আমরা সবাই কি সাম্প্রদায়িক নই?
অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত কেউ সাম্প্রদায়িক হলে তবু মেনে নেয়া যায়। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের একজন শিক্ষক যখন সাম্প্রদায়িক হন, তখন সে লজ্জা রাখার কোন জায়গা থাকেনা। ঠিক এই ঘটনাই ঘটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের এবারের ভর্তি পরীক্ষার ৭৬ নম্বর প্রশ্নটি ছিল :
৭৬। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থের নাম কি?
(ক) পবিত্র কুরআন শরীফ (খ) পবিত্র বাইবেল (গ) পবিত্র ইঞ্জিল (ঘ) গীতা।
এই প্রশ্নে প্রশ্নকর্তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। কারণ এই মহাজ্ঞানী প্রশ্নকর্তা নিজেই জানেননা যে বাইবেল আর ইঞ্জিল একই গ্রন্থ। তিনি সাম্প্রদায়িক কারণ তিনি নিজের ধর্মগ্রন্থকে শ্রেষ্ঠ উত্তর ধরে নিয়ে প্রশ্নটি করেছেন। তিনি ভুলে গেছেন যে, সবাই নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থকেই শ্রেষ্ঠ মনে করে। তাই এই প্রশ্নের উত্তর একাধিক হওয়া সম্ভব, (একটি নয়) যা অবজেক্টিভ প্রশ্নের গঠণ পরিপন্থী। এই প্রশ্নের উত্তরে নিশ্চয় একেক পরীক্ষার্থী একেক উত্তর দেবে। পরীক্ষক কোন্ উত্তরকে সঠিক ধরে নম্বর দেবেন? তাছাড়া এমন কোন পরীক্ষার্থীও তো থাকতে পারে যে এর কোনটিকেই সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ বলে মনে করেনা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এমন সাম্প্রদায়িক, দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রশ্ন কেউ করতে পারে এটি আমাদের কল্পনার অতীত। প্রশ্নকর্তা অবশ্যই সাম্প্রদায়িক। কারণ তিনি অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। তাই তিনি অন্য ধর্মগ্রন্থগুলোর নামের আগে বসালেও গীতার আগে "পবিত্র" শব্দটা বসাননি। অর্থাৎ প্রশ্নকর্তা গীতাকে পবিত্র গ্রন্থ বলে মনে করেন না।
কোন শিক্ষকের সাম্প্রদায়িক হবার কোন সুযোগ নেই। ক্লাসে সব ধর্মের, বর্ণের, গোত্রের ছাত্র-ছাত্রী থাকবে। কারো প্রতিই পক্ষপাতমূলক কোন আচরণ করা যাবেনা। এটি যেকোন শিক্ষকের নীতিবিরুদ্ধ। আমাদের সংবিধানেরও নীতি বিরুদ্ধ। সমঅধিকার নীতি তাই বলে। তাছাড়া চারুকলার মত বিষয়ের প্রশ্ন এমন সাম্প্রদায়িক হলে আমাদের সবার প্রতি উদার মানসিকতার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এতে মানুষের ধর্মানুভতিতে আঘাত দেবার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি ব্যাহত হবার সুযোগ সৃষ্টি হয়, শিক্ষক তাঁর গ্রহণযোগ্যতা হারান। এটি হতে দেওয়া উচিত নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন করার নিয়ম হলো, উত্তরসহ প্রশ্ন হাতে লিখে জমা দিতে হয়। ফলে কোন্ প্রশ্ন কোন্ শিক্ষক করেছেন, তা সনাক্ত করা সম্ভব। তারপর প্রশ্ন মডারেশন বোর্ডের সদস্যরা প্রশ্নকর্তাদের দেয়া প্রশ্ন থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রশ্ন বাছাই করেন। বাছাইকৃত প্রশ্ন (উত্তরসহ দেয়া) টাইপ করা হয়। যদি ধরে নেই, প্রশ্নকর্তা না বুঝে ভুল করে এমন প্রশ্ন করেছেন, তাহলে প্রশ্ন আসে, মডারেশন বোর্ড কেন এমন বিতর্কিত প্রশ্ন বাদ দিল না? তাই এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে দাবী উঠেছে, তদন্ত করে ঐ প্রশ্নকর্তা শিক্ষক ও মডারেশন বোর্ডের সদস্যদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।
