পরাজিত মানবতা
কখনও স্বার্থের কারণে, কখনও ধর্মের কারণে, কখনও প্রতিশোধের কারণে সারা পৃথিবীতে সব ধর্মের নিরপরাধ মানুষ নির্যাতিত ও খুন হচ্ছে। এরফলে দেশে দেশে মানবতা পরাজিত হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ, ধর্মান্ধ বা ক্ষমতাবানদের দ্বারা ক্ষমতাহীন বা সংখ্যালঘু মানুষদের হত্যা, নির্যাতন বা বিতাড়ণ এখন স্বাভাবিক ঘটনা।
রংপুরে ফেসবুকে একটি ধর্মীয় উস্কানিমূলক স্টেটাস দেয়ার কারণে এপর্যন্ত একজন মানুষ খুন হয়েছে। চল্লিশটি পরিবার হয়েছে নিঃস্ব। আমি হলপ করে বলতে পারি, বাংলাদেশের অনেক মুসলিম এতে খুশী হয়েছে। এই বর্বরতার জন্য দায়ীদেরকে তারা মনে মনে সমর্থন করে। তার কারণ দেশে দেশে মুসলিমদের নির্যাতিত হওয়া, ভারতে হিন্দুদের দ্বারা মুসলিম নির্যাতন ও বাংলাদেশে হিন্দুদেরকে নানা সুবিধা প্রদানের ফলে তাদের প্রতি ঈর্ষা। ভারতে গোটা একটা বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে একজন মুসলিম অধ্যাপক পাওয়া যায়না। আর বাংলাদেশে? আমি রংপুরে হিন্দুদের উপরে নির্যাতনের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। কারণ সেখানে নিরপরাধ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। স্টেটাস দিয়েছে একজন। আক্রান্ত হয়েছে অনেকে। রামুতেও একই ঘটনা ঘটেছিল। তবে তাই বলে ঐ উস্কানিমূলক স্টেটাসদাতাকেও আমি সমর্থন করছি না। উভয়েই আমার মতে সমান অপরাধী। আমি সব ধর্মের মানুষের ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করাকে তীব্রভাবে ঘৃণা করি। কারণ ধর্ম হলো যার যার বিশ্বাস। সেখানে মানুষের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা উচিত। সবার কাছেই তার নিজের ধর্ম শ্রেষ্ঠ। তাই কোন ধর্মকেই হেয় করে কিছু বলা বা লেখাকে আমি অনুচিত বলে মনে করি।
ইসলাম ধর্ম তথা মুসলিমদেরকে নিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে যত অশ্লীল কথা লেখা বা বলা হয়, অন্য কোন ধর্ম নিয়ে ততটা হয়না। তার কারণ, মুসলিমদের প্রতি অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিরূপ মনোভাব ও ইসলাম ধর্মের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধের অভাব। মুসলিমরা নির্যাতিত হলে অন্য ধর্মাবলম্বীরা অখুশী হয়না। বরং মনে মনে খুশীই হয়। তা না হলে দেশে দেশে মুসলিমরা এভাবে নির্যাতিত হতো?
