২৭ অক্টোবর সারা দেশে একযোগে ৪০টি হলে মুক্তি পেয়েছে বাংলাদেশের জাজ মাল্টিমিডিয়া এবং ভারতের এসকে মুভিজের ব্যানারে নির্মিত মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী পরিচালিত ষষ্ঠ ছবি ‘ডুব’। বাংলাদেশ ছাড়াও ছবিটি মুক্তি পেয়েছে ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার একাধিক হলে। খুব শীঘ্রই ছবিটি মুক্তি দেওয়া হবে আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স এবং মালয়েশিয়াতে।
রিভিউ শুরু করার আগেই একটা কথা বলা বাঞ্ছনীয় বোধ করি। মুভি রিভিউ লেখার আগে একজন ব্লগারের প্রথম দায়িত্ব রিভিউ লিখতে গিয়ে কোন ভাবে যেন কাহিনী স্পয়লার না হয়ে যায়। কিন্তু সামুসহ বেশ কিছু ব্লগে দেখলাম তথা কথিত নির্বোধ ব্লগাররা রিভিউয়ের নামে পুরা ছবির কাহিনী বলে দিয়ে রিভিউ বলে চালিয়ে দিলেন। প্রকৃতপক্ষে মুভি রিভিউ বলতে কি আমরা এইটা বুঝি? একটা সিনেমার পজেটিভ এবং নেগেটিভ বিষয় থাকতেই পারে। কিন্তু সেটাকে রিভিউতে লিখতে হয় ছবির কাহিনী স্পয়লার না করেই।
বহুল আলোচিত ছবিটিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন ভারতের ইরফান খান যিনি ছবিতে জাভেদ হাসান নামের একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার চরিত্র পোট্রে করেছেন। জাভেদ হাসানের প্রথম স্ত্রী মায়ার চরিত্রে ছিলেন রোকেয়া প্রাচী এবং দ্বিতীয় স্ত্রী নীতুর চরিত্রে ভারতের পার্ণো মিত্র। প্রথম পক্ষের কন্যা সাবেরির চরিত্রে ছিলেন তিশা।
যাই হোক। ছবি মুক্তির আগে থেকেই ছবিটি নিয়ে নানান ধরণের বিতর্ক ছিল। বলা হয়েছিল, ছবিটি হুমায়ূন আহমেদের বায়োপিক যেটা কিনা তাঁর পরিবারের অনুমতি ছাড়াই নির্মিত হয়েছে। তবে ছবিটি দেখে এটাকে বায়োপিক মনে হয় নি। হয়তো হুমায়ূন আহমেদের জীবনের কিছুটা ছায়া পাওয়া গিয়েছে তবে ছবির গল্পটি তাঁর জীবনকে ছাপিয়ে প্রকাশ পেয়েছে আরো কিছু সাধারণ পরিবারের খণ্ড খণ্ড গল্প। সেই সাথে পারিবারিক টানাপড়েন এবং বিচ্ছেদের পর একজন নারীর জীবনে সংগ্রাম করে ঘুরে দাঁড়াবার গল্প।
ছবিতে অভিনয়ের কথা বলতে গেলে বলতে হয় কেন্দ্রীয় চরিত্র থেকে শুরু করে মাত্র একটি দৃশ্যে অভিনয় করা অভিনেতা অভিনেত্রী সকলেই নিজেদের সেরা কাজ দিয়েছেন। ছবিতে ইরফান খান, রোকেয়া প্রাচী, তিশা কিংবা পার্ণো যেমন মন প্রাণ ঢেলে অভিনয় করেছেন ঠিক তেমনি পুলিশ, মায়ার বাবা অথবা জাভেদ হাসানের ভক্তের চরিত্রগুলোর অভিনয় ভালো লেগেছে। সংলাপ ছাড়াই যথাযথ ভাবে নিজ নিজ জায়গা থেকে সেরা নির্বাক অভিনয় করেছেন নয়নতারা ফিল্ম সিটির কেয়ার টেকার কিংবা মায়ার আইনজীবী চরিত্রগুলোতে অভিনয় করা অভিনেতারা। তবে সংলাপ ডেলিভারিতে ইরফান খান আরেকটু সাবলীল হলে ভালো হত। কিছু কিছু জায়গায় তার জড়তা লক্ষ্য করা গিয়েছে। তবে অসাধারণ অভিনয়শৈলীর জন্য তাকে এতটুকু মওকুফ করাই যায়।
