রুনুদি
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
এ গাছগুলো কিছুতেই কাটতে দিব না।
এ তুই কেরে বাঁধা দেয়ার। আমার বাড়ির গাছ আমি কাটব, তাতে তোর কি।
শুধু আমার না এগুলো এ গ্রামবাসীর অনেক আপনজন। একশ বছর ধরে এসব গাছ আমাদের কত উপকার করছে। আর আমাদের চোখের সামনে তা কেটে ফেলবেন তা হবে না।
এই ছ্যামড়া, বেশী বাড়াবাড়ি করিস না। শহরে লেখাপড়া করিস বলে নিজেকে কি মনে করিস। আমি গাছ কাটবই-দেখি তুই কি করতে পারিস। বলে হনহন করে চলে গেল গিয়াসউদ্দিন মোড়ল। সাথে তার চারজন সহযোগী।
মোড়লের সাথে স্বপনের তর্ক শুনা মানুষের জটলা তখনো রয়ে গেছে। তারা সবাই এ গ্রামেরই মানুষ। স্বপন যখন গাছ নিয়ে গ্রামবাসীর দোহাই দিচ্ছিল তখনো তারা সেখানে ছিল। তবে কোন কথা বলেনি। সাধারণ মানুষের এই এক দোষ। কেউ না ডাকলে নিজ থেকে জাগে না। এমনকি তাদের সর্বস্ব নিয়ে গেলেও না। আড়ালে ক্ষমতাবানের বিরুদ্ধে কথা বললেও প্রতিবাদে তার খুব এগোয় না। তবে যখন জাগে তখন সব ক্ষমতাই চুর্ণ করে দেয়।
মোড়ল চলে যাবার পর স্বপন জড়ো হওয়া গ্রামবাসীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়। গাছগুলো তাদের কি উপকার করে তা নানাভাবে বুঝায় সে। শত বছর ধরে গাছ তার মায়া মমতা দিয়ে কিভাবে গ্রামবাসীকে আগলে রেখেছে। ছায়া দিয়ে, খড়ি দিয়ে কত উপকার করছে। এ গাছগুলো কাটলে পরিবেশের কত ক্ষতি হবে। তাই যে কোনভাবেই হউক মোড়লের গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে।
বাবা তোমার কথাতো বুঝলাম। কিন্তু এ জায়গাতো মোড়লের। এখন সে গাছ কাটতে চাইলে আমরা কি করতে পারি।
চাচা, জনগনের চেয়ে কারো শক্তি বেশী নয়। সে যেই হউক। আমরা আন্দোলন করে মোড়লের এ অপকর্ম রুখে দিতে পারি। এতক্ষন চুপচাপ থাকলেও গ্রামের সবচেয়ে বেশী বয়সী ই¯্রাফিল আলী এবার মুখ খুললেন। বাবা স্বপন তোমার বয়স কম। তুমি জান না ওই মোড়ল কতটা খারাপ মানুষ। সে স্বার্থের জন্য সব পারে। তার কথায় সায় দিল আরো জনাকয়েক।
চাচা আমি জানি। আমি তারে ছোটবেলা থেকে চিনি। তবে চাচা একটা কথা মনে রাখবেন সব অন্যায়ের একটা শেষ আছে। শুধু কথা দেন আপনারা আমার পাশে থাকবেন।
পাশে থাকার কথা শুনে সবাই কেমন চুপ হয়ে গেল। দুই একজন চলে যেতে পা বাড়াল।
আপনারা যাবেন না। আমি কোন অন্যায় দাবি নিয়ে আসিনি। গাছ কাটা মন্দ কাজ। এখানে মুসলমান যেমন আছে তেমনি হিন্দুও আছে। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে মুসলমানরা ইমাম আর হিন্দুরা ঠাকুরের পরামর্শ নিতে পারেন। স্বপনের এ কথা মনে ধরল সবার। সিদ্ধান্ত হল কাল এ বিষয়ে কথা হবে। ধর্ম দিয়ে মানুষকে খুব সহজেই বুঝানো যায়। আর এ সুযোগ সবচেয়ে বেশী নেন রাজনীতিকরা। নিজেকেও রাজনীতি করতে হল বলে মনটা একটু খারাপ হল স্বপনের। তবে পরক্ষনেই মনে হল রাজনীতিকরা ধর্ম নিজ বা দলের স্বার্থে ব্যবহার করে। আর আমি করছি মানুষের মঙ্গলের জন্য।
বাড়ি গিয়ে বাবা মাকে কথাটা বলল স্বপন। মা কিছুটা ভয় পেলেও বাবা সাহস যোগালেন। বললেন, বাবা সৎ কাজে ভয় পেতে নেই। সবাই যদি ক্ষমতাবানদের ভয়ে গুটিয়ে থাকে তো ওরা আরো বেপরোয়া হয়ে যাবে। আর একটা কথা মনে রাখিস। যারা মন্দ কাজ করে বাহির থেকে তাদের সাহসী মনে হলেও আসলে তারা খুব ভীতু। একহাত দেখলে ওরা কিছু মনে করে না। দুই তিন হাত আলাদা দেখলে ওরা বাণিজ্যে মাতে। আর দশ হাত একসাথে দেখলে তারা ভোঁ দৌড় দেয়। বাবার এ কথাটা মনে ধরল স্বপনের।
রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে গাছ কাটা রুখতে নানা পরিকল্পনা করল সে। এরই মধ্যে বিষয়টা ঢাকায় তার ভার্সিটির বন্ধু,পরিচিত সাংবাদিক,পরিবেশকর্মী, মানবাধিকারকর্মী , ব্লগারদের জানিয়েছে সে। তারা সবাই সহযোগীতা করবে বলেছে। ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল স্বপন। শেষ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। এক নারীকন্ঠের ডাকে... স্বপন...... গাছগুলো বাঁচাবি না।
সকালে ঘুম থেকে উঠে আশপাশের কয়েকজন স্কুল শিক্ষার্থীকে বাড়িতে নিয়ে এল স্বপন। তার কথায় ওদের দিতে কোন বাবা মাই আপত্তি করল না। স্বপনের প্রতি ওই বাবা-মাদের সবারই একটা আলাদা টান আছে। স্বপনের আগ্রহেই তাদের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া হচ্ছে। ও যখন বাড়িতে আসে তখন সবার বাড়িতে গিয়ে ওদের পড়াশুনায় সহযোগীতা করে। এ বিষয়টি সে শিখেছে তার হাই স্কুল শিক্ষক রনজিৎ মোদকের কাছ থেকে। সে তাদের বলত, বাবারা শুধু নিজে শিক্ষিত হলেই চলবে না। অন্যদের মাঝেও জ্ঞানের আলো ছড়াতে হবে। ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের দিয়ে কিছু পোস্টার তৈরী করল সে। তাতে গাছ না কাটার নানা শ্লোগান।
দুপুরে জোহর নামাজের পর মসজিদের ইমাম মুফতি ছিদ্দিকুর রহমানকে ঘিরে বসল গ্রামের কয়েকজন মুরুব্বী। সেখানে স্বপনও উপস্থিত ছিল। ইমাম সাহেব সহাস্যে জানতে চাইল, আপনারা মনে হয় কিছু বলবেন। গতকালের গাছ কাটার বিষয়টি বিস্তারিত বলল তারা। সব শুনে ইমাম সাহেব একটি সুরার আয়াত প্রথমে আরবীতে বললেন। পরে বাংলায় বুঝালেন এভাবে- “ তুমি কি দেখ না যে আল্লাহকে সিজদা করে যা কিছু মহাকাশ ও পৃথিবীতে রয়েছে; সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রমন্ডলী, পর্বতরাজি, বৃক্ষলতা, জীব-জন্তু ও মানুষের মধ্যে অনেকে ”। ইমাম সাহেব আরো বললেন, আমাদের প্রিয় নবী ( সা যুদ্ধেও গাছ কাটতে নিষেধ করেছেন। তার কথা শুনে গ্রামের একজন মুরুব্বী বললেন, তবেতো গাছ কাটা ঠিক না।