বর্তমানে সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে নির্যাতিত জাতি হচ্ছে মুসলিমরা। কেন তারা নির্যাতিত হচ্ছে? এই 'কেন'-র উত্তর জানাটা খুব জরুরী। সারাবিশ্বে মুসলিমদের ভাবমূর্তি হলো - এরা হিংস্র, বর্বর, সন্ত্রাসী জাতি। তার কারণও আছে। মুসলিমদের নানা কর্মকাণ্ড মানুষকে এরকম ধারণা দিতে ভূমিকা রেখেছে। আমেরিকা বা অন্যরা মুসলিমদের এমন ভাবমূর্তিকে প্রচার করে তাদের নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য কাজে লাগিয়েছে।
হিটলারের নাৎসী বাহিনীর গণহত্যা, আমেরিকার আগ্রাসন, ভারতীয় হিন্দুদের দ্বারা মুসলিম নিধন, ইসরাইলী গণহত্যা বা সর্বশেষ মায়ানমারের বৌদ্ধরা গণহত্যা করলেও কেউ তাদের সন্ত্রাসী বলেনা। একটু নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যাবে, বিশেষ কিছু কারণে মুসলিমদের নির্যাতন করা হয় বা সন্ত্রাসী বলা হয়। যেমন -
১। শিয়া-সুন্নী বিরোধ, ইরাক কর্তৃক কুয়েত আক্রমণ, তালেবানদের ধর্ম মানতে মানুষকে বাধ্য করা, টুইন টাওয়ার আক্রমণ, ভারতের তাজ হোটেলে আক্রমণ ইত্যাদি নানা কাজের কারণে মুসলিমদের প্রতি অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিরূপ মনোভাব তৈরী হয়েছে। তাদের প্রতি ঘৃণা বেড়েছে। এটাকে কাজে লাগিয়ে অন্যরা নিজেদের স্বার্থে মুসলিমদেরকে 'সন্ত্রাসী' উপাধি দিয়ে মুসলিমদের দেশ দখল, সম্পদ হরণসহ তাদের উপর নানা নির্যাতন করছে।
২। ইরাক, ইরান, পাকিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তানে মুসলিমদের নিজেদের মধ্যে অন্তর্কলহ (শিয়া-সুন্নি বিরোধ) ও একে অন্যকে হত্যা করার কারণে মুসলিমদেরকে বর্বর, অত্যাচারী, সন্ত্রাসী বলে ঘৃণা করা হয়।
৩। আইসিস, তালেবানসহ নানা ইসলামী গোষ্ঠীগুলোর নানা ধ্বংসাত্মক ও হিংস্র কার্যকলাপের ফলে গোটা বিশ্বে এদের কারণে সব মুসলিমদের ঘৃণা করা হয়।
৪। বিভিন্ন মুসলিম দেশের লোকেদের নানা পাপাচার, অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড, বিলাসিতা, অপরাধ মুসলিমদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা তৈরী করেছে।
৫। ইসলাম ধর্ম নিয়ে কেউ কোন কটুক্তি, কার্টুন বা লেখা লিখলে মুসলিমরা সেটা সহ্য করেনা ( ধর্মে প্রতিবাদ করতে বলা হয়েছে বলেই মুসলিমরা সেটা করে, যা আর কোন ধর্মের লোকেরা করেনা)। তারা 'মুরতাদ' ঘোষণা দিয়ে দেশছাড়া করে, খুন করে, উগ্র আচরণ করে যার কারণে মুসলিমদেরকে অন্যরা 'বর্বর' বলার সুযোগ পায়। আমরা প্রতিবাদ করি বলেই সালমান রুশদীরা বিখ্যাত হয়ে যায়। কোন নাস্তিক বা বিধর্মী কিছু বললেই কি ইসলাম ধ্বংস হয়ে যাবে? ইসলাম কি অতই ঠুনকো? মুসলিমরা বিশ্বাস করে, ইসলামকে রক্ষা করবেন আল্লাহ স্বয়ং। যারা ইসলামের কুটসা করছে, তাদেরকে কেয়ামতের দিন আল্লাহ ঠিকই শাস্তি দেবেন। আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করলে ধর্ম নিয়ে উগ্রতা, বাড়াবাড়ি করে আত্মতৃপ্তিতে ভুগে নিজেদের ভাবমূর্তি নষ্ট করতাম না।
