somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

খাই খাই কর কেন, এস বস আহারে - খাওয়াব আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে। (১ম খন্ড)

০১ লা মে, ২০১৩ রাত ১২:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সামুর স্টিকি পোষ্ট টিতে সাড়া দেই সবাই। আসুন আমরা সবাই আমাদের রসনার লাগাম টেনে ধরি। নিজেদের বিলাসী খাদ্য তালিকা ছেটে ফেলে কিছু অর্থ তুলে দেই সাভার ট্রাজেডীর হতভাগ্য মানুষগুলোর শিশু সন্তানদের ভবিষ্যৎ এর জন্য।
তখন ক্লাস এইটে পড়ি। আমাদের স্কুল এর পাশে ভিসিআর এর ঘর ছিল। মার দাঙ্গা সব সিনেমা চলত। ক্লাসের বেঞ্চিতে সারি সারি বই, ছাত্র নেই! আমরা সব যথারিতী ভিসিআর এর ঘরে ২টাকা টিকেটে ম্যায়নে প্যেয়ার কিয়া দেখছি। এমনই ছিল শৈশবের সেই দুরন্ত দিনগুলি। তো একবার খুব ইচ্ছে হলো পাশের উপজেলা শাহজাদপুরের বিখ্যাত সিনেমা হল ‘দিলরুবা’ তে সিনেমা দেখব। সপ্তাহ দুয়েক লাগল যাওয়া আসা আর টিকেটের টাকা ম্যানেজ করতে। যাওয়া আসা ২ টাকা, আর টিকেট ৮ টাকা। সেই বয়সেই কিন্তু আমি ভাই উদ্যোক্তা! বাবার বাগানের এক কোনায় গোলাপের ডালে গোবর লাগিয়ে কলম দিতাম গোলাপের চাড়া। আমাদের বাগানের গোলাপের সুখ্যাতি ছিল আশ-পাশের এলাকা জুড়ে। বাবার বাগানের এই সুখ্যাতি কাজে লাগিয়ে নিজের অপকর্মের পুজি তৈরি করবার সুযোগ বেশ ভালমতই কাজে লাগাতে পেরেছিলাম! তো, সেই পনেরো দিন লাগল দুখানা গোলাপের চাড়া বিক্রি করতে! অবশেষে দশ টাকা জোগাড় হলো। চললাম একদিন ক্লাস ফাকি দিয়ে, একাই। একটাকা বাস ভাড়া। সিনেমা চলছে ‘লালু মাস্তান’। সিনেমা দেখা হলো। ফিরবার পালা, দুপুর তিনটা বাজে। খিদেয় পেট চো-চো। শাহজাদপুর বাস স্ট্যান্ড এ এক চৌকির উপর বসে অপেক্ষা করছি। চারিদিকে ফাকা, শুধু এক লোক পাশেই বিরামহীন শব্দে খড়ি ফেড়ে চলেছে। একটু পরই সেই লোক লুঙ্গিতে মোড়া একখানা সানকি নিয়ে আমি যে চৌকিতে বসে আছি, সেটিতে এসে বসে পড়লো। আমি আড়চোখে সানকির দিকে তাকাচ্ছি! কি বের হয় ভেতর থেকে দেখবার জন্য! পেটে খিদে, চোখ তো একটু ছুচোমী করবেই! সেই লোক খুব সযত্নে লুঙ্গির কাপড় দিয়ে মোড়ানো সানকি উম্মোচন করলেন। খড়খড়ে ভাত আর শুকনো মরিচ বাটা, এক কোনায় এক খাবলা নুন। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। কিন্তু কিছুক্ষন পরেই তার খাওয়ার শব্দে ফিরে তাকাতে হলো। লোকটি কি মনোযোগ সহকারে আহার কর্মটি যে সম্পাদন করছিলেন তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। একটি ভাতও পড়ে রইল না সানকিতে। শেষে আঙ্গুলের আগায় একটু বেচে থাকা নুন নিয়ে চাটতে চাটতে সানকি হাতে অনতিদূরে টিউবওয়েলে গিয়ে দু-সানকি পানি পান করলেন। আমার পেটের মধ্যে ছুচোর কেত্তন! পকেটে অবশিষ্ট এক টাকা। এই এক টাকা ছুচোমী করে খাবারের পেছনে খরচ করলে ১২ কিলোমিটার হেটে হেটে বাড়ি ফিরতে হবে। খিদেয় মরে যাবো তবুও এই ঝুকি নিতে নারাজ আমি। বাস এসে গেল, স্কুলে ফিরে এলাম। ক্লাসের সবার কাছ থেকে জানতে পারলাম, বাংলা স্যার, মৌলভী স্যার সহ কয়েকজন শিক্ষক ক্লাসের প্রথম ছাত্রকে খুজে পায়নি। আমার করিতকর্মা কয়েকজন বন্ধু আমার বই লুকিয়ে রেখে স্যারদেরকে বলেছে, ‘‘স্যার ওর তো অসুখ, আসার সময় ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, খেতা গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। জলপট্টি চলছে।”