সন্ধ্যায় বাজারের আইয়ুব আলীর চায়ের দোকানে এ নিয়ে ফের বৈঠক। সেখানে বৃদ্ধ জগদীশ মন্ডল এসে জানাল তাদের ঠাকুরও গাছ না কাটার পক্ষে কথা বলেছে। তিনি বলেছেন, যেখানে গাছ নেই সেখানে মানুষের মধ্যে ভালবাসা কম থাকে। কারণ গাছের ছায়াতলে মানুষ মিলিত হয়। আর তখন নানাভাবে তাদের মনের মত বিনিময় হয়। অবশেষে সিদ্ধান্ত হল কোনভাবেই গ্রামের বড় রাস্তার পাশে গাছগুলো মোড়লকে কাটতে দেয়া যাবে না।
খবরটা এক কান দুই কান হয়ে মোড়লের পর্যন্ত চলে গেছে। চিন্তায় ফেলে দিল ছোকড়া। আমি কইছিলাম কি ব্যাপারটা নেতারে জানানো দরকার। বলল মোড়লের এক সহযোগী।
ঠিক কথা। কালকে সকালেই নেতার বাড়িতে যাব। পরে থানায়ও যাব একবার।
এদিকে গ্রামবাসীকে সাথে পেয়ে আজ একটু আগেভাগেই নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুচ্ছে স্বপন। তবে প্রতিদিনের মত শেষ রাতে সেই নারীকন্ঠের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। স্বপন.............স্বপন........। স্বপনের মনে হচ্ছে তার বিছানার পাশে বসেই যেন ডাকছে তাকে। সে কি মায়াবী কন্ঠ। তবে ঘুম থেকে জাগলেই কাউকে দেখে না সে।
সকালে বাজারের মোড়ে গ্রামবাসীর ডাকে একটি সভা হল। সেখানে গাছ নিয়ে ভাষন দিল স্বপন। তার পুরো বক্তব্যে গাছ ছাড়া অন্য কোন কথা আসেনি। রাজনীতিক হলেও অবশ্য ভিন্ন হত। তারা শোক সভায় গিয়ে ভিন্ন দলের নেতাকে বিদ্রুপ করে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়ে অর্থনীতির কথা বলে আবার অর্থনীতির অনুষ্ঠানে গিয়ে বলে অন্য কথা। যে উদ্দেশ্যে সভা হয় তা নিয়ে বক্তব্য দিতে মন চায় না নেতাদের। তবে সব ধরনের সভায় প্রায় সব বক্তার মধ্যে একটি বিষয়ে মিল পাওয়া যায়। তা হল বড় নেতাকে খুশী করতে তেল মর্দন। সভার সিদ্ধান্ত হল গাছ কাটা বন্ধ করতে সব মহলে দৌড়ঝাপ করতে হবে। পরের দিন সকাল থেকেই কাজ শুরু। প্রয়োজনে ঢাকার পরিবেশবাদীদের সহযোগিতা নেয়া হবে। সেদিন রাতেও স্বপনের ভাল ঘুম হল। শুধু শেষ রাতে সেই ডাক পেলেও চোখে বেশী ঘুম থাকায় অন্যদিনের মত বিছানায় উঠে বসল না সে। সকালে ভিন্ন কন্ঠের ডাকে ঘুম ভাঙ্গল তার।
স্বপন বাড়ি আছে নাকি।
কার গলা। ভাবছে সে। এতো বাবার গলা নয়। পরিচিত কারোও নয়। তবে কার। আবারো হাকডাক। এবার রাগাম্বিত সুরে। এই ব্যাটা ডাকছি গায়ে লাগছে না। বেরিয়ে আয় নয়তো ঘর থেকে ধরে আনব। নেতা হইছ। নেতাগিরি ছুটাব।