৬। ভারতে সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ খুন হয়েছেন। সেটা নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য কেউ করেনি। কারণ এগুলো গুপ্তহত্যা। কে করেছে, কেন করেছে তা নিশ্চিত করে বলা যায়না। কিন্তু মুসলিমরা খুন করে প্রকাশ্য ঘোষণা দেয় বা হত্যার পর দায় স্বীকার করে। এটি ভয়াবহ। এটি মুসলিমদের অসহিষ্ণু ও ঠান্ডা মাথার খুনী জাতি বলে আখ্যায়িত করে। আইসিসের বিভৎস হত্যাকান্ডগুলো ও নির্যাতন তার স্বীকৃতি দেয়।
৭। জোর করে কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ম পালনে মুসলিমরা ছাড়া আর কোন ধর্মাবলম্বীরা বাধ্য করেনা। এটি ব্যক্তিস্বাধীনতার বিপরীত বলে এ ধর্মের লোকেদের কেউ পছন্দ করেনা।
৮। মুসলিমরা সংগঠিত নয়। ধনী, ক্ষমতাবান মুসলিম দেশগুলো স্বার্থের কারণে ইহুদীদের সাথে হাত মেলায়। মুসলিম দেশগুলোর পাশে দাঁড়ায় না। এটিও মুসলিমদের নির্যাতিত হবার কারণ।
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর অভ্যাস ছিলো কোনো না কোনো মেহমানকে সাথে নিয়ে খাওয়া। একদিন তিনি অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও কোন মেহমান না পেয়ে একজন বৃদ্ধ ভিক্ষুককে নিয়ে খেতে বসলেন। ইব্রাহীম (আঃ) বিসমিল্লাহ্ তথা আল্লাহর নামে খাবার মুখে তুললেন; কিন্তু ভিক্ষুক বিসমিল্লাহ্ না বলেই খাওয়া শুরু করল। ইব্রাহীম (আঃ) ভিক্ষুককে প্রশ্ন করলেন, "আপনি আল্লাহর নাম না নিয়েই খাওয়া আরম্ভ কেন করলেন?"
ভিক্ষুক বলল, "আমি বাপু আল্লাহ্-তে বিশ্বাসী নই। পেলে খাই, আর না পেলে না খেয়েই থাকি। কারো নাম নেওয়ার দরকার মনে করি না।" ইব্রাহীম (আঃ) খুব রাগান্বিত হয়ে বললেন, "হে অকৃতজ্ঞ বান্দা! তুমি এখান থেকে চলে যাও। আমার এই খাবার তোমার মত নাফরমান ব্যক্তির জন্য নয়।" বৃদ্ধ ভিক্ষুকটি তখন মন খারাপ করে না খেয়েই সেখান হতে চলে গেলেন। সাথে সাথে আল্লাহর পক্ষ হতে ওহী আসলো যে, "হে ইব্রাহীম! আমি এই ভিক্ষুককে দীর্ঘ ৮০ বছর যাবৎ আহার করিয়ে আসছি। আমি কখনোই অভিযোগ করি নাই, কারণ সে আমারই বান্দা। আর তুমি তাকে এক বেলা খাওয়াইতে রাজি হলে না!!!" ইব্রাহীম (আঃ) তখন তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন, এবং ভিক্ষুককে খুঁজতে লাগলেন, কিন্তু তাকে আর পেলেন না। অতঃপর তিনি অনুতপ্ত হলেন এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলেন।
যুগে যুগে বহু লোক ইসলামের বিরোধীতা করেছে, কেয়ামত পর্যন্ত করবে। তাই বলে একজন বা দুচারজনের বিরুদ্ধ মতামতের কারণে অনেক নিরপরাধ মানুষকে খুন বা নির্যাতন করা কতটা যৌক্তিক? ইসলাম বলছে, একজন মানুষকে, (মুসলিম বা বিধর্মী বা নাস্তিক হলেও) খুন করার অর্থ গোটা মানবজাতিকে খুন করা। ধার্মিক হলে আমাদের বিশ্বাস করা উচিত, যারা ইসলাম নিয়ে কটুক্তি করছে, তাদের এ মন্দ কাজের শাস্তি আল্লাহ পরকালে ঠিকই দেবেন।
মুসলমানদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। তুচ্ছ কারণে সন্ত্রাসী আচরণ বন্ধ হওয়া দরকার। নিজেদের অন্তর্কলহ বন্ধ হওয়া দরকার। যেকোন কারণেই নিরপরাধ মানুষকে নির্যাতন বা হত্যা বন্ধ হওয়া দরকার। ইসলাম শান্তির ধর্ম হলে একজন মুসলিম কোনভাবেই অন্য ধর্মের কোন নিরপরাধ মানুষকে নির্যাতন করতে পারেনা।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০১