সেদিনের সেই খড়ি ফাড়াইওয়ালার খাওয়া দেখবার পর থেকে আমি জীবনে মায়ের কাছে কোনো কিছু খাওয়ার বায়না ধরিনি, কোনোদিন খাবার নষ্ট করিনি এবং শিখেছি বেঁচে থাকবার জন্য খাওয়া, খাওয়ার জন্য বেঁচে থাকা নয়। সেদিন স্কুল না পালালে হয়তো এই শিক্ষাটা আমার হতো না। আমার স্ত্রীও প্রায় সকল সময় অভিজোগ করে থাকেন, ‘‘তুমি কি! কোনোদিন রান্নার প্রশংসা বা নিন্দা কর না। আমার রান্না ভালো না বুঝি, কিন্তু মিথ্যে করেও তো প্রশংসা করতে পারো খুশি করবার জন্য।”

কি করে উনাকে বোঝাই, সেই খড়িফাড়াইওয়ালার খাওয়া দেখবার পর থেকে আমার জিহ্বায় স্বাদ বলে আর কিছু নেই। নুন হোক বা না হোক, তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। পেট খানা পরিমিত পরিমান ভারী হলেই আমার সব ঠিক। আমার কাছে কেএফসি ও যা, আবার গুলশান ডিসিসি মার্কেটের সামনের যাত্রী ছাউনি নীচের চিকেন ফ্রাইও তা। এমনকি খেতে বসে কোনোদিন কাওকে বলিনি একটু পানির গ্লাসটা দাও, বা এটা দাও ওটা দাও। সেই দিনের পর থেকে নিজের ভাত নিজে বেড়ে খেয়েছি। আমার মা আর বড় বোনগুলো খুবই অবাক হয়েছিল আমার সেসময়ের পরিবর্তনে। তারা কেওেই জানে না আমার পরিবর্তনের পেছনের সেই খড়ি ফাড়াইওয়ালার ভুমিকা। সেই মেদহীন পরিশ্রমী লোকটি ছিলেন আমার সেইদিনের, সেই মুহুর্তের শিক্ষক।

সুকুমার রায় এর সেই ছড়াটির কথা কি সবার মনে আছে? আমার খুব প্রিয় ছড়া। আসুন পড়ে দেখি!