গেঞ্জি গায়েই ঘর থেকে বের হল সে। উঠানে দাঁড়ানো কয়েকজন পুলিশ সদস্য। পুলিশদের এমন ব্যবহারের কথা স্বপন আগেও শুনেছে। তবে এই প্রথম সে নিজ কানে শুনল। এমনিতে টক শো, সভা সেমিনারে পুলিশকে জনগনের বন্ধু ও সেবক বললেও বাস্তবের রুপ ভিন্ন। সাধারন জনগনকে পুলিশ মানুষই মনে করে না। তাদের কাছে মানুষ মানে বড় নেতা কিংবা বড় ব্যবসায়ী। স্বপনকে ধরে নিয়ে গেল পুলিশ। যদিও কোন প্রকার গ্রেফতারী পরোওয়ানা ছিল না তাদের কাছে। খবরটা সারা গ্রামবাসী জেনে গেছে। তারা এক এক করে থানার সামনে জড়ো হয়েছে। প্রথমে ছোট জটলা পরে তা ধীরে ধীরে রুপ নেয় বিরাট আকারে। টেলিভিশনের মফস্বল সাংবাদিকদের বদৌলতে খবরটা পৌছে যায় ঢাকায়ও। দুপুরের মধ্যে মাওয়া হয়ে স্বপনদের গ্রামে এসে পৌছে কয়েকজন নামী পরিবেশবাদী সাথে স্বপনের বন্ধু বান্ধব। তারা থানায় গিয়ে ওসি সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করলেও তাতে তেমন পাত্তা দেননি পুলিশের বড় কর্তা। শুধু জানালেন বিষয়টা উপর মহল জানে। পুলিশের বৈরী আচরনের প্রতিবাদে দেশখ্যাত পরিবেশবাদীরা গ্রামবাসীদের নিয়ে থানার সামনে অনশনে বসে। আর এ খবর প্রচার করতে ঢাকা থেকেও সাংবাদিকরা ছুটে আসে। এরই মধ্যে কয়েকবার পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে চাইলে ব্যর্থ হয়। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পাল্টে যায়। গাছ কাটার কথা শুনে ছুটে আসেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা। সন্ধ্যার কিছু পর পুলিশের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা থানায় এসে অনশনকারীদের সাথে কথা বলে বিস্তারিত অবগত হন। এরপর তিনি থানার ভিতরে গিয়ে যান।
এর কিছুক্ষন পর স্বপন থানা ফটক থেকে বেরিয়ে আসে। গ্রামবাসীর মধ্যে আনন্দ উপচে পড়ে। তাদের মধ্যে দুইজন স্বপনকে কাধে তুলে নাচতে শুরু করে। কোন কোন টেলিভিশন তা সরাসরি প্রচার করছে। বিষয়টি সরকারের উপর মহল জেনে যায়। সেই সাথে নির্দেশ দেয়া হয় কোনমতেই ওই গাছগুলো কাটা যাবে না। সংবাদে আরো বেড়িয়ে আসে ওই জায়গার মালিক মোড়ল নন। জায়গাটি ছিল সুধীর চন্দ্র সেনের। দেশ স্বাধীনের পর তা কিভাবে যেন মোড়লের হয়ে যায়। বিষয়টি খুব ফলো করে প্রচার হয় মিডিয়াতে। বেরিয়ে আসে আরো অনেক কিছু। গ্রেফতার হয় মোড়ল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সুধীর চন্দ্র সেনের পুরো পরিবারকে পাকিস্তানীদের হাতে ধরিয়ে দেয় মোড়ল। পরে তাদেরকে হত্যা করা হয়। ওই হিন্দু পরিবারের একমাত্র কণ্যা কিশোরী রুনুও রেহাই পায়নি ওই সময়। দেশ স্বাধীনের পর কিছু দিন পালিয়ে থাকলেও পরে গ্রামে এসে রাজত্ব ফলায় মোড়ল। সেই সময় দখল করে রুনুদের বাড়িটি। স্বপনের মনে আছে রুনুদি ছিল মোড়লের মেয়ে আসমার বান্ধবী। দুই বান্ধবী মিলে সারা গ্রাম ছুটে বেড়াত। এ গাছ থেকে ও গাছ, এ পুকুর থেকে ও পুকুর ছিল তাদের অবাধ যাতায়াত। বেনী