১৯৭১ সালের ডিসেম্বর। মুক্তিযুদ্ধ প্রায় সমাপ্তির পথে। সারা দেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অবস্থান ছেড়ে পিছু হটছে।
মেজর গিয়াসের নেতৃত্বে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর মুক্ত করার পরিকল্পনা হয়েছে। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের দল সোনামসজিদ-শিবগঞ্জ পথে এসে শহর আক্রমণ করবে। লেফটেন্যান্ট রফিকের দল রহনপুর-আমনুরা হয়ে শহর আক্রমণ করবে আর মেজর গিয়াস চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী রাস্তায় অবস্থান নিয়ে হানাদার বাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবেন। ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী মুক্তিবাহিনীকে গোলন্দাজ সহায়তা দেবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের অবস্থান মহানন্দা নদীর তীরে। হানাদার বাহিনী নদীর উঁচু পাড় ধরে সংযোগ মরিচাসহ অনেক শক্ত বাংকার তৈরি করেছে।
১০ ডিসেম্বর প্রায় দুই কোম্পানি মুক্তিবাহিনীসহ ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর সোনামসজিদ সীমান্ত অতিক্রম করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের দিকে রওনা দেন। সন্ধ্যার মধ্যে কানসাট হয়ে শিবগঞ্জ পর্যন্ত এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। ১১ তারিখ সকালে আবার যাত্রা শুরু। দুপুরের মধ্যে জাহাঙ্গীর তাঁর দল নিয়ে মহানন্দা নদীর উত্তর-পশ্চিম দিকে বারঘরিয়ায় পৌঁছান। কিছুক্ষণের মধ্যে লে. কাইউম ও লে. আউয়ালও তাঁদের দল নিয়ে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের সঙ্গে যোগ দেন। এখন অপেক্ষা প্রতিশ্রুত ভারতীয় সহায়তার জন্য। ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতীয় সহায়তা না পাওয়ায় জাহাঙ্গীর এই সহায়তা ছাড়াই শহর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন।
১৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন অবস্থান থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। সাঁড়াশি আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি বাহিনী অবস্থান ছেড়ে সরে পড়তে থাকে। সন্ধ্যায় জাহাঙ্গীর তাঁর দলকে নিয়ে কয়েক ভাগে শহরে ঢুকে পড়েন। নিজে আকন্দবারিয়া ঘাট দিয়ে নদী পার হয়ে টিকারামপুর এলাকায় পৌঁছান। রাতের খাবার খাওয়ার পর শহর দখলের পরিকল্পনা প্লাটুন ও সেকশন কমান্ডারদের বুঝিয়ে দেন।
১৪ ডিসেম্বর সকাল আটটায় জাহাঙ্গীর তাঁর দল নিয়ে টিকারামপুর থেকে নদীর পাড় ঘেঁষে রেহাইচরের দিকে অগ্রসর হন। উদ্দেশ্য, রেহাইচর নিষ্ক্রিয় করে শহরের আরও ভেতরে ঢোকা। শাহজাহান আর তুরফানের দল জাহাঙ্গীরকে কাভারিং ফায়ার দেবে। সকালে জাহাঙ্গীর ওয়্যারলেস অপারেটর নওশেরকে শত্রুর খবর নিতে পাঠান। নওশের ফিরে এসে জানান, শত্রু ২০০-৩০০ গজ পর পর পশ্চিমমুখী কয়েকটি বাংকারে অবস্থান নিয়ে আছে।
জাহাঙ্গীর বুঝতে পারলেন, এসব বাংকার আর সঙ্গের মরিচাগুলো দখলে নেওয়া সহজ হবে না। তবু তা করতেই হবে। তিনি সৈনিকদের কথা দিয়েছেন, আজ বিকেলের চা তাঁরা শহরে বসে পান করবেন। শত্রুকে ধোঁকা দিতে তিনি দক্ষিণ দিক দিয়ে অগ্রসর হয়ে ১০টির মতো বাংকার দখল করলেন। এর পর এগিয়ে যান বাকি বাংকারগুলো দখলের জন্য। একপর্যায়ে সিঅ্যান্ডবি ঘাটের কাছে রাস্তার পাশের একটি বাড়ি থেকে একটি গুলি এসে তাঁর কপালে লাগে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও জাহাঙ্গীরের সহচর রবিউল ইসলাম লিখেছেন, ‘৫নং বাংকারের ওপর দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর কমান্ড করছেন। তাঁর বাঁ পাশে আমি, ডান পাশ থেকে ১৫-১৬ বছরের এক মুক্তিযোদ্ধা সামনের দালানঘরের দিকে পলায়নরত পাকিস্তানি এক সেনাকে দেখিয়ে বলল, স্যার, পালিয়ে যাচ্ছে। জাহাঙ্গীর “ধর ওকে” বলে সামনে দৌড় দিলেন। একই সময় পেছন থেকে একজন বলল, নিচে শত্রু। আমি পেছনে লাফ দিয়ে দেখি, দুজন পাকিস্তানি সেনা দুটি এলএমজি নিয়ে ক্যানেলের নিচে দুই মুখে পজিশন নিয়ে আছে। আমরা দুজন ওপর থেকে শত্রুকে গুলি করা আরম্ভ করলাম।...আমরা যখন শত্রুকে গুলি করায় ব্যস্ত, তখন অসীম সাহসী, দেশমাতৃকার নিবেদিত সন্তান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তির নায়ক এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ছুটে চলেছেন শত্রুকে জীবন্ত ধরার জন্য। তারা ধেয়ে আসা ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরকে জানালা দিয়ে খুব কাছ থেকে গুলি করল। কপালের নিচে গুলি লেগে এপার-ওপার হয়ে গেল।’
ঘটনাস্থলেই শহীদ হন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। নেতার মৃত্যুতে যুদ্ধ-পরিস্থিতি পাল্টে যায়। মুক্তিবাহিনী পিছিয়ে আসে। জাহাঙ্গীরের লাশ উদ্ধার করাও সম্ভব হয় না। তাঁর মৃত্যুসংবাদ মুক্তিবাহিনীতে বারুদে বিস্ফোরণ ঘটাল। মেজর গিয়াস, লে. রফিক, লে. কাইউম একযোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আক্রমণ করলেন।
১৫ ডিসেম্বর মুক্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জ নতুন এক সূর্য দেখল। সকাল ১০টার মধ্যে জাহাঙ্গীরের লাশ উদ্ধার হলো। বিকেলে সোনামসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁর মরদেহ সমাহিত করা হলো। জাহাঙ্গীর প্রায়ই তাঁর সৈনিকদের বলতেন, ‘স্বাধীনতাযুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করে, তাদের মধ্যে খুব কম লোকই বাঁচে।’
জাতি মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে সম্মানিত করল ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে।