কোন ছোট বা বড় যেকোন অপরাধ সংঘটিত হবার পর বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আমরা বিষয়টি দ্রুত ও সহজ উপায়ে নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করি।কেননা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষভাবে আইনের কঠোর প্রয়োগ হয়না। অন্যদিকে অপরাধী তার টাকা বা ক্ষমতার দাপট খাটিয়ে অপরাধ ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করে এবং ভিকটিমকে আইনের আশ্রয় নিতে বাধা দেয় বা নানা ভয়ভীতি দেখায়, নির্যাতন করে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার পাবার নিশ্চয়তার অভাব, আর্থিক সঙ্গতি না থাকা, পুলিশের হয়রানির ভয়, বিচারিক দীর্ঘসূত্রিতা, অপরাধী শক্তিশালী হলে তার নির্যাতনের ভয়, প্রিয়জনদের সমর্থন না পাওয়া,.... ইত্যাদি নানা কারণে আমরা অপরাধের প্রতিবাদ বা প্রতিকার করিনা, করতে পারিনা। সামাজিকভাবে হেয় হবার সম্ভাবনা থাকলে আমরা অপরাধটি গোপন করার চেষ্টা করি। এতে অপরাধী যেমন প্রশ্রয় পেয়ে আরো অপরাধ করে, তাকে দেখে আরো অনেকে অপরাধ করতে সাহস পায়, তেমনি নির্যাতিত ব্যাক্তি ও তার পরিবার ন্যায় বিচার না পেয়ে বার বার নির্যাতিত হয়। এভাবে দেশ ও সমাজ অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়।
একারণেই বাংলাদেশের মানুষগুলো দিনে দিনে জানোয়ার হয়ে যাচ্ছে। এদেশের অনেক সমস্যা, দৈন্য মেনে নিতে পারি। মানুষের পশু হয়ে ওঠা মেনে নিতে পারিনা। একটা ধর্ষণের রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটার খবর। কচি নিষ্পাপ শিশুকে এক নিমেশে পিষে মেরে ফেলছে! দয়া, মায়া, বিবেক, পাপের ভয়, আইনের ভয়, লোকনিন্দার ভয়,... কিচ্ছু নেই। দেশ ক্রমেই ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। সবধরণের অপরাধের অবাধ বিস্তারের ফলে ধীরে ধীরে প্রিয় দেশটা অনিরাপদ ও বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে এদেশের সামাজিক অবক্ষয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেছে। আমরা সকলেই চোখ, কান, মুখ বন্ধ করে বসে আছি। আশা করছি, কোন এক অলৌকিক যাদুমণ্ত্রবলে সব কিছুর সমাধান হয়ে যাবে। অথবা নিশ্চিন্ত থাকতে পারছি এই দেখে যে, আমি বা আমার পরিবার এখনও নিরাপদে আছি। আইনের কঠোর প্রয়োগ করার পরিবর্তে ভিকটিমদের দোষ খুঁজে বের করছি।
আমরা অন্যায় হজম করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। যেমন ফরমালিন খেতে খেতে এখন মেনেই নিয়েছি খাদ্যে ফরমালিন না থাকাটাই অস্বাভাবিক। তেমনি বাকী সবকিছু। অহরহই নানা লোমহর্ষক ঘটনা বা অপরাধ ঘটছে। কিছু ঘটনা প্রকাশ্যে দিনের বেলায় সবার সামনে ঘটছে। কিছু মানুষ হায়েনা হয়ে যাচ্ছে আর কিছু মানুষ সাক্ষী গোপাল। তারা অথর্ব। সবাই চেয়ে চেয়ে বর্বরতা দেখে। প্রতিবাদ, প্রতিকার করেনা। অথচ বাঙ্গালী বীরের জাতি। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে অন্যায়কে পরাজিত করে এদেশের জন্ম। কোথায় গেল আমাদের সে বীরত্ব? কেন অপরাধ ঘটতে দেখেও এখন মানুষ থামায় না? কেন চুপ করে থেকে নির্মমতা দেখে? কেন সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করেনা?