দুলিয়ে ধান ক্ষেতের আইল দিয়ে তারা যখন ছুটত মনে হত এক মায়ের পেটেরই সন্তান। রুনুদি হিন্দু হলেও মুসলমানদের বাড়িতেই তার সারা বেলা কাটত। স্বপনকে সে ছোট ভাইয়ের মত আদর করত। পুজোর সময় রুনুর বাবাকে তিনটা পোশাক কিনতে হত। একটা তার, আরেকটা আসমার অপরটি স্বপনের জন্য। স্বপনকে প্রথম বই পড়া শিখিয়েছেও রুনুদি। স্বপন প্রায় সময়ই রুনুদির সাথে ঘুমাত।
চারদিকে যুদ্ধের দামামা বাঁধলেও এ গ্রামে তখন তার আঁচ লাগেনি। তবে দুই একজন পাকিস্তানীদের হয়ে কাজ করছে বলে শোনা যেত। ওর মনে আছে সে রাতেও রুনুদির পাশে ও ঘুমিয়ে ছিল। গভীর রাতে হঠাৎ হৈ চৈ শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায় ওর। জেগেই দেখে রুনুদিকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে মোড়ল আর দুই জন গোফঅলা সেনা। রুনুদি কাঁদছে। বলছে আমাকে ছেড়ে দাও। কিন্তু তারা কিছুতেই তাকে ছাড়ছে না। দরজা পার হওয়ার আগ পর্যন্ত রুনুদি একই কথা বলছিল বার বার। একবার স্বপনের দিকে তাকিয়েও ছিল সে। সেদিন চাহনীটা ছিল কেমন জানি করুন। রুনুদিকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে স্বপনের দিকে তাকিয়ে একবার ধমক মারে মোড়ল। এই ছ্যামড়া, মুসলমান ছেলে হয়ে হিন্দু বাড়ি কি করিস। যা বাড়ি যা। মুসলমান হিন্দুত্ব বুঝার মত স্বপনের তখন বয়স হয়নি। তবে রুনুদিদের বাড়িতে এলে সে দেখত, তার মা কপালে সিঁদুর দিত। আর স্বপনের মায়ের কপালে তা ছিল না।
রুনুদি স্বপনকে প্রায়ই বলত, জানিস সপু আমার বিয়ে হলে আমিও মায়ের মত কপালে সিঁদুর দিব। আর টুকটুকে লাল শাড়ি পরব। খোপায় থাকবে শিউলী ফুলের মালা।
তোমার বিয়ে হলে তুমিতো এ গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে তাই না রুনুদি।
যদি অন্য গ্রামে হয় তো যেতেতো হবেই।
তখন আমি কার সাথে খেলব।
দূর বোকা আমার যখন বিয়ে হবে তখন তুই অনেক বড় হয়ে যাবি।
আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না রুনুদি। বলেই হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করল স্বপন। রুনুদি ওকে কাছে টেনে নিয়ে মাথার চুলগুলোতে বিলি কাটতে লাগল। এই বোকা ছেলে কান্না থামা। আমার কি এখনই বিয়ে হচ্ছে।
না না তুমি বল তুমি কখনোই বিয়ে করবে না।
হা হা হা। গালে টোল ফেলে হাসির রিনিঝিনি আওয়াজ তুলল রুনুদি। বলল, তুই কি আমাকে আই বুড়ো হয়ে থাকতে বলিস।
আইবুড়ো কি রুনু দি।
আচ্ছা তোর এসব শুনে কাজ নেই। চল এবার বাড়ি চল। জানিস আমার কেমন জানি ভয় ভয় করছে রে।
কেন রুনুদি।
দেশে মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে। পাকিস্তানী সেনারা বাঙ্গালীদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মানুষ মারছে।
