দুনিয়াতে মানুষ মরণশীল। এ কথা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে মানতে হয়। বাস্তব চোখে যা দেখি, তা তো আর অস্বীকার করা যায় না।
একজন কবি ভাই ছিলেন, তিনি আমাকে বলতেন, আচ্ছা বলোতে দেখি, আমরা কারা? আমি বলতাম; আমরা মানুষ। উই আর হিউম্যান। দ্যাট মিন্স; মানব জাতির অন্তর্ভুক্ত; মানব সদস্য আর কি! বাবা আদম এবং মা হাওয়া আ. থেকে এ যাবৎ মহান আল্লাহপাক দুনিয়াতে কতো মানুষ পাঠিয়েছেন। মানব সমাজে কতো জাতি, কতো ধর্ম, কতো বর্ণ, কতো ভাষার সমাহার! সত্যিই তুলনাহীন।
আদম এবং হাওয়া আ. সৃষ্টির পর থেকে শুরু করে- মানুষ যদি মরণশীল না হতো, তবে বিশাল মানবসমুদ্র সামাল দিতে মানুষকেই হিমসিম খেতে হতো। মহান আল্লাহপাক চাইলে অবশ্য সে সমাধানও আমাদের করে দিতে পারতেন। কিন্তু সে নিয়ম তিনি, এ দুনিয়াতে রাখেন নাই।
যখন আমি জানতাম না; দুনিয়া মানুষের জন্য একটা পরীক্ষা ক্ষেত্র। এখানে মানুষ স্বল্প সময়ের জন্য আসে পরীক্ষা দিতে। তখন আমার দুনিয়াটাকে বুঝতে খুব কষ্ট হতো। বিভিন্ন জা’গায় বিভিন্ন অমিল খুঁজে পেতাম। দুনিয়াতে সব কিছুই সাজানো গুছানো থাকবে, এমনটাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আশা করতাম।
আসলে দুনিয়া তো সাজানো গুছানোই। তবে তা প্রাকৃতিক ভাবে। প্রাকৃতিক ভাবটাকে আমাদের বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন, আমাদের হস্তক্ষেপ সমৃদ্ধ কৃত্রিমতার। যুগে যুগে মানুষ মহান আল্লাহর দেয়া মানসিক ও শারীরিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আজকের ডিজিটালাইষ্ট পৃথিবীকে বানিয়ে তুলেছে এক পরিবার ভুক্ত। যে সুবিধাও পাচ্ছেন; জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে।
মরণশীল; এ মানুষ যত দিন দুনিয়াতে বেঁচে থাকেন এর নাম হলো: হায়াতী জিন্দেগী। ইসলামী চিন্তাধারায় হায়াতী জিন্দেগীর মূল কাজ প্রধানত: দুটি। এক: আল্লাহর হক আদায় এবং দুই: মানুষের হক আদায়। এ দু’টি হক ঠিক মতো আদায় করতে পারলে অনন্তকালের পরকালীন জিন্দেগী শান্তি ও সুখময় হবে বলে আশা করা যায়।
লেখার শুরুর দিকে আমাদের পরিচয় দিয়েছিলাম; মানুষ এবং মানব জাতির সদস্য হিসাবে। মানুষ শব্দের সন্ধি বিচ্ছেদ সম্পর্কে আমার জানা নাই। তবে অনেকে এভাবে মিল দিয়ে থাকেন। মান+ হুশ=মানুষ। তারা বুঝাতে চান, যার মান এবং হুশ আছে; তিনিই মানুষ। এ মিলটা আমার কাছে খুবই ভালো ও যথোপযুক্ত মনে হয়। আমি যদি কোন কাজ করার আগে, আমার মান-সম্মানের দিকে তাকাই এবং হুশ মতো কাজ করি, তবে সন্ধি বিচ্ছেদ হোক বা না হোক, অন্তত: মানুষ নামটার স্বাথর্কতা খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
আমার কলেজ লাইফে ফেইসবুক ও ব্লগহীন যুগে; একটা চার পৃষ্ঠার লিফলেট জাতীয় কবিতপত্রে কয়েকটা কবিতা লিখে তা ছেপে ছাত্র-ছাত্রী ভাই-বোনদের মাঝে বিতরণ করে প্রচার করেছিলাম। তখন আমি মানুষ সম্পর্কে অতো কিছু বুঝতাম না। এখনই যে খুব বুঝি তাও বলা ঠিক নয়। যেদিন বুঝলাম, মানুষ নিয়ে গবেষণা অনেক ব্যাপক এবং বিশাল ব্যাপার। সেদিন থেকে মানুষ নিয়ে গবেষণা ও চিন্তা-ভাবনা কমিয়ে দিলাম এবং নিজেকে মানুষ রূপে গড়ে তোলার তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। তদুপরি, কি কারণে জানি? আমি এখনো মানুষ নিয়েই লেখালেখি করে ফেলি তথা লিখতে বেশি পছন্দ করি!