আমার ভাবনার জায়গাটা অন্য। আপনারা বলুন তো, কেন শিক্ষক এমন একটা প্রশ্ন নির্বাচন করেছেন? ভুল করে নয়। তিনি ইচ্ছে করেও এমন প্রশ্ন করেননি। তিনি প্রশ্নটা করেছেন, কারণ তাঁর মস্তিষ্ক একটি বিশেষ ধরণের ভাবনায় অভ্যস্ত। আর এই প্রশ্ন সেই ভাবনার ফল যা থেকে তিনি বের হতে পারেননি, পারবেন না। কারণ আপনার চিন্তায় গণ্ডগোল থাকলে তার প্রতিফলন আপনার কাজে ঘটবেই। মুখে নিজেকে নিরপেক্ষ দাবী করা সহজ। কিন্তু মন থেকে সাম্প্রদায়িকতা মুছে ফেলা সম্ভব না। সাম্প্রদায়িক মানুষ নিজ ধর্ম, নিজের মত ইত্যাদি সবকিছুকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে সজ্ঞানে ও অজ্ঞানে সদা সর্বদা ব্যস্ত, তা সে যে ধর্মের বা গোত্রের মানুষই হোক না কেন।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে এবং কট্টর হিন্দুত্ববাদের বিপক্ষে লেখালেখির কারণে সম্প্রতি ভারতে গৌরী লঙ্কেশ খুন হয়েছেন অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীর হাতে। এর আগে একইভাবে একই কারণে খুন হন এম এম কালবুর্গি ও ডঃ পানসারি। আমাদের দেশে পাঁচজন ব্লগার খুন হয়েছেন কট্টর মুসলিমদের হাতে। আমেরিকাতে এখনও নিগ্রোরা নিগৃহীত হয় শেতাঙ্গদের দ্বারা। ভারতের বর্ণবাদপ্রথা, গরুর মাংস খাওয়ার অপরাধে মুসলিম হত্যা, এসবও তাই। সর্বশেষ বৌদ্ধদের দ্বারা রোহিঙ্গা মুসলিম নিধনও সাম্প্রদায়িকতার ফসল।
ছোটবেলা থেকে আমরা পরিবার, আত্মীয়, প্রতিবেশীদের আচরণ থেকে এবং সমাজ, বিদ্যালয়, পাঠ্যবই, গণমাধ্যম, ইত্যাদি থেকে যে ধারণা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আবেগ নিয়ে বেড়ে উঠি, এসব থেকে দিনে দিনে যা কিছু শিখি তা দিয়েই আমাদের ভাবনার ও আচরণের ভিত তৈরী হয়। তাই আপনি ওসব থেকে সাম্প্রদায়িক মানসিকতার অধিকারী হয়ে গেলে বড় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেও আপনি সাম্প্রদায়িকতামুক্ত হতে পারবেন না। তাই সব মানুষ, তথা সব শিক্ষকই শিক্ষার কারণে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত হতে চাইলেও কখনো কখনো (সবসময় নয়) নিজের অজান্তে তাঁর সাম্প্রদায়িক আচরণ প্রকাশ করে ফেলেন যা অন্যরা বা শিক্ষার্থীরা তাঁদের কাছ থেকে অনুকরণ করে শিখে ফেলে।
আমরা সবাই কমবেশী সাম্প্রদায়িক। যে কোন বিশেষ সম্প্রদায়কে প্রাধান্য দেয়, সেইই সাম্প্রদায়িক। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, নিজ ধর্ম, গোত্র, এলাকা, মতের, দলের লোকের প্রতি দূর্বল নন (প্রাধান্য দেননা), দেশের প্রতিটা সেক্টরে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ছোটবেলা থেকে আমরা এসব দেখে দেখেই বড় হই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও তাঁরা ভিন্ন দলের, মতের লোকেদের দেখতে পারেন না, তাঁদেরকে কোণঠাসা করে রাখেন, গালি দেন, ন্যায্য পাওনা দেননা, সব সুবিধা নিজেরা ভোগ করেন। নিজ দল বা মতের লোকেদের সাফাই গান, তাঁদের অপরাধ গোপন করেন, ধামাচাপা দেন। এটা নির্মম সত্যি। তাই তাঁরাও সাম্প্রদায়িক।
এক গাধা আর শেয়াল তর্ক করছে। গাধা বলছে, "ঘাস হলুদ।" শেয়াল বলছে, "না, ঘাস সবুজ।" তারা নিজেরা তর্কের সমাধান করতে না পেরে সিংহ রাজার কাছে গেল সমাধান পেতে। সিংহ সব শুনে গাধাকে ছেড়ে দিল, কিন্তু শেয়ালকে দিল জেল। শেয়াল আপত্তি করে বলল, "কেন মহারাজ? আমিই তো ঠিক বলেছি। ঘাস তো সবুজই।" সিংহ বলল, "তোমাকে তো ভুল কথার জন্য জেল দেইনি। জেল দিয়েছি পণ্ডিত হয়ে মূর্খের সাথে তর্কে জড়ানোর মত অন্যায় করেছ বলে।"
আমিও তাই বলি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে সাম্প্রদায়িক হবার মত অন্যায় করলে তার শাস্তি না হওয়াটাই অপরাধ। তাই শাস্তি হতে হবে। হতে হবে সব সাম্প্রদায়িক শিক্ষকের। প্রশ্ন হল, অসাম্প্রদায়িক শিক্ষক পাওয়া যাবে তো? কথায় বলে, "ঠক বাছতে গাঁ উজাড়।"!!!!!!!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৯:১৬