somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মানুষ কেন অকৃতজ্ঞ হয়?

১১ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৪:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মানুষ কেন অকৃতজ্ঞ হয়?

মানুষের কিছু অদ্ভুত স্বভাবের মধ্যে একটি হল "অকৃতজ্ঞতা"। মানুষ উপকারীর উপকার মনে রাখেনা। বিপদে যে সাহায্য করে, বিপদ পার হলে মানুষ সেই সাহায্যকারীকেই অবজ্ঞা করে, বিপদে ফেলে, খুনও করে। বঙ্গবন্ধুকে খুন করেছিল তাঁরই আশীর্বাদপুষ্টরা। একদিন এক লোক বিদ্যাসাগরকে এসে বলল, "অমুক লোক আপনাকে গালি দিচ্ছে।" শুনে বিদ্যাসাগর বিন্দুমাত্র অবাক না হয়ে বললেন, "নিশ্চয় আমি কখনও তার কোন উপকার করেছি। নাহলে তো গালি দেবার কথা নয়।" পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সত্যিই বিদ্যাসাগর একদা তার উপকার করেছিলেন। অথচ বিপদ পার হয়েছে বলে এখন সে উপকারীকেই গালি দিচ্ছে। বড়ই আজব প্রাণী! আমি নিজেও অনেককে নানাভাবে সাহায্য করি। পরে তাদের কাছ থেকেই আঘাত পাই। আপনাদেরও এমন অনেক অভিজ্ঞতা থাকার কথা। কারণ "উপকারীকে বাঘে খায়", "কাজের বেলায় কাজী, কাজ ফুরালেই পাজী" - এই বাগধারাগুলো তো আর এমনি এমনি আবিষ্কার হয়নি।

এরকম হবার কথা নয়, হওয়া উচিতও নয়। তবু কেন এমন হয়? কেন কিছু মানুষ উপকারীর উপকার ভুলে গিয়ে উপকারীকে হেয় করে, বিপদে ফেলে, অপমান করে? এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে।

মনোবিজ্ঞানী জাইগারনিক (Zeigarnik, 1927) ১৩৮ জন পরীক্ষণপাত্রকে ২০ টি সমস্যা সমাধান করতে বলেন। এসব সমস্যার মধ্যে ছিল কাদা দিয়ে মডেল তৈরী করা, ধাঁধাঁ সমস্যারর সমাধান করা, সুতায় দানা পরানো, অংক কষা ইত্যাদি। পরীক্ষণপাত্রদেরকে কিছু কাজের মাঝখানে বাধা দিয়ে কাজ অসম্পূর্ণ রাখা হয়, কিছু কাজ সম্পূর্ণ করতে দেয়া হয় এবং সেগুলো দৃষ্টির আড়ালে সরিয়ে রাখা হয়। নির্দিষ্ট সময় বিরতির পর পরীক্ষণপাত্রদেরকে তাদের কাজগুলো স্মরণ করতে বলা হয়। দেখা গেল,
অসম্পূর্ণ কাজ স্মরণ করেছে ১১০ জন, সমান সংখ্যক সমাপ্ত ও অসমাপ্ত কাজ স্মরণ করেছে ১১ জন এবং সমাপ্ত কাজ স্মরণ করেছে ১৭ জন।

এই গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয় যে, মানুষ অসম্পূর্ণ, সমস্যাযুক্ত, অসুবিধাজনক কোন কিছু সহজে ভুলতে পারেনা। কারণ ওগুলো তার মনের উপর প্রতিনিয়ত চাপ ফেলতে থাকে। এজন্যই ঝগড়া না মেটা পর্যন্ত, পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত, কঠিণ কোন কিছু না শেখা পর্যন্ত, কোন বিপদ হলে তা থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত,..... আমাদের মন স্বস্তি পায়না। কিন্তু বিপদ বা সমস্যা থেকে মুক্তি পেলে আমরা তা ভুলে যাই ( প্রচণ্ড কষ্ট সহ্য করে সন্তান জন্ম দিয়ে সন্তানের মুখ দেখার পর মা সেই প্রচণ্ড কষ্টের কথা ভুলে যায় বলেই আবার সন্তান ধারণ করে। ভুলতে না পারলে করতো না)। সেই সাথে বিপদে যে সাহায্য করেছিল, তার অবদানের কথাও আমরা কেউ কেউ ভুলে যাই।

