পারে না। এ জন্য তাকে অবশ্যই বালেগ-বালেগা হতে হয়।
দুনিয়াতে আসার আগে মহান আল্লাহপাকের দরবারে আমরা এমন দরখাস্ত করি নাই যে, হে আল্লাহ; তুমি আমাকে দুনিয়াতে পাঠাও এবং আমার পছন্দমত পুরুষ বা নারী হিসাবে পাঠাও। সুতরাং দুনিয়াতে আমাদের প্রথমত: মানুষ হিসাবে এবং দ্বিতীয়ত: পুরুষ বা নারী হিসাবে আসাটা সম্পূর্ণ ভাবে সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহপাকের একান্ত ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।
এই পুরুষ ও নারী সে যেই হোক না কেন; মানুষের দুনিয়াবী জীবনে অনেক বিষয় আছে; যা উভয়ের জীবনেই স্বভাবগত সত্য। এ কথা অত্র লেখার শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন-মানুষের খাওয়া-দাওয়া, কথা বলা ইত্যাদি। এরূপ আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো: প্রত্যেক মানুষ এর দ্বারাই সওয়াব এবং গুনাহের কাজ সংগঠিত হওয়া সম্ভব। নবী, রাসূল, সাহাবী, আল্লাহর ওলিদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহপাক দ্বীনের স্বার্থে যাঁর যাঁর মর্তবা অনুযায়ী বিশেষ ভাবে হিফাজত করেছেন এবং হিফাজতে থাকার প্রয়োজনীয় শক্তি প্রদান করেছেন। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও এই হিফাজত পাওয়া এবং হিফাজতে থাকার সুযোগটা উনাদের মতো উচ্চ মর্তবার না হলেও আমাদের মর্তবা অনুযায়ী সেই সুযোগ রয়েছে। তবে তা সাধারণ মানুষেরা অনেক সময় বুঝে উঠতে পারে না আবার বুঝতে পারলেও সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হয় না।
আমরা যদি মহান আল্লাহপাকের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে সুপথে চলতে চাই, তবে মহান আল্লাহপাক কুদরতী সাহায্য দিয়ে থাকেন। আর যদি তা না চেয়ে বরং বিপথে চলতে থাকি, তবে দিনে দিনে সে মানুষটার অন্তর তালাবদ্ধ হয়ে যায় এবং বিপথে অবস্থান করতে থাকে। প্রত্যেক মানুষের সুপথে বা কুপথে চলা এবং বিনিময়ে সওয়াব বা গুনাহ করার স্বাধীনতা অর্থাৎ এখতিয়ার মহান আল্লাহপাক প্রত্যেক বিবেক সম্পন্ন মানুষ তথা নারী ও পুরুষ উভয়কেই দান করেছেন। এ কারণেই; প্রত্যেক মানুষ যার যার কৃতকর্মের জন্য দায়ী হবেন।
মহান আল্লাহপাক প্রদত্ত আমাদের ভালো-মন্দ কাজ করার স্বাধীন ক্ষমতা, আমরা বিবেক দিয়ে যে ভাবে কাজে লাগাই, ঠিক সে ভাবেই কাজের বাস্তবায়ন তথা ফলাফল প্রকাশিত হয়। মানুষ যেহেতু অন্যান্য প্রাণীর মতো নয়। তাকে সম্মানিত করা হয়েছে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ হিসেবে। অন্যান্য প্রাণী তথা পশু-পাখি, জীব-জন্তু মানুষের মতো মহান আল্লাহপাকের প্রতিনিধিত্বের দায়িত্বে দায়িত্বশীল নয়। তারা মানুষের মতো শক্তিশালী মস্তিষ্ক সম্পন্ন বিবেকবান প্রাণীও নয়। মানুষ তার জ্ঞান ও বিবেক দিয়ে সৎকর্ম করতে পারঙ্গম। সে তার বিবেক দিয়ে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করে, তা স্বকীয় জীবনে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম। এ ক্ষমতা অবশ্য জ্বীন জাতিকেও দেয়া হয়েছে।
এখন মহান আল্লাহপাক মানুষের কাছে এটাই চান যে, তার বান্দা-বান্দী মানুষ তাঁর পথে চলুক। নফ্স এবং শয়তানের পথে না চলুক। সুতরাং বুঝা গেলো, মানুষকে যদিও ভালো-মন্দ কাজ করার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে কিন্তু আল্লাহপাক মানুষকে ভালো পথে চলার জন্যই সত্যের সৈনিক রূপে সৃষ্টি করেছেন। এখন কথা হলো; সত্যের সৈনিক মানুষ যদি আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান ও বিবেক দিয়ে প্রকৃত সত্যকে জানতে এবং মানতে সক্ষমই হয়, তবে সে কেন প্রায়শই সোজাপথে চলতে ব্যর্থ হয়? পদে পদে ভুল করে বসে এবং গুনাহের কাজে লিপ্ত হয়ে যায়। এ সব প্রশ্নের উত্তর; আমাদের জানা থাকা দরকার। এর প্রধান কারণ হলো: সোজাপথে চলতে কিছু বাঁধা আছে। এ বাঁধাও মহান আল্লাহপাক প্রদত্ত। বাঁধা না থাকলে সোজাপথে চলার আনন্দ থাকতো না। বাঁধা প্রধানত: দু’প্রকার:- এক: নফসের বাঁধা, দুই: শয়তানের বাঁধা। শয়তানের বাঁধা আবার দু’ প্রকার-১। জ্বীন শয়তান দ্বারা সৃষ্ট বাঁধা, ২। মানুষ শয়তান দ্বারা সৃষ্ট বাঁধা।
সংশ্লিষ্ট কিছু কথা:
১। লেখাটি ইসলামী মানসিকতায়; ইসলাহে নফস তথা রূহানীয়াতের আঙ্গিকে রচিত।
কাকতালীয় ভাবে; কোন ক্ষেত্রে কোন কিছু মিলে গিয়ে কারো কষ্টের কারণ হলে
আন্তরিক ভাবে দু:খিত। সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে বললে, সংশোধন করে দিব এবং
দয়া করে মাফ করে দিলে আন্তরিক ভাবে খুশি হবো।
২। লেখাটির আরো দু'টো পর্ব রয়ে গেছে।
সময় সুযোগ পেলে উপস্থাপনের আশা রাখি ইনশা-আল্লাহ।
৩। বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে আমার রয়েছে;
সব ধর্মের মানুষের প্রতি সমান শ্রদ্ধা।
দু'আ চেয়ে ইতি টানছি।
হাকীম আল-মীযান।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০১৬ রাত ১২:৫৫