ঐ সংকলনে একটা কবিতার লাইন গুলো ছিলো এরকম;-সবার উপরে মানুষ সত্য/ তার উপরে নাই/ তাই যদি হয়/ মানুষ চেনা বড় দায়?/ নিজেকে চিনিবে যে/ মানুষ চিনেবে সে/ সে হবে বাস্তব সন্ধানী/ পরিচয় তার আপন যোগ্যতায়। হ্যাঁ! মানুষ হতে গেলে যোগ্যতা লাগে। শুধু হাত-পা, মুখমন্ডল তথা শারীরিক দিক দিয়ে মানুষ হলেই মানুষ মানুষ হয় না। মানুষ হতে গেলে, তার মন তথা অন্তরকে মানুষ করে গড়ে তুলতে হয়। কথা-বার্তা, কাজ-কর্মে মানবতাকে ফুঁটিয়ে তুলতে হয়। মুখে বলি এক, আর কাজে করি আরেক; এমন হলে তো আর প্রকৃত মানুষ হওয়া যাবে না। হওয়া যাবে অন্য কিছু। অন্য কিছুর অদ্যাক্ষর অ; কে মানুষ শব্দটির আগে জুড়ে দিলে যা হয় আর কি!
মানুষকে মানুষ ভিন্ন অন্য কিছু থেকে নিজেকে সামাল দিতে হলে, সবার আগে নিজেকেই একজন প্রকৃত মানুষ হতে হবে। দুনিয়ায় চলার পথে বিভিন্ন বাঁধা বিপত্তি আসবেই। এটাই তো পরীক্ষা। বিভিন্ন ধরণের যতো পরীক্ষাই আসুক; মানুষকে তবু প্রকৃত মানুষ হবার পথেই এগিয়ে যেতে হবে। নিজের ভেতরের অমানুষকে পরাজিত করে জয় করতে হবে, মানবতা তথা মনুষ্যত্বকে। ঐ প্রকাশনায় আরো লিখেছিলাম- মানুষ দু’দিকে ধাবিত হয়/ভালো আর মন্দ ব্যতীত/অন্য কিছুতে নয়/সাধুর সাধুত্ব কর্মহীন নয়/বিবেক সাথে সাথে বয়/ সমাধান খুঁজে বেড়ায়/প্রতিটি জীবনের/ চিরন্তণ দ্বন্দের।
সংকলনে আরো একটা লেখা ছিলো; যা পাঠকদের সামনে তুলে না ধরে পারছি না- মন!/ যার চাক্ষুষ প্রমান না থাকলেও/ অনুবীক্ষণহীন আছে বিশ্বাসে/পবিত্রতা!/ কি ধরণের পদার্থ জানিনা/ তবুও আছে অনুভবে/ মন যখন হৃদয়ের ধারক-বাহক/যেমনি চালাও তেমনি চলে/তুমি ঠিক তেমনি/ আমার অন্তলোকে/ বার বার ভেসে ওঠো/ হৃদয় অদৃশ্য, তুমিও অদৃশ্য/ মিল হোক এবার হৃদয়ে হৃদয়। কি কারণে কেন লিখেছিলাম? কি’বা বুঝাতে চেয়েছিলাম; তখনকার কথা এখন স্পষ্ট মনে নাই। তবে এখন বুঝতে পারছি যে; বাস্তবমুখী মানুষকেও অনেক কিছু না দেখেই বিশ্বাস করতে হয়। এ দুনিয়াতে আমি একদিন ছিলাম না, একদিন থাকবো না। এ ধ্রুব বাস্তব সত্য একদিন অদৃশ্যেই ছিলো এবং একদিন অদৃশ্যেই চলে যাবে।
