বাংলাদেশে অপরাধ বৃদ্ধির কারণ কি?
পৃথিবীর সব চাইতে উন্নত ও সভ্য দেশগুলোতে অপরাধ নেই বললেই চলে। যেমন ফিনল্যান্ড, জাপান, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ইত্যাদি। নেদারল্যান্ডসে অপরাধীর সংখ্যা শূণ্যের কোঠায় চলে যাওয়ায় সেখানে কারাগারগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দেশটি ২০১৩ সালে একসাথে ১৯ টি ও ২০১৫ সালে আরো ৫টি কারাগার বন্ধ করে দেয়। অপরাধী না থাকার কারণে তারা অন্য দেশ থেকে অপরাধী আমদানী করছে জেলখানা ভরাবার জন্য। অন্যদিকে বাংলাদেশে হত্যা, গুম, ধর্ষণ, ডাকাতি, প্রতারণা, জবরদখল, ঘুষ, দুর্নীতি, রাহাজানিতে সমাজের জেরবার অবস্থা ও জেলখানাগুলো কয়েদিতে উপচে পড়ার কারণে এশিয়ার বৃহত্তম কারাগার নির্মিত হয়েছে এদেশে। এখানে অপরাধীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে জ্যামিতিক হারে। কেন?
সমাজবিজ্ঞানীরা বলবেন, সুষ্ঠু সামাজিক পরিবেশের অভাব, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলবেন, সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ নেই, প্রশাসন বলবে, সত্যিকারের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারা, মনোবিজ্ঞানীরা বলবেন, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, শিক্ষাবিদরা বলবেন, প্রকৃত শিক্ষার অভাব, আইনশৃংখলা বাহিনীর লোকেরা বলবেন, জনবলের অভাব, ধর্মীয় নেতারা বলবেন, ধর্মীয় অনুশাসন না মানা, গরীবরা বলবেন, অভাবে স্বভাব নষ্ট, ধনীরা বলবেন, দুষ্টামী, সরকার বলবেন, বিরোধীদের প্রচারণা, আল ইজ ওয়েল।
ওসব দেশ, যেমন নেদারল্যান্ডসে অপরাধ কমে যাবার কারণ কি?
১। ধর্মীয় কুসংস্কারমুক্ত ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থাঃ
ইউরোপের সবচেয়ে কম ধর্ম পালনকারীদের দেশ নেদারল্যান্ডস। ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদার ধর্মীয় সংস্কৃতির দেশ। ধর্ম নিরপেক্ষ এই রাষ্ট্রের ধর্মীয় কুসংস্কারমুক্ত ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে উদার হতে সাহায্য করছে। রেডবাড ইউনিভার্সিটি ও ভির্জি ইউনিভার্সিটি আমস্টার্ডামের এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, ১৯৬৬ সালে মুক্তচিন্তার মানুষের সংখ্যা যেখানে ছিল ৩৩ শতাংশ, সেটা ১৯৭৯ সালে ৪৩ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে ৫৩ শতাংশ, ২০০৬ সালে ৬১ শতাংশ এবং ২০১৫ সালে ৬৭ দশমিক ৮ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই সংখ্যা ২০২০ সালে ৭২ শতাংশে গিয়ে ঠেকবে।
২। অপরাধীদের পুনর্বাসনঃ
নেদারল্যান্ডসে কয়েদিদের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-
(ক) মাদক আইন শিথিল করা। ফলে মাদকসেবীদের শাস্তি দেওয়ার বদলে তাদের পূনর্বাসনে জোর দেওয়া হয়েছে।
(খ) এঙ্কেল মনিটরিং ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় কয়েদিদের জেলে বসিয়ে রাষ্ট্রীয় অন্ন ধবংস না করে তাদের পায়ে ট্রাকার ( অপরাধীর অবস্থান জানা ও পালিয়ে গেলে সনাক্ত করার ব্যবস্থা) লাগিয়ে সমাজে বিভিন্ন ইতিবাচক খাতে কাজে লাগানো হচ্ছে। তাতে করে সে নিজের উপার্জন নিজে করার পাশাপাশি নিজের ভুল থেকেও শিক্ষা নিতে পারছে।
৩। সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাঃ
আরেকটা জিনিস যেটা অপরাধী কমাতে সাহায্য করছে, সেটা হলো সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কোনো অপরাধী সাজা খেটে বের হলে তাকে সুস্থধারায় ফেরানোর জন্য উপযুক্ত কাজের ব্যবস্থ্য করা, যা কি না খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও নেই। ফলে মার্কিন কয়েদির সংখ্যা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। প্রতি ১ লক্ষ জনগণের মধ্যে অপরাধীর সংখ্যা ৭১৬ জন, যেখানে নেদারল্যান্ডসের প্রতি লাখে অপরাধীর সংখ্যা মাত্র ৬৯ জন।
