somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কর্নেল তাহেরের শেষ চিঠি

২৮ শে আগস্ট, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শ্রদ্ধেয় আব্বা, আম্মা, প্রিয় লুৎফা, ভাইজান ও আমার ভাইবোনেরা। গতকাল বিকালে ট্রাইব্যুনালের রায় দেয়া হল। আমার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছে। ভাইজান (তাহেরের বড় ভাই আবু ইউসুফ খান) ও মেজর জলিলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত। আনোয়ার, ইনু, রব ও মেজর জিয়াউদ্দিনের দশ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড ও দশ হাজার টাকা জরিমানা (প্রকৃতপক্ষে জিয়ার বারো বৎসরের কারাদণ্ড হয়েছিল)। সালেহা, রবিউলের ৫ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা (সালেহা যশোরের প্রাক্তন জাসদ নেত্রী, রবিউল সালেহার স্বামী, তৎকালীন যশোর জেলার জাসদ নেতা)। অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদি কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ড. আখলাক, সাংবাদিক মাহমুদ ও মান্নাসহ ১৩ জনকে এ মামলা থেকে খালাস দেয়া হয়েছে (সাংবাদিক মাহমুদ হচ্ছেন কে বি এম মাহমুদ একসময়ের সাপ্তাহিক 'ওয়েভ' পত্রিকার সম্পাদক আর মান্না হচ্ছেন মাহমুদুর রহমান মান্না, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক সহ-সভাপতি)। সর্বশেষে ট্রাইব্যুনাল আমার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে বেত্রাহত কুকুরের মত তাড়াহুড়া করে বিচার কক্ষ পরিত্যাগ করলো।

হঠাৎ সাংবাদিক মাহমুদ কান্নায় ভেঙে পড়লো। আমি তাঁকে সান্ত্বনা দিতে চাইলে তিনি বললেন, 'আমার কান্না এ জন্য যে একজন বাঙালি কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করতে পারলো!' বোন সালেহা হঠাৎ টয়লেট রুমে গিয়ে কাঁদতে শুরু করল। সালেহাকে ডেকে এনে যখন বললাম, 'তোমার কাছ থেকে দুর্বলতা কখনোই আশা করিনি।' সালেহা বললো, 'আমি কাঁদি নাই, আমি হাসছি।' হাসি-কান্নায় এই বোনটি আমার অপূর্ব। জেলখানায় এই বিচার কক্ষে এসে প্রথম তার সঙ্গে আমার দেখা। এই বোনটিকে আমার ভীষণ ভাল লাগে।

সমস্ত সাথীদের শুধু একটাই বক্তব্য, 'কেন আমাদেরকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো না।' মেজর জিয়াউদ্দিন বসে আমার উদ্দেশ্যে একটি কবিতা লিখলো। জেলখানার এই ক্ষুদ্র কক্ষে হঠাৎ আওয়াজ উঠল, 'তাহের ভাই-লাল সালাম।' সমস্ত জেলখানা প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। জেলখানার উঁচু দেওয়াল এই ধ্বনীকে কি আটকে রাখতে পারবে? এর প্রতিধ্বনি কি পৌঁছাবে না আমার দেশের মানুষের মনের কোঠায়?

রায় শুনে আমাদের আইনজীবীরা হতবাক হয়ে গেলেন। তারা এসে আমাকে জানালেন, যদিও এই ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না তবুও তারা সুপ্রিম কোর্টে রিট করবেন। কারণ বেআইনিভাবে এই আদালত তার কাজ চালিয়েছে ও রায় দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন করবেন বলে বললেন। আমি তাদেরকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলাম, প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন করা চলবে না। এই প্রেসিডেন্টকে আমি প্রেসিডেন্টের আসনে বসিয়েছি, এই বিশ্বাসঘাতকদের কাছে আমি প্রাণভিক্ষা চাইতে পারি না।

সবাই আমার কাছ থেকে কয়েকটি কথা শুনতে চাইলো। এর মধ্যে জেল কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে সরিয়ে নেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো। বললাম, আমি যখন একা থাকি তখন ভয়, লোভ-লালসা আমাকে চারদিক থেকে এসে আক্রমণ করে। আমি যখন আপনাদের মাঝে থাকি তখন সমস্ত ভয়, লোভ-লালসা দূরে চলে যায়। আমি সাহসী হই, বিপ্লবের সাথী রূপে নিজেকে দেখতে পাই। সমস্ত বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করার এক অপরাজেয় শক্তি আমার মধ্যে কাজ করে। তাই আমাদের একাকিত্বকে বিসর্জন দিয়ে আমরা সবার মাঝে প্রকাশিত হতে চাই। সে জন্যই আমাদের সংগ্রাম।