উক্ত কবিতাটির নিচে একটা মন্তব্য কোত্থেকে যেনো সংগ্রহ করে সাথে নিজে কিছু লিখে মিলিয়ে দিয়েছিলাম। তা ছিলো: বাঁশরীর ক্রন্দন সংগীত গীত হয়, বাদকের ওষ্ঠ-পুষ্ঠে যুক্ত হয়ে। মওলানা রুমীও তাঁর আপন বিরহ বেদনা প্রকাশের জন্য খুঁজে ফিরেছেন একজন সমব্যথী, কাতর, বিদগ্ধজন। যার আত্মার সাথে তাঁর আপন আত্মা হবে সংযুক্ত। কথা বলে ওঠবে দু’টির পরিবর্তে একটি মাত্র আত্মা।। এখানে আমি মানুষের সাথে মানুষের আত্মার সুসম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা যে পূর্বের মনিষীরাও উপলব্ধি করেছেন; সে কথা তুলে ধরতে চেয়েছিলাম। যা থেকে আমরাও কোন ভাবে মুক্ত নই। আমাদের মানুষ নামের বাঁশরী এখনো আর্তনাদ করে ঘুরে বেড়ায় আমাদেরই মাঝে।
মানুষের সাথে মানুষের আত্মার যে সুসম্পর্ক এটা হলো: বান্দার সাথে বান্দার হক। আর আল্লাহর সাথে মানুষের আত্মার যে সম্পর্ক; এটা হলো: আল্লাহর হক। প্রকৃত মানুষ হতে হলে; উভয়টাই ঠিক রাখতে হবে। তাহলেই আসবে, অনন্ত জীবনে বাস্তব সফলতা। এ সফলতা অর্জনের জন্য চলতে হবে; মহান আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক, নবী স: এর পথে। যদি আমরা কেউ নিজেকে শেষ নবীর উম্মত হিসাবে পরিচয় দিতে চাই। তবে আসতেই হবে; কুরআন এবং হাদীসের মতে। মনে রাখতে হবে, দুনিয়ার এ সংক্ষিপ্ত জীবন এর উপরই নির্ভর করছে; অনন্ত কালের আখেরাতী জিন্দেগী।
কুরআন এবং হাদীস এর মতে; প্রত্যেক জীবকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করতে হবে। এ মৃত্যুর কারণেই আমরা দুনিয়াতে আমাদের চিরস্থায়ী ভাবতে পারি না। তাই ভাবি; মানুষ মরণশীল। ইংরেজিতে বলি; ম্যান ইজ মরটাল। মরটাল শব্দটা যদি মানি, তাহলে প্রত্যেক মানুষকেই একবার ভেবে দেখা উচিত; হোয়াট ইজ হোয়াট? আসলে প্রকৃত সত্যটা কি? নিজের ভেতরে প্রকৃত সত্য আবিস্কারের দায়িত্ব প্রত্যেকের নিজের উপরই বর্তায়। কারণ আমরা শুধু মানুষই না। মানুষ হিসাবে আমরা এক শ্রেষ্ঠ জাতি তথা আশরাফুল মাখলুকাত এর অর্ন্তভুক্ত।