৪। অপরাধ ও অপরাধীদের সম্পর্কে মানুষ ও রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তনঃ
নেদারল্যান্ডসের মানুষই অতীতে জলদস্যু ছিলো; অপরাধপ্রবণ জাতি হিসেবে তাদের দুর্নামও ছিলো। এখন সেখানে অপরাধকে ঘৃণা করা হয়; কিন্তু অপরাধীকে নয়। আর কারাগারকে দেখা হয় সংশোধন কেন্দ্র হিসেবে। সেখানে রাষ্ট্র ও সমাজ মানুষকে নীচ-নিকৃষ্ট বলে মনে করেনা; বরং মানুষকে দেখে অসীম সম্ভাবনাময় হিসেবে; কারণ প্রত্যেক মানুষের মধ্যে মন্দ থেকে ভালো হবার সম্ভাবনা থাকে প্রবল। আর রাষ্ট্রে একটি সতত মুক্তভাবনার পরিবেশ থাকলে তা রাষ্ট্রটিকে কখনোই কারাগার রাষ্ট্রে পরিণত করেনা; বরং কারাগারগুলোকে সংশোধন কেন্দ্রে পরিণত করে একসময় অপরাধী শূণ্য করে ফেলতে পারে পুরো সমাজকেই।
বাংলাদেশ প্রেক্ষিতঃ
কারাগারে আটক অপরাধীর সঙ্গে পাশবিক আচরণের যে আদিম রেওয়াজ চালু আছে, তা দিয়ে অসংখ্য অপরাধীর সঙ্গে অমানবিক আচরণ করে সংশোধনের কোন দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায়নি; বরং সমাজ হারিয়ে গেছে অপরাধের গোলক ধাঁধায়; ক্রমে ক্রমে পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রই যেন কারাগার হয়ে পড়েছে। তাই বাংলাদেশের উচিত, নেদারল্যান্ডস যেভাবে তার সমাজকে অপরাধশূণ্য করে ফেলতে পেরেছে; তা অনুসরণ করা।
বাংলাদেশের কারাগারগুলোর নাম বদলে সংশোধন কেন্দ্র করা প্রয়োজন। নতুন প্রজন্মের পুলিশ সদস্যরা এই সংশোধন কেন্দ্রগুলোতে সেখানকার বাসিন্দাদের মন্দ মানুষ থেকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তাদেরকে দিয়ে নানা সৃষ্টিশীল কাজ করানোর চেষ্টা করতে পারেন। তাদের সদিচ্ছা ও সৃজনশীলতা দিয়ে অপরাধীদের বানাতে পারেন এক একটা বাল্মীকি বা নিজামউদ্দীন আউলিয়া।
অপরাধীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে হলে মিডিয়ার আচরণও পরিবর্তন হওয়া দরকার। কারণ আমাদের মিডিয়ায় কারো বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ উত্থাপিত হওয়া মাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একদল শকুন নেমে আসে অভিযুক্ত ব্যক্তির শব-ব্যবচ্ছেদ করতে। এসময় পুরো সমাজ সাধু-সন্তের মত আচরণ করে। অথচ এসব উন্মত্ত মবের প্রত্যেকের মধ্যেই অপরাধী হয়ে ওঠার মতো সব লক্ষণই উপস্থিত রয়েছে। কেউ কেউ আবার ভিকটিমকে দোষারোপ করেন, অপরাধীর পক্ষে সাফাই গান। আর কোন কোন পুলিশ বা ক্ষমতাবান ব্যক্তি চেষ্টা করেন অপরাধীকে বাঁচাতে। এতে তারা ছাড়া পেয়ে বার বার অপরাধ করে। তাই অপরাধীর শাস্তি হওয়াটা জরুরী। তবে শাস্তি হবার পর তাকে এমন কিছু শেখাতে হবে যাতে সে বেরিয়ে আবার অপরাধে না জড়ায়। অর্থাৎ তাদের সামাজিক পুনর্বাসন করা।
শেষকথাঃ
প্রতিটা শিশুর সামাজিকীকরণের প্রথম প্রতিষ্ঠান হল তার বাড়ী, তার পরিবার। এটিই তার আচরণ, মূল্যবোধ, ধারণা, বিশ্বাস, নৈতিকতা, সাহস, শিক্ষা.. ইত্যাদির ভিত্তি তৈরী করে দেয়। এই ভিত্তিই তার সারাজীবনের আচরণের মূল চাবিকাঠি। এখান থেকে সে যা শিখবে, সারাজীবন সে তাই করবে। পরিবারে সে ভাল কিছু শিখলে সে ভাল হবে, নাহলে খারাপ। তাই ছোটবেলা থেকে আমাদের উচিত আমাদের শিশুদের প্রতিবাদ করতে শেখানো। কখনো যেন তারা কোন অন্যায় মেনে না নেয়। তাহলে তারা ভয় পাবেনা, কিছু গোপন করবেনা, সাহসী হবে, যেকোন অন্যায়ের শুরুতেই প্রতিবাদ করতে শিখবে। এটা খুব জরুরী।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে ছোটবেলা থেকেই পরিবার ও রাষ্ট্র অত্যন্ত কঠোরভাবে ছোট-বড় সব অন্যায়কে প্রতিহত করতে ও নিজে অন্যায় না করতে শেখানো হয়। তাই ওদের দেশে অপরাধ কম। নিচের ভিডিওটি দেখার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1887471028173388&id=100007315272396
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১৭ সকাল ১০:২৮