প্রতিবাদ যে একদমই করেনা, তা কিন্তু নয়। মিছিল, স্লোগান, ফেসবুকে, পেপারে, ব্লগে লেখালেখি, অপরাধ ও অপরাধীর ছবি/ভিডিও শেয়ার বা প্রচার, মানববন্ধন, কান ধরে ছবি, মুখে কালো কাপড় বাঁধা, কালো ব্যাজ ধারণ,... ইত্যাদি তো করছি। আসল কাজটাই করছি না। যখন খাদিজা, রাজন, সাবিনারা, তানহা, বনানীর দুই তরুণী, বগুড়ার মা-মেয়ে,.... ইত্যাদি অসংখ্য মানুষ নির্যাতিত হচ্ছে, তখন আমরা অনেকেই সেসব নির্যাতনের কথা জেনেও, দেখেও তার প্রতিকারের বা ভিকটিমকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিনা। কারণ আমাদের আত্মকেন্দ্রিক ও সুবিধাবাদী মানসিকতা, পুলিশের ঝামেলায় না জড়ানোর ইচ্ছা, প্রতিবাদ করতে গিয়ে অপরাধীর রোষানলে না পড়ার মানসিকতা, সামাজিক ও আইনগত প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকা, ইত্যাদি । আগে গ্রামের বা পাড়ার কোন ছেলেকে সিগারেট খেতে দেখলেও বয়স্ক লোকেরা ধমক দিতেন বা ছেলের বাবাকে বলে দিতেন। ফলে ছেলেমেয়েরা অপরাধ করতে সাহস পেতনা। আর এখন পাড়ার বখাটেরা মেয়েদের গায়ে হাত দিলে, মানুষ খুন করলে, চাঁদাবাজি করলে, এসিড ছুঁড়লে,.......ও আমরা দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাই বা বিনা প্রতিবাদে প্রাণভয়ে চুপ করে থাকি, অপরাধ হজম করি, অন্যায় মেনে নেই, অপরাধীকে ভয় করি, সমীহ করি। এর কারণ কি? নিজেকে প্রশ্ন করুন। উত্তরটা পেয়ে যাবেন। পাননি?
বেশ। বলে দিচ্ছি। এর কারণ হল - এখন আমাদের সমাজে কোন সাধারণ মানুষের কোন নিরাপত্তা নেই। কেউ অন্যায়ভাবে আক্রান্ত হলেও রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় যণ্ত্র তাদেরকে সাহায্য করেনা বা রক্ষা করতে পারেনা। উল্টে অপরাধীরাই জয়ী হয়। জয়ী হয়ে নির্ভয়ে আরো বড় বড় অপরাধ করে। চোখের সামনে প্রতিনিয়ত মানুষ অপরাধীদের ফুলে-ফেঁপে ওঠা দেখে। তাই মানুষ এখন নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত। অন্য কারো নিরাপত্তা দিতে গিয়ে নিজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে সাহস পায়না। কারণ সে জানে, সে নিজে আক্রান্ত হলে কেউ তাকে বাঁচাতে আসবেনা।
আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, শিক্ষামূলক, রাজনৈতিক, আইনগত, ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয়,.... সব অনুশাসনের সংস্কার দরকার। নাহলে এ অবস্থা আরো খারাপ হবে। এ নরক থেকে উত্তোরণের কোন উপায় নেই। একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বা দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে চলবেনা। চোখ বন্ধ করলেই প্রলয় থামেনা। তাই চোখ খুলে ভালমত জাগতে হবে, প্রলয় থামানোর জন্য দায়িত্ব পালন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে সবক্ষেত্রে। দেশপ্রেমের কথা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলা আর দেশের শান্তি বজায় রাখতে নিজে সম্পূর্ণ সৎ থেকে নিরপেক্ষভাবে কঠোরভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করা এক কথা নয়। আমাদের ভণ্ডামী বন্ধ হওয়া দরকার। প্রলয় থামাতে সবার ভূমিকা দরকার। কিন্তু সেটা নিশ্চিত করা যাবে কিভাবে?
সবার আগে দরকার দল মত নির্বিশেষে সব ধরণের অপরাধে লিপ্ত সব অপরাধীর কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা, যা কেবল পারে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র কি সবক্ষেত্রে সেটা পারছে?
যে নিজেই নানা অপরাধে জড়িত, তার নৈতিক ভিত্তি থাকেনা আরেকজনের অন্যায় রোধ করবার বা অন্যের অপরাধের বিষয়ে কথা বলার। যে ঘুষ খায়, সে আরেকজনকে ঘুষ খাওয়ার অপরাধে শাস্তি দিতে পারেনা। তেমনি আমরা সবাই যার যার অপরাধ ঢাকতে, নিজের চারপাশ, নিজের চেয়ার সামলাতে ব্যস্ত। বাকীরা জাহান্নামে যাক। তাছাড়া যারা প্রতিকার করতে চাইবে, তাদেরকে যে বিপদে ফেলা হবেনা, এমন নিশ্চয়তা কে দেবে? বড় ভয়াবহ সময়! অপরাধীদের হাত অনেক শক্ত! আরো যে কত কত ভয়াবহ জিনিস দেখতে হবে, কে জানে?
সরকার চাইলেই পারেন নিরপেক্ষভাবে অপরাধ ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে দেশটাকে নিরাপদ করতে। অপরাধী অপরাধীই। আমরা আশাবাদী হতে চাই। বীর বাঙ্গালীর গর্ব ধরে রাখতে চাই।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৫:৪২