মানুষ লেখালেখি করে প্রধানতঃ ৬ টি কারণে-
১। মানুষ লেখে মূলতঃ মনের আনন্দে। তার নিজের ভাবনা, অনুভূতি, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি প্রকাশ করতে ভাল লাগে, তাই লেখে।
২। লেখা পড়ে মানুষ অনেক কিছু জানবে, জ্ঞান বাড়বে, লোকের উপকার হবে, সমাজ, রাষ্ট্র, তথা জীবনের নানা অসংগতি সম্পর্কে জেনে সচেতন হবে, তাই লেখে।
৩। লেখা পড়ে মানুষের চিন্তাভাবনা, মানসিকতা, ধারণা, আচরণ ইত্যাদি পরিবর্তন হবে। এভাবে ধীরে ধীরে সমাজ পরিবর্তন হবে, দেশ এগিয়ে যাবে, সেজন্য লেখে।
৪। পাঠককে নির্মল আনন্দদানের জন্য লেখে, সুখ-দুঃখের নানা ঘটনা, চরিত্রের মাধ্যমে সমাজের নানা বিষয় তুলে ধরে মানুষকে বিনোদন দেবার জন্য লেখে।
৫। কেউ কেউ লেখেন বিশেষ বিশেষ ঘটনা মানুষকে জানানোর জন্য। যেমন - বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা (যেমন- মুক্তিযুদ্ধ), নানা অপরাধ, আবিষ্কার, ভ্রমণকাহিনী, বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি ইত্যাদি।
৬। কেউ কেউ লেখেন বিখ্যাত হওয়ার বা অর্থ উপার্জনের জন্য।
কেন লেখা জরুরী?
যাঁরা লেখালেখি করেন (উপরের যেকোন কারণেই লেখেন না কেন), তাঁরা জানেন, লেখার কাজটা সহজ নয়। হলে সবাই লিখতেন। আবার অনেকের লেখার হাত, ক্ষমতা বা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও লেখেননা। এটা অন্যায়। মহাঅন্যায়। সৃষ্টিকর্তার দেয়া ক্ষমতার অপচয় করা পাপ।
হুমায়ূন আহমেদ যদি শুধু শিক্ষকতা করে জীবন পার করে দিতেন, তাতে তাঁর তেমন কোন ক্ষতি ছিলনা। দিব্বি খেয়ে-দেয়ে, হেসে-খেলে জীবন পার করে দিতে পারতেন। এতে তাঁর ক্ষতি না হলেও আমাদের বিশাল ক্ষতি হয়ে যেত। তাঁর হাত দিয়ে আমরা যা পেয়েছি, সেই দূর্লভ অবদান থেকে এদেশের মানুষ বঞ্চিত হতো। তাঁর মৃত্যুর পরেও এদেশের মানুষ শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতাভরে তাঁকে স্মরণ করবে তার কাজের জন্যই। স্বল্প জীবনে এ পাওয়া কম নয়। তেমনি পৃথিবীর অসংখ্য লেখক, কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, গবেষকরা তাঁদের লেখা ও কাজ দিয়ে আমাদের ঋণী করেছেন। তাই যাঁরা লিখতে পারেন, তাঁরা লিখুন। এখন সামাজিক মাধ্যমগুলো লেখালেখির অনেক সুযোগ তৈরী করে দিয়েছে। অনুপ্রেরণা না পাওয়া, ব্যস্ততা, কেউ পড়বেনা, সমালোচনা করবে, বাধা দেবে... ইত্যাদি কোন অজুহাতেই লেখা বন্ধ করা উচিত নয়।
মানুষ ছোটবেলা থেকে তার পরিবার, আত্মীয়, খেলার সাথী, স্কুল, সহপাঠী, শিক্ষক, প্রতিবেশী সমাজ, পারিপার্শ্বিকতা ইত্যাদি নানাকিছুর সাথে তার মিথস্ক্রিয়া ( Interaction) হয়। এর মাধ্যমে মানুষ তার চারপাশে যাকিছু দেখে বা যেসব ঘটনার মুখোমুখি হয়, তা থেকে বিভিন্ন বিষয়, ঘটনা সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা বা ধারণা তৈরী হয়। প্রত্যেক মানুষের বংশগতি ও পরিবেশ আলাদা। ফলে তার অভিজ্ঞতা ও কোন অভিজ্ঞতা তুলে ধরার ক্ষমতা (লেখা, ছবি, আঁকা বা অন্য কোনভাবে) আলাদা। মানুষের অভিজ্ঞতা আসে দুভাবেঃ
১। একই সমাজ, দেশ বা পরিবেশে বসবাসকারী সব মানুষের অভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে। যেমন - বাংলাদেশের আবহাওয়া, পরিবেশ, মানুষের জীবনযাপন প্রণালী, খাবার, পোশাক, ভাষা, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি,... ইত্যাদি সব বাঙ্গালীদের অভিন্ন অভিজ্ঞতা।