খাই খাই
সুকুমার রায়

খাই খাই কর কেন, এস বস আহারে -
খাওয়াব আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে।
যত কিছু খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে,
জড় করে আনি সব,- থাক সেই আশাতে।
ডাল ভাত তরকারি ফলমূল শস্য,
আমিষ ও নিরামিষ, চর্ব্য ও চোষ্য,
রুটি লুচি, ভাজাভুজি, টক ঝাল মিষ্টি,
ময়রা ও পাচকের যত কিছু সৃষ্টি,
আর যাহা খায় লোকে স্বদেশে ও বিদেশে-
খুঁজে পেতে আনি খেতে- নয় বড় সিধে সে!
জল খায়, দুধ খায় যত পানীয়,
জ্যাঠাছেলে বিড়ি খায়, কান ধরে টানিও।
ফল বিনা চিঁড়ে দৈ, ফলাহার হয় তা,
জলযোগে জল খাওয়া শুধু জল নয় তা।
ব্যাঙ খায় ফরাসিরা (খেতে নয় মন্দ),
বার্মার ‘ঙাম্পিতে’ বাপ্‌‌রে কি গন্ধ!
মান্দ্রাজি ঝাল খেলে জ্বলে যায় কন্ঠ,
জাপানেতে খায় নাকি ফড়িঙের ঘন্ট!
আরশুলা মুখে দিয়ে সুখে খায় চীনারা,
কত কি যে খায় লোকে নাহি তার কিনারা।
দেখে শুনে চেয়ে খাও, যেটা চায় রসনা ;
তা না হলে কলা খাও- চটো কেন? বস না-
সবে হল খাওয়া শুরু শোন শোন আরো খায়-
সুদ খায় মহাজনে, ঘুষ খায় দারোগায়।
বাবু যান হাওয়া খেতে চড়ে জুড়ি-গাড়িতে,
খাসা দেখ ‘খাপ্‌ খায়’ চাপকানে দাড়িতে।
তেলে জলে মিশ খায় শুনেছ তা কেও কি?
যুদ্ধে যে গুলি খায় গুলিখোর সেও কি?
ডিঙি চড়ে স্রোতে প’ড়ে পাক খায় জেলেরা,
ভয় খেয়ে খাবি খায় পাঠশালে ছেলেরা ;
বেত খেয়ে কাঁদে কেউ, কেউ শুধু গালি খায়,
কেউ খায় থতমত- তাও লিখি তালিকায়।
ভিখারিটা তাড়া খায়, ভিখ্‌ নাহি পায় রে-
‘দিন আনে দিন খায়’ কত লোকে হায় রে।
হোঁচটের চোট খেয়ে খোকা ধরে কান্না,
মা বলেন চুমু খেয়ে, ‘সেরে গেছে, আর না।’
ধমক বকুনি খেয়ে নয় যারা বাধ্য,
কিলচড় লাথি ঘূঁষি হয় তার খাদ্য।
জুতো খায়, গুঁতো খায়, চাবুক যে খায় রে,
তবু যদি নুন খায় সেও গুণ গায় রে।
গরমে বাতাস খাই, শীতে খাই হিম্‌ সিম্‌,
পিছলে আছাড় খেয়ে মাথা করে ঝিম্‌‌ঝিম্‌ ।
কত যে মোচড় খায় বেহালার কানটা,
কানমলা খেলে তবে খোলে তার গানটা।
টোল খায় ঘটি বাটি, দোল খায় খোকারা,
ঘাবড়িয়ে ঘোল খায় পদে পদে বোকারা।
আকাশেতে কাৎ হ’য়ে গোঁৎ খায় ঘুড়িটা,
পালোয়ান খায় দেখ ডিগবাজি কুড়িটা।
ফুটবলে ঠেলা খাই, ভিড়ে খাই ধাক্কা,
কাশীতে প্রসাদে খেয়ে সাধু হই পাক্কা!
কথা শোন, মাথা খাও , রোদ্দুরে যেয়ো না-
আর যাহা খাও বাপু বিষমটি খেও না।
ফেল্‌ করে মুখ খেয়ে কেঁদেছিল সেবারে,
আদা- নুন খেয়ে লাগো পাশ কর এবারে।
ভ্যাবাচ্যাকা খেও নাকো, যেয়ো নাকো ভড়কে,
খাওয়াদাওয়া শেষ হলে বসে খাও খড়্‌‌কে ।
এত খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা-
খাও তবে কচু পোড়া, খাও তবে ঘন্টা

আসুন আমরা সবাই আমাদের রসনার লাগাম টেনে ধরি। নিজেদের বিলাসী খাদ্য তালিকা ছেটে ফেলে কিছু অর্থ তুলে দেই সাভার ট্রাজেডীর হতভাগ্য মানুষগুলোর শিশু সন্তানদের ভবিষ্যৎ এর জন্য। সামুর স্টিকি পোষ্ট টিতে সাড়া দেই সবাই
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১৩ রাত ১:৪৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×