ছবিতে দুর্দান্ত লেগেছে ক্যামেরার কাজ। খুব সাধারণ দৃশ্য দেখিয়ে তার মাঝেই যে রূপক অর্থে অনেক কথা বলা যায় সেটা এই ছবির নিপুন দৃশ্যায়ন না দেখলে বোঝা যাবে না। বারান্দার গ্রিলের ছায়ার মাধ্যমে জীবনের উত্থান পতন, ঝড়ো হাওয়ায় গাছের পাতার উত্তাল নাচনের মাধ্যমে পারিবারিক টানাপড়েন কিংবা সূর্যাস্তের সাথে জীবনাবসানের রূপক অবস্থা বোঝানোর দৃশ্যগুলো ছিল সত্যি চোখে লেগে থাকার মত। চোখে নেশা লেগেছে ড্রোনের মাধ্যমে নেওয়া প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো দেখে।
এটি কোন বাণিজ্যিক ধারার ছবি নয় যে ঢাকা অ্যাটাকের মত ধুমধারাক্কা কাহিনী থাকবে, এটা নেহায়েত একটি আর্ট ফিল্ম। ঢাকা অ্যাটাককে ছোট করছিনা কিন্তু। আমি সর্বভুক মুভিখোর। তবে কিছু কিছু দর্শক ঢাকা অ্যাটাকের সাথে ডুবের তুলনা করছেন। তাদের অন্তত দুই ধারার ছবির পার্থক্য বুঝে সমালোচনায় আসা উচিত। আমি বলবো দুটি ছবিই দুই ধারার দিক থেকে সেরা। ডুব ছবির কাহিনীর যে গভীরতা সেটা বুঝতে গভীর মনযোগ দিয়ে ছবিটি দেখা উচিত। পপকর্ণ চিবিয়ে চিবিয়ে দেখার মত ছবি নয় ‘ডুব’। ছবির গল্পের কথা বললে বলতে হয় পুরো ছবিতে ফারুকীর গল্প বলার ধরণটি ছিল অসাধারণ। বিভিন্ন সময়কে এক সূত্রে গেঁথে সেটাকে যথাযথ ভাবে ফুটিয়ে তোলা আসলেই কঠিন কাজ। পরিচালক সেই দিক থেকে পুরোপুরি সার্থক।
অনেককে বলতে শোনা গেল, জাভেদ হাসানকে এইভাবে নেতিবাচক ভাবে প্রকাশ করা ঠিক হয়নি। নিতুকে এইভাবে ভিলেনরূপে দেখানো ঠিক হয় নি। এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য, একজন গল্পকার যখন কাহিনী রচনা করেন কিংবা পরিচালক চরিত্রের রূপদান করেন তখন তাকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া উচিত তাঁর কাজের জন্য। আর বিচার করা উচিত চরিত্রগুলোর অভিনয়শৈলী দেখে, চরিত্রের ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক অবস্থা দেখে নয়।
ছবির রূপসজ্জা এবং পোশাক পরিচ্ছদ যথাযথ মনে হয়েছে। যেহেতু এটি আর্ট ফিল্ম সেহেতু যতটুকু মেকআপ দরকার এবং চরিত্র অনুযায়ী যেমন পোশাক দরকার ঠিক তেমনটাই ব্যবহার করা হয়েছে। কোথাও আধিক্য লক্ষ্য করা যায়নি।
পুরো ছবিতে মাত্র একটি গান ব্যবহার করা হয়েছে। ‘আহারে জীবন’ শিরোনামের গানটি করেছেন চিরকুট ব্যান্ড। ছবির কাহিনীর সাথে অসাধারণ ভাবে মিশে গিয়েছে গানটি। ভালো ছিল পুরো ছবির আবহ সংগীতও।
সর্বপরি বলতে হয়, ফারুকী অন্যান্য ভিন্ন স্বাদের ছবির মতই ‘ডুব’ ছবিটিও ছিল অনন্য। ভিন্ন ধারার এই ছবিটির রস আহরণ করতে মনযোগ দিয়ে দেখতে হবে ছবিটি। ছবির গভীরতা আবিষ্কার করতে পারলেই দারুন উপভোগ্য হতে বাধ্য ‘ডুব’।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৮:৩৫