সবাই একে একে বিদায় নিয়ে যাচ্ছে। অশ্রুসজল চোখ। বেশ কিছুদিন সবাই একত্রে কাটিয়েছি। আবার কবে দেখা হবে। সালেহা আমার সঙ্গে যাবে। ভাইজান ও আনোয়ারকে চিত্তচাঞ্চল্য স্পর্শ করতে পারেনি। কিন্তু তাদেরকে তো আমি জানি। আমাকে সাহস জোগাবার জন্য তাদের অভিনয়। বেলালের চোখ ছলছল করছে। কান্নায় ভেঙে পড়তে চায়। জলিল, রব, জিয়া আমাকে দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো। এই আলিঙ্গন অবিচ্ছেদ্য। এমনিভাবে দৃঢ় আলিঙ্গনে আমরা গোটা জাতির সঙ্গে আবদ্ধ। কেউ তা ভাঙতে পারবে না।

সবাই চলে গেলো। আমি আর সালেহা বের হয়ে এলাম। সালেহা চলে যাচ্ছে সেলের দিকে। বিভিন্ন সেলে আবদ্ধ কয়েদি ও রাজবন্দীরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে বন্ধ সেলের দরজা-জানালা দিয়ে। মতিন সাহেব, টিপু বিশ্বাস ও অন্যান্যরা দেখালো আমাকে বিজয় চিহ্ন। এই বিচার বিপ্লবীদেরকে তাদের অগোচরে ঐক্যবদ্ধ করলো।

ফাঁসির আসামিদের নির্ধারিত জায়গা ৮ নম্বর সেলে আমাকে নিয়ে আসা হলো। পাশের তিনটি সেলে আরো তিনজন ফাঁসির আসামি। ছোট্ট সেলটি ভালোই, বেশ পরিষ্কার। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যখন জীবনের দিকে তাকাই তাতে লজ্জার তো কিছুই নেই। আমার জীবনের নানা ঘটনা আমাকে আমার জাতির ও জনগণের সাথে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। এর চাইতে বড় সুখ, বড় আনন্দ আর কী হতে পারে?

নীতু, যীশু ও মিশুর কথা_সবার কথা মনে পড়ে। তাদের জন্য অর্থ-সম্পদ কিছুই আমি রেখে যাইনি। কিন্তু আমার গোটা জাতি রয়েছে তাদের জন্য। আমরা দেখেছি শত-সহস্র উলঙ্গ মায়া-মমতা-ভালোবাসা-বঞ্চিত শিশু। তাদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় আমরা গড়তে চেয়েছি।
বাঙালি জাতির উদ্ভাসিত নতুন সূর্য ওঠার আর কত দেরি! না, আর দেরি নেই, সূর্য উঠল বলে।

এ দেশ সৃষ্টির জন্য আমি রক্ত দিয়েছি। আর সেই সূর্যের জন্য আমি প্রাণ দেব, যা আমার জনগণকে আলোকিত করবে, উজ্জীবিত করবে_এর চাইতে বড় পুরস্কার আমার জন্য আর কী হতে পারে? আমাকে কেউ হত্যা করতে পারে না। আমি আমার সমগ্র জাতির মধ্যে প্রকাশিত। আমাকে হত্যা করতে হলে সমগ্র জাতিকে হত্যা করতে হবে। কোন শক্তি তা করতে পারে? কেউ পারবে না।

আজকের পত্রিকা এলো। আমার মৃত্যুদণ্ড ও অন্যান্যদের মেয়াদি কারাদণ্ডের খবর ছাপা হয়েছে প্রথম পাতায়। মামলার যা বিবরণ প্রকাশ করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা। রাজসাক্ষীদের জবানবন্দিতে প্রকাশ পেয়েছে, আমার নেতৃত্বেই ৭ নভেম্বর সিপাহি বিপ্লব ঘটে। আমার নির্দেশেই জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয়, আমার প্রস্তাবেই বর্তমান সরকার গঠিত হয়। সমগ্র মামলায় কাদেরিয়া বাহিনীর কোন উল্লেখই ছিল না। অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান খান, জুলমত আলী ও অন্যান্য যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা যেন এই মিথ্যা প্রচারের প্রতিবাদ করেন ও সমগ্র মামলাটির সত্য বিবরণ প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক ও চক্রান্তকারী জিয়া ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা আমাকে জনগণের সামনে হেয় করার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে।

সুত্রঃ কালের কন্ঠ
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৩৭
৩৮টি মন্তব্য ৩৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×