এরকম আরেকটি গবেষণা করা হয় রেস্টুরেন্টের ওয়েটারদের উপর। যেসব কাস্টমাররা খাবারের বিল পরিশোধ করেছেন এবং যারা এখনও খাবারের বিল পরিশোধ করেননি তেমন কাস্টমারদের খাবারের মেনু ও দাম কিছু ওয়েটারকে মনে করতে বলা হয়। দেখা যায়, অধিকাংশ ওয়েটার যারা বিল পরিশোধ করেননি তাদের মেনু ও দাম সঠিকভাবে বলতে পারে, কিন্তু যারা পরিশোধ করেছেন, তাদেরটা ঠিকমত বলতে পারেনা।

তার মানে, কারো কাছে কোন পাওনা, প্রত্যাশা বা লাভের সম্ভাবনা থাকলে আমরা সে মানুষদের মনে রাখি, যত্ন করি, ত্যাগ করিনা। কিন্তু কোনকিছু পাওয়ার বা লাভের সম্ভাবনা না থাকলে আমরা সেসব মানুষকে ত্যাগ করি, তাদের প্রতি অকৃতজ্ঞ হই। তার প্রমাণও আছে ভুরি ভুরি। দ্বিতীয় বিয়ে করার পর বা পরকীয়ায় জড়ানোর পর প্রথম বউয়ের প্রতি স্বামীর আগ্রহ থাকেনা।শারীরিক সম্পর্ক করার পর অধিকাংশ প্রেমিকরা প্রেমিকাকে ত্যাগ করে। বাবামার সম্পত্তি পেয়ে গেলে অনেক কুসন্তান বৃদ্ধ বাবামাকে বাড়ী থেকে বের করে দেয়, খোঁজ রাখেনা, বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়।

যারা কারো জন্য সবচেয়ে বেশী ত্যাগ স্বীকার করে, লোকে কেন তার কাছেই আরও বেশী প্রত্যাশা করে?

কারণ মানুষ পেতে পেতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। মানুষ যত পায়, দাতার কাছে লোকের প্রত্যাশা তত বাড়ে। তাই যে সবসময় বেশী বেশী দেয় বা করে, লোকে ধরেই নেয়, সে আজীবন করবে বা দেবে। একসময় এমন হয় যে, দাতার কোন জিনিস নেবার সময় গ্রহীতারা দাতার অনুমতি নেবার প্রয়োজনও বোধ করেনা। মনে করে, সেটা তাদের পাওনা। যেমন - বাড়ীর বড় ছেলে, বড় মেয়ে, বড় বৌ যত বেশী ত্যাগ করে, লোকে তাদের কাছে তত বেশী প্রত্যাশা করে। অনেক সময় দেখা যায়, কোন পরিবারের বড় ভাই বা কিছু ভাই বাড়ীতে থাকে, ছোট বা কিছু ভায়েরা বাইরে চাকরী করে। তারা বাড়ীতে সবসময় টাকা দেয়, সবার দেখাশোনা করে। তখন বড় ভাই বা বাড়ীতে থাকা ভায়েরা তাদের কাছে আরও বেশী প্রত্যাশা করে। এমনকি বাড়ীতে থাকা ভাইরা আশা করে, বাড়ীর সবকিছু তারা একাই ভোগ করবে, বাইরে থাকা ভাইদের কিছুই দেবেনা, এমনকি বসতভিটাওনা, তাদের কাছ থেকে শুধুই নেবে, যেহেতু তারা চাকরী করে। অনেক ভায়েরা বাবার সম্পত্তি বা জমি একাই ভোগ করে। বোনদেরকে ভাগ দেয়া দায়িত্ব মনে করেনা। মনে করেনা যে অল্প হলেও তাতে বোনেদেরও অংশ আছে। বোনেরা বিপদে পড়লেও সাহায্য করেনা, দেখেনা। (তবে অনেক বিবেকবান ভাই আছে যারা পৈতৃক সম্পত্তি বোনেদের কাছ থেকে কিনে নেয় বা সম্পদের পরিবর্তে বোনদেরকে টাকা দেয়, নানাভাবে সাহায্য করে)।

