somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহাপরাক্রমশালী সোশাল মিডিয়া

১০ ই নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মহাপরাক্রমশালী সোশাল মিডিয়া

সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে সারা দুনিয়ায় মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া রোগটির নাম 'সেলফি'। সম্প্রতি ফেসবুকের প্রথম প্রেসিডেন্ট শন পার্কার, বিল গেটস, স্টিভ জবস সোশাল মিডিয়ার ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে মুখ খুলেছেন। আসুন জানি, সোশাল মিডিয়াগুলোর এমন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার কারণ কি?

১। সোশাল মিডিয়ার অপ্রতিরোধ্য জনপ্রিয়তার কারণ মানুষের শোঅফ প্রবৃত্তি। সক্রেটিস বলেছিলেন, "আমি পৃথিবীতে সবচেয়ে জ্ঞানী। কারণ আমি অন্ততঃ এটুকু জানি যে আমি কিছু জানিনা"। আমরা সিক্রেটিসের মত না। কিছু জানিনা- আমরা কেউ একথা মানতে রাজী নই। আমরা মনে করি, আমরা বহুকিছু জানি। অনেকেই অনেক অনেক বেশী জানি। জানি বলেই তা অন্যকে জানাতে চাই। আর এই জানানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছি সোশাল মিডিয়াগুলোকে।

২। মানুষের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, সে প্রশংসা পেতে চায়। প্রতিটা মানুষ নিজ নিজ কাজের ক্ষেত্রে ( ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার, শিক্ষক, বিজ্ঞানী, কৃষক, গবেষক, ব্যবসায়ী, গায়ক, চিত্রকর, অভিনেতা...যাই হোক) পরিশ্রম করে তার কাজ দিয়ে অন্যকে সে কাজের সুবিধা বা বিনোদন দিতে চায়। সেই সাথে চায় তার কাজের পুরষ্কার পেতে। খুব কম লোক পাওয়া যাবে যে তার কাজের সুনাম বা স্বীকৃতি চায়না। এই স্বীকৃতি পাবার ইচ্ছার কারণে মানুষ বিভিন্ন সোশাল মিডিয়ায় নিজের কাজ, ভাবনা, ক্ষমতা ইত্যাদি তুলে ধরে।

৩। মানুষ সৌন্দর্য্যপ্রিয়। সুন্দর কোনকিছুর প্রতি মানুষের আকর্ষণ অনাদি অনন্তকাল থেকে। মানুষ চায় নিজেকে দেখতে সুন্দর লাগুক, অন্যরা সুন্দর বলুক। যাদের চেহারা এমনিতেই সুন্দর, তারা চায় সে সৌন্দর্য ধরে রাখতে আর অন্যকে সে সৌন্দর্য্য দেখাতে বা অন্যের সৌন্দর্য্য দেখতে। প্রসাধন সামগ্রী, পোষাক, গহনা, জুতা,...ইত্যাদি, এমনকি ডাক্তারদের রমরমা ব্যবসা এই চেহারাকে ঘিরেই। অত সুন্দর যে ঐশ্বর্য রাই, সেও প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছে। স্লিমিং সেন্টার, বডি বিল্ডিং সেন্টার, ওজন কমানো বা বডি ফিটনেস মেডিসিন... সবই হয় একই উদ্দেশ্যে। এই সৌন্দর্য্যপ্রিয়তার কারণেই সোশাম মিডিয়ায় মানুষ, প্রাণী, প্রকৃতির ছবি, ভিডিওর বন্য।