২। প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে ঘটে যাওয়া ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা যা সবার একরকম হবেনা। যেমন - কোন অপরাধের শিকার হওয়া, কোন বিশেষ ঘটনা (যেমন - মুক্তিযুদ্ধ) দেখা, যুদ্ধে সব হারানো, চোখের সামনে প্রিয়জনকে খুন হতে দেখা, হিন্দু, মুসলিম বা যেকোন সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠার ফলে ঐ সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা, বিদেশে গিয়ে ভিনদেশী কোনকিছু জানা,.... ইত্যাদি অভিজ্ঞতা সবার হবেনা। তাই প্রতিটি ব্যক্তি তার নিজ নিজ অভিজ্ঞতা, ধারণা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ,... ইত্যাদি তার লেখার মাধ্যমে তুলে ধরলে সেই অভিজ্ঞতা বা ভাবনা সম্পর্কে আমরা জানতে পারব।
সব মানুষের সবরকমের অভিজ্ঞতা হবার সুযোগ নেই। সবার জীবনে সবকিছু ঘটেনা। যেমন, আমার এক পাঠক আমি কাউন্সেলিং করি জেনে আমাকে তাঁর মানসিক কষ্টের কথা জানিয়েছেন। ছোটবেলায় তাঁর বাবা খুন হয়েছিলেন। সে খুন করিয়েছিলেন তাঁর আপন দাদী। ১৪/১৫ বছর বয়সে এটা জানার পর থেকে তিনি মানসিক কষ্টে ভুগছেন। এমন অভিজ্ঞ তা সবার হবেনা। কিন্তু তিনি যদি লেখেন বা বলেন, তাহলে আমরা অন্যরকম একটি অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানার সুযোগ পাব।
হুমায়ূন আহমেদের ছেলে নুহাশের লেখা আমি পড়েছি। এত আপন যে বাবা, দ্বিতীয় বিয়ে করার পর সেই বাবাই কিভাবে একটু একটু করে পর হয়ে যায়, তার কষ্টকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা আছে তার লেখায়।
তাই প্রতিটা মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা শিখতে পারি। সেই অভিজ্ঞতা জানার সহজ উপায় হল লেখা। লেখা সময়কে ধরে রাখে। কেউ আজ যা লিখছে, তা বর্তমান। আবার এই লেখাই অনেকদিন পরে হয়তো অতীতেের মূল্যবান দলিল বলে বিবেচিত হবে। বিভিন্ন অতীত ইতিহাসের স্বর্ণালী দিনগুলো আমাদের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে লেখা, ছবি, সিনেমা-নাটক, ডকুমেন্টারি ইত্যাদির মাধ্যমে। সামাজিক নানা অসঙ্গতিগুলো লোকে প্রতিনিয়ত তুলে ধরে লেখার মাধ্যমে। ফলে আমরা সচেতন হই।
আমরা কোন কিছু শিখি আমাদের সামনে কোন সমস্যা, লক্ষ্য বা চাহিদা থাকলে। যেমন - লেখাপড়া, কোন কাজ, কম্পিউটার ইত্যাদি শিখি আমাদের কোন না কোন চাহিদা পূরণের জন্য। কোন বিশেষ লক্ষ্য, উদ্দেশ্য বা চাহিদা ছাড়া যখন আমরা কোন কিছু শিখি, তখন তাকে আকষ্মিক শিখন (Incidental learning) বলে। আমরা যখন কারো লেখা পড়ি, তখন আকষ্মিকভাবে অনেককিছু শিখে ফেলি, কোন কিছু শেখার বিশেষ কোন লক্ষ্য ছাড়াও। আর আমরা যখন কোন কিছু দেখি, শুনি, পড়ি, অনুভব করি, তখন সেই অভিজ্ঞতার একটি ছাপ মস্তিষ্ক তার স্মৃতিতে রেখে দেয়। পরে প্রয়োজনের সময় সেই অভিজ্ঞতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়। ফলে লেখার মাধ্যমে মানুষকে আকষ্মিকভাবেও অনেককিছু শেখানো যায়। এভাবে জ্ঞান বাড়ে। এভাবে শেখা অভিজ্ঞতা মস্তিস্কে জমে জমে নতুন ধারণা তৈরী হয়। ফলে লেখার মাধ্যমে কারো ধারণা বদলে দিয়ে তাকে সচেতন ও প্রতিবাদী করা যায়। এভাবে ধীরে ধীরে সমাজ পরিবর্তন করা যায়।
আমি নিজে কেন লিখি? লিখে কি লাভ?