যে দাতা না চাইতেই স্বেচ্ছায় অনেককিছু দেয়, তার দানকে গ্রহীতারা দান মনে করেনা, মনে করে পাওনা। সহজলভ্য কোনকিছুর কদর লোকে করেনা, যে দেয়, তার কদরও করেনা। দাতার স্বেচ্ছায় দেয়া জিনিস হাতে পাবার পর গ্রহীতারা যদি জানে, দাতা সেটা ফেরত নিতে পারবেনা, তথন গ্রহীতার কাছে দাতার আর দাম থাকেনা। তারা দাতার প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়। কিন্তু যদি এমন হয় যে, দেয়া জিনিসটা যেকোন সময় দাতা ফেরত নিয়ে নিতে পারে, তাহলে গ্রহীতারা দাতাকে তোয়াজ করে চলে।

এরকম ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের দিল্লী হাইকোর্ট সম্প্রতি বয়স্কদের জন্য একটি রায় দিয়েছে যে, বাবামার বাড়ীর উপরে ছেলেদের কোন আইনগত অধিকার থাকবেনা। তারা বাড়ীতে থাকতে পারবে কি পারবেনা, তা বাবামার বিবেচনার উপর নির্ভর করবে। এর ফলে ছেলেরা বাবামাকে বাড়ী থেকে বের করে দিতে বা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিতে পারবেনা। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী ত্যাগ স্বীকার করেন বাবামা। অথচ তাদের প্রতিই অকৃতজ্ঞতা দেখাচ্ছে ভারতের সন্তানেরা। তারা সম্পদ, বাড়ী নিয়ে বাবামাকে বাড়ী থেকে বের করে দিচ্ছে, বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছে, এমনকি খুন পর্যন্ত করছে। (আমির খানের একটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক অনুষ্ঠান "সত্যমেব জয়তে" - তে দেখেছিলাম, ভারতের কিছু প্রত্যন্ত গ্রামে বৃদ্ধ, অসুস্থ বাবামাকে ( যারা আর সুস্থ হবেন না) তাদের সন্তানেরা বিষের ইনজেকশন দিয়ে খুন করছে)।

আমাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায়ও বৃদ্ধ বাবামার সাথে দূর্ব্যবহার নতুন কিছু নয়। প্রায়ই শোনা যায়, দেখা যায়, ছেলের বৌ বৃদ্ধ শ্বশুর-শ্বাশুড়ীকে নির্যাতন করছে, মারছে, ছেলেরা বৃদ্ধ বাবামাকে ভাত দিচ্ছে না, বাড়ী থেকে বের করে দিচ্ছে, আলাদা হচ্ছে, সম্পত্তি লিখে নিয়ে সন্তানেরা বাবামাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে বা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছে, বৃদ্ধ বাবামাকে কাজ করতে বা ভিক্ষা করতে বাধ্য করছে, মাদকাসক্ত ছেলের হাতে মার খাচ্ছেন বাবামা, কেউ কেউ খুন হচ্ছেন, ছেলে ও ছেলের বৌ বৃদ্ধ মাকে গোয়ালঘরে ফেলে রাখছে। সেখানে শেয়াল মায়ের পায়ে কামড় দিয়ে মাংস ছিঁড়ে খাচ্ছে, কোটিপতি বাবা মারা যাচ্ছে মসজিদের বারান্দায় শুয়ে, তিনজন পুলিশ অফিসার ছেলে, স্কুলশিক্ষিকা মেয়ে, স্বচ্ছল সন্তান থাকার পরেও বৃদ্ধা মা ভাত পাচ্ছেননা ইত্যাদি।

অকৃতজ্ঞ সন্তানদের নির্যাতন-অবহেলা থেকে বাবামাকে বাঁচাতে আমাদের দেশেও ভারতের মত কিছু আইন প্রণয়নের সময় এসেছে। নয় কি???

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৫:৩৯
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×