৪। স্বভাবগত ভাবেই বেশীরভাগ মানুষ বহির্মুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সে তার ভাবনা, মতামত, ভাললাগা, মন্দলাগা, সৃজনশীলতা - এগুলো প্রকাশ করে অন্যদের প্রভাবিত করতে চায়। সেইসাথে চায় তার ভাল গুণ ( যেমন চেহারা, লেখার ক্ষমতা বা যেকোন সৃজন ক্ষমতা, দক্ষতা, আর্থ-সামাজিক অবস্থান, রাজনৈতিক ক্ষমতা, অনুভূতি, ভাবনা... - এগুলো অন্যকে জানিয়ে অন্যের কাছে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে। নিজের যোগ্যতা দিয়ে অন্যকে নিজের বক্তব্য মানতে উদ্বুদ্ধ করতে। একারণেই আমরা নিজেকে অন্যের কাছে তুলে ধরার জন্য সদা সচেষ্ট থাকি। আর এই তুলে ধরার সহজলভ্য একটি মাধ্যম হলো সোশাল মিডিয়া।

৫। অজানা বা নতুন কোনকিছুর প্রতি মানুষের আকর্ষণ দূর্নিবার। তাই নতুন প্রযুক্তি, সুবিধা বা মাধ্যম আমাদেরকে চুম্বকের মত টানে।

৬। নিষিদ্ধ কোনকিছুর প্রতি মানুষের আকর্ষণ সবচেয়ে বেশী। সোশাল মিডিয়াগুলো মানুষের এসব চাহিদাকে মাথায় রেখে বানানো হয়েছে। পরকীয়া, নতুন সম্পর্ক তৈরী, অপরিচিত কাউকে সরাসরি দেখা, জানা, কথা বলা ইত্যাদি যা প্রকাশ্যে সহজ নয়, তা মিডিয়াতে সম্ভব।

৭। মানুষ কৌতুহলপ্রিয়। সে নতুন নতুন তথ্য জানতে ও জানাতে চায়। তাই ধর্ম বা রান্না বিষয়ক, সচেতনতামূলক, ব্যবসা সংক্রান্ত, বিনোদনমূলক ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরতে লোকে সোশাল মিডিয়াগুলোকে ব্যবহার করে।

৮। সোশাম মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশী মানুষের মনোযোগ টানতে পারে নানা অপরাধ বিষয়ক ছবি, খবর বা ভিডিওগুলো। তার কারণ মানুষ স্বভাবগতভাবে ন্যায় পরায়ণ। সে যেকোন অন্যায়ের প্রতিকার চায়। প্রতিকার করতে না পারলে অন্তত মানুষ অন্যায় তুলে ধরে তার ক্ষোভ প্রকাশ করে আত্মতৃপ্তি পেতে চায়। নিজে একা কোন অপরাধের প্রতিকার করতে না পারলে সমন্বিতভাবে করতে চায়। এজন্য সে ব্যবহার করে সোশাল মিডিয়াকে। মায়ানমারের গণহত্যার ছবি ও ভিডিওগুলো এজন্যই সবচেয়ে বেশী মানুষের মনোযোগ কেড়েছে। তেমনি রাজন, খাদিজা, তনু, সাবিনা.... এমন হাজার উদাহরণ আছে।

৯। মানুষ বিনোদন পেতে চায়, নিজের একাকীত্ব ভুলতে চায়, অবসর কাটাতে চায়। এসব চাহিদা মেটাবার সবচেয়ে সহজলভ্য মাধ্যম হিসেবে সে বেছে নেয় সোশাল মিডিয়াগুলোকে।

১০। অন্তর্ভুক্তির চাহিদা মানুষের মৌলিক মানসিক চাহিদাগুলোর অন্যতম। নিজ আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু, কমিউনিটি, দেশ, মানুষ, এলাকা, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির সাথে যুক্ত থাকার চাহিদা মেটায় সোশাল মিডিয়াগুলো।

সোশাল মিডিয়ার ভাল দিকঃ

সোশাল মিডিয়াগুলো ব্যক্তিগত যোগাযোগ, কথা বলা, ছবি দেখা, ভিডিও দেখা... ইত্যাদির সুবিধা দেয়াতে মানুষ অনেক দূরে থেকেও কাছাকাছি থাকতে পারে। ফলে মন খারাপ বা কষ্টের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। অনেক তথ্য আদান প্রদান সহজ হয়েছে। বন্ধু, আত্মীয় বা পরিচিতরা কে, কোথায় কি করছে, সব জানা যায় ফেসবুকে।

সারা বিশ্বের অনেক খবর, তথ্য, ঘটনা জানা যায়। রাজনের খুনীকে সৌদিতে ধরা সম্ভব হয়েছিল ফেসবুকের কল্যাণে। খাদিজাকে কোপানোর ভিডিও দেখা, মায়ানমারে গণহত্যার ছবি-ভিডিও দেখা, সারা পৃথিবীর নানা দূর্লভ ছবি ও ভিডিও দেখা, ধর্ম, ঐতিহ্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি, আবিষ্কার ইত্যাদি বিষয়ক নানা তথ্য জানা, নানা পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখা, রান্নার রেসিপি, ডাক্তারী পরামর্শ, বিপদগ্রস্ত কারো জন্য সাহায্যের আবেদন.. ইত্যাদি সবই হয় ফেসবুকে। শিশু আইলানের ছবি কাঁদিয়েছে গোটা বিশ্বের বিবেকবান মানুষদের। এমন হাজার উদাহরণ আছে যা সোশাল মিডিয়ার ভাল দিক।

সোশাল মিডিয়ার মন্দ দিকঃ

অভিভাবকদের কাছে এর প্রধান খারাপ দিক হল ছেলেমেয়েদের সময় নষ্ট, পড়ার ক্ষতি, টাকা নষ্ট, অসামাজিক হয়ে যাওয়া, মিডিয়ার সুযোগে প্রেমে ও পরকীয়ায় জড়ানো, মানবিক বোধ কমে যাওয়া, বুদ্ধির বিকাশ কম হওয়া, আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি, ব্লুহোয়েলের মত ক্ষতিকারক গেমে আসক্তি,.. ইত্যাদি।

ফেক আইডি খুলে অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল, অন্যের আইডি হ্যাক করে তার অপব্যবহার, প্রেমিকার নুড ছবি পোস্ট করা বা পোস্ট করার ভয় দেখিয়ে অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য করা, সোশাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে কারো বিশ্বাস বা মূল্যবোধে আঘাত দেয়া,... ইত্যাদি খারাপ দিকও আছে।

শোঅফের লজ্জাজনক দিকও আছে। সৌদি কিশোরের দাদার লাশের সাথে তোলা সেলফি ফেসবুকে আলোড়ন তোলে। জবাই করা কোরবাণীর গরুর পিঠে বসা সেলফি, তারাবীহ্ নামাজরত সেলফি, এক বন্যাপীড়িত বালককে এক মগ খিচুড়ি দিতে বারো জন মানুষের ছবি, ইত্যাদি মানুষের শোঅফের বাড়াবাড়ি।

আমার অভিজ্ঞতাঃ

আমি মনে করি ফেসবুকের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো সাহিত্যচর্চার বা লেখালেখির সুযোগ সৃষ্টি করা এবং অপরাধ বিষয়ক ও সচেতনতামূলক লেখাগুলোর প্রতি মানুষের মনোযোগ টানতে পারা। মনের ভাবনা ইচ্ছামত প্রকাশের সবচেয়ে ভাল উপায় হলো ফেসবুক, ব্লগ বা অনলাইন পত্রিকাগুলো। এগুলো আসলে মানুষের নিজেকে প্রকাশ করার ইচ্ছার বাস্তবায়নের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যম। এজন্য সোশাল মিডিয়ায় মানুষের উপস্থিতি এত রমরমা। এগুলো অবশ্যই মানুষের মানসিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে (আগে উল্লেখিত) ব্যবহার করে ঘটে চলা একটা ব্যবসায়িক গেম ছাড়া কিছু নয়। নানা প্রয়োজনে এগুলো তৈরী করে হলেও এখন এসবের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বাড়ছে। এজন্য যারা এগুলো তৈরী করেছিলেন, দেরীতে হলেও তারা এগুলোর ভয়াবহতা বুঝতে পেরেছেন এবং তা স্বীকার করছেন। মুশকিল হলো - কুইনিন জ্বর সারাবে, কিন্তু এখন কুইনিন সারাবে কে?
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:০১
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×