আমি লেখালেখিতে এসেছি আমার প্রিয় কিছু মানুষ, বন্ধুর জোরাজুরিতে। নাহলে হয়তো কখনোই কোথাও কিছু লিখতাম না। পারিবারিক, সামাজিক, মানসিক, নারী, শিশু ও শিক্ষাবিষয়ক লেখাগুলোতে আমি মূলত এ সম্পর্কিত নানা সমস্যার কারণের যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা ও সেসব সমস্যার সমাধান সম্পর্কে লিখি। কারণ এসব বিষয়ে কেউ তেমন লেখেন না বা কম লেখেন বলে। এখন ভেতর থেকে একটা তাগিদ তৈরী হয়েছে। এখন লিখি পাঠকের কাছে একটা দায়বদ্ধতা অনুভব করি বলে।
আমি লিখি দেখার বা জানার জন্য যে, আমি বিষয়গুলোকে যেভাবে দেখি, যেখাবে ব্যাখ্যা করি, অন্যরা সেভাবে দেখে কিনা। আমি জানতে চাই, আমি কোন ঘটনা যেভাবে বলছি, আমার লেখা পড়ার পর মানুষ নতুন করে ভাবুক সেটা ঠিক বলছি কিনা বা কি ভুল বলছি। অর্থাৎ চিন্তার খোরাক জোগানোর জন্য। নতুন করে বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার জন্য।
লেখার মানঃ
এবার আসি লেখার মান প্রসঙ্গে। সবার লেখার মান সমান নয়। সবার লেখা সবার ভাল লাগবে, এমনও নয়। না লাগাটাই স্বাভাবিক। কারণ সবার মন-মানসিকতা, পরিবেশ, পছন্দ, মূল্যবোধ, বিশ্বাস... ইত্যাদি আলাদা। কারণ প্রতিটা মানুষই ইউনিক। কেউ কারো মত নয়। আমাদের মানসিকতার খুব অল্প কিছু জিনিসই অন্যের সাথে মেলে। এজন্যই জীবন এত বৈচিত্র্যময়। সবাই সবকিছু একই দৃষ্টিতে দেখলে জীবন একঘেঁয়ে হয়ে যেত।
আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই খুব ভাল লেখেন, নানা বিষয়ে গবেষণা করেন যাঁর যাঁর নিজস্ব ক্ষেত্রে। আমার পরিচিত আরো অনেকেই লেখেন নানা বিষয় ও সাহিত্যের নানা দিক থেকে। তাঁদের সবার লেখাই আমি কম-বেশী পড়ি। পাশাপাশি অবাক হই, হতাশ হই এটা দেখে যে, এই লেখকদের মাঝে লেখিকার সংখ্যা খুবই কম। অথচ আমি জানি, চাইলে তাঁরা অনেকেই ভাল লিখবেন।
মেয়েদের লেখা উচিত কেন?
মেয়েদের লেখালেখি করা উচিত, যদিও সংসার, চাকরী সামলিয়ে তা কঠিণ। সবার ভাবনা অনুভূতি আলাদা। মেয়েরা মেয়েদের মনের কথা, কষ্ট বা সমস্যা যেভাবে বুঝতে ও বলতে পারে, ছেলেরা সেটা পারেনা। আর আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত মেয়েদের সাথে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, সেগুলো সম্পর্কে মেয়েদের লেখার মাধ্যমে সচেতন, সোচ্চার থাকা দরকার। তাহলে ধীরে ধীরে সমাজে মেয়েদের মানসিকতার পরিবর্তন হবে, তাদের প্রতি নির্যাতন বন্ধ হবে, তাদের সামাজিক অবস্থান উন্নত হবে। নারী নির্যাতন ছাড়াও সমাজের যেকোন অন্যায়-অসঙ্গতি সম্পর্কে লিখুন। তাতে অপরাধীরা সামাজিকভাবে হেয় হবে, আইনের লোকেদের চোখে পড়বে, অপরাধীর শাস্তি হবে, ভিকটিমরা ন্যায়বিচার পাবে, মানবিকতার জয় হবে। নিজেদের যেকোন অভিজ্ঞতা, অনুভূতি, পরামর্শ শেয়ার করুন। ভারতের এই নারী (উপরের ছবিতে) একটি চিঠিতে লিখেছিলেন ধর্মগুরু রাম রহিম সিং এর নানা কুকর্মের কথা যা পত্রিকায় ছাপা হবার পর সেই ভণ্ড গুরুর বিচার ও সাজা হয়েছে। সুতরাং কখনো কখনো কোন সাহসী নারীর লেখা একটি চিঠিও থামিয়ে দিতে পারে দীর্ঘদিন ধরে ঘটে চলা সঙঘবদ্ধ কোন ভয়ংকর অপরাধ ও অপরাধীদের অপতৎপরতা। তাই সাহসী হোন। লিখুন।
আমার আজকের লেখা তাঁদের উদ্দেশ্যে যাঁরা পারেন, অথচ লেখেন না বা লেখার চেষ্টা করেন না। আমার অনুরোধ, অল্প করে হলেও কিছু লিখুন। যেমনই হোক। লিখতে লিখতে হাত পাকা হবে। এমন অনেক বিষয় সামনে চলে আসবে যেগুলো নিয়ে লেখা জরুরী বা যেগুলো নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করবে।
আমার লেখা পড়ার পর যদি একজন লেখকও তৈরী হয়, আমার লেখা স্বার্থক হয়েছে বলে ধরে নেব।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:৩১