মরটাল কিন্তু আশরাফুল মাখলুকাত মানুষকে দুনিয়াদারী করার জন্য দু’টো আত্মিক বৈশিষ্ট্য দেয়া হয়েছে। একটা হলো নাফস আর একটা হলো রূহ। যা আমাদের দেহে আত্মিক থেকে মানসিক আচরণ হয়ে ফুঁটে ওঠে। কাজ করে জ্ঞান, আবেগ এবং মনোপেশীজ ক্ষেত্রে। রূহকে আল্লাহর ইবাদত তথা স্মরণ এর মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন করে নাফসকে নিয়ন্ত্রণ এ রেখে, মস্তিষ্ক এবং দেহ পরিচালনাই হলো: নিজেকে সর্বদা প্রকৃত মানুষ করে রাখার রূহানী উপায়। যে উপায় মানুষকে নানাবিধ নৈতিক তথা মানবিক গুণাবলী অর্জনে বিশেষ ভাবে সহায়তা করে।
আমার লেখা একটা রূহানী গজলের কয়েকটা লাইন দিয়ে ‘বাঁশরীর আর্তনাদ’শেষ করছি; দুনিয়াতে ছিলাম না একদিন/দুনিয়াতে থাকবো না চিরদিন/ মাটির ঐ অন্ধকার ঘরে /কাটাতে হবে বহুদিন। /মুনকার-নাকির করবে সুয়াল /হতে হবে তাদের সম্মুখীন/তোমার বর কে? রাসূলই বা কে?/দুনিয়াতে কি ছিলো তোমার দ্বীন?/ কবর থেকে হাশরের ময়দানে/ উত্থিত হবে সবাই একদিন/যার যার চিন্তায় সে’ পেরেশান!/ বিচারের রায় হবে; কি সে’দিন?
প্রবন্ধ সংশ্লিষ্ট কিছু কথা:
আলোচ্য 'বাঁশরীর আর্তনাদ' প্রবন্ধটি ইসলামী চিন্তা-ভাবনায় রূহানী চেতনায় রচিত। মানুষ বলতেই ভুল-ভ্রান্ত্রি থাকাটা অসম্ভব কিছু না। আমি চেষ্টা করছি; আমার গবেষণা ও উপলব্ধির মাধ্যমে আমার স্ব-জাতি মানুষ ভাই-বোনদেরকে মানুষ বিষয়ে আরো উচ্চতর গবেষণা করে; প্রকৃত সত্য আবিস্কারে উৎসাহিত করতে। কারো কাছে ভালোলাগলে আমি আন্তরিক ভাবে খুশি হবো। দুনিয়াতে এটাই স্বাভাবিক যে, সবার মত কখনো এক হবে না। নানা মানুষের নানা মত, নানা পথ তো আসলে; মানুষের মাঝে মহান আল্লাহপাকের অসীম ক্ষমতারই বহি:প্রকাশ। আবারো প্রশ্ন? আমরা কারা? আসলে; আমরা তো মানুষ বৈ অন্য কিছু নই।
পরিশেষে; লেখক, ব্লগার, পাঠকসহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে দু’আ প্রার্থী।
মহান আল্লাহপাক আমাদের উত্তম বুঝ এবং প্রকৃত মানুষ হবার তৌফিক দান করুন-আমীন।
ধন্যবাদান্তে: হাকীম আল-মীযান।
লেখার সঠিক তারিখ মনে নাই:
২০১৫ এর শেষ দিক থেকে ২০১৬ এর প্রথম দিকে হবে।
পুনরায় সম্পাদনা করেছি আজ: ১০/০৯/২০১৬ ইং। রাত ১২টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত।
হাকীম আল-মীযান।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:২৭