এসময় রুনুদিকে কেমন জানি অন্যরকম লাগছিল। তবে তার এসব ভারী ভারী কথার অর্থ বুঝতে পারেনি স্বপন।
স্বপনের রুম থেকে কান্নার আওয়াজ শুনে তার মা ছুটে আসে। বাবা কান্দিছ কেন। ছেলের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মায়ের পরশ পেয়ে স্বপনের কান্না আরো বেড়ে যায়।
কি হয়েছে বাবা।
জানো মা, আজ আমার রুনুদির কথা মনে পড়ছে। স্বপনের মায়ের চোখেও জল এসে যায়। তারও মনে পড়ে দুই বেনী দুলিয়ে পাড়াময় ছুটাছুটি করা এক কিশোরীর কথা।
সেদিন মোড়ল আমার চোখের সামনেই রনুদিকে ধরে নিয়ে যায়। আর অন্য ঘরে থাকা তার বাবা মাকে হত্যা করে। মা আমি যখন শুনি রুনুদির লাশ ওই নদীর কিনারে ভাসছে তখন আমি দেখতে যাইনি। গ্রামের সবাই গেলেও আমার কেন জানি খুব ভয় করছিল মা। আবারো হাউ মাউ কেঁদে উঠে স্বপন। এবার মায়ের কোলে মাথা রেখে।
আজ রাতে সেই ডাকে ঘুম ভাঙ্গে স্বপনের। তবে অন্যদিনের মত করুণ কন্ঠ নয়। আজ সেই পরিচিত রিনিঝিনি হাসি। স্বপন ............ স্বপন.......... রুনুদি তুমি কোথায় ?
আমিতো তোর পাশেই। বোকা তুই আমাকে দেখতে পারছিস না। আবারো হাসি। রুনুদিকে আজ যেন দেখতে পাচ্ছে স্বপন।
তার পরনে ধবধবে সাদা শাড়ি। কিন্তু রুনুদিতো বলেছিল লাল শাড়ি তার পছন্দ।
রুনুদি তুমি না লাল শাড়ি পছন্দ কর। সাদা শাড়ি পড়েছ কেন। আর মাথায় সিঁদুর কই।
বোকা। তোর চোখে কি ছানি পড়েছে। তুই দেখতে পারছিস না শাড়ির মাঝে কি টুকুটুকে লাল রঙ। এখান থেকে একটু রঙ নিয়ে সিঁদুর বানাব না হয়।
রুনু দি এতো রঙ নয় এতো লাল রক্ত।
রক্ত ! অনেকক্ষন চুপ করে থাকল রুনুদি।
এতো রঙই ছিল স্বপন। মোড়লের মতো কিছু মানুষরুপী হায়েনা সুন্দর রঙকে রক্তে পরিণত করেছে যে। ওদের তোরা ক্ষমা করিস না ভাই আমার। ওদের ক্ষমা করিস না।
রুনুদি.........। ঘুম ভেঙ্গে গেল স্বপনের। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল সবে মাত্র ভোর হয়েছে। আকাশটা আজ পরিস্কার মনে হচ্ছে । হঠাৎ নজরে পরল উঠোনের এক কোণে একটা শিউলী ফুল পরে আছে।
-আনোয়ার হাসান - ০১৯৩ ৭৪০ ১৮১৯
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।
এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।
ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন
মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?
আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস
রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------
ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন
জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।
জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন