শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি
আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ
সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন।
সঁপিয়া তোমার 'পরে নূতন মহিমা
অমর করিছে শিল্পী তোমার প্রতিমা।
কত বর্ণ কত গন্ধ ভূষণ কত-না,
সিন্ধু হতে মুক্তা আসে খনি হতে সোনা,
বসন্তের বন হতে আসে পুষ্পভার,
চরণ রাঙাতে কীট দেয় প্রাণ তার।
লজ্জা দিয়ে, সজ্জা দিয়ে, দিয়ে আবরণ,
তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন।
পড়েছে তোমার 'পরে প্রদীপ্ত বাসনা
অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা।
নারী বিষয়ে বাংলা কবিতার ভিত্তি তৈরি হয়েছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় এবং আজও আমাদের মনন সেখানেই আটকে আছে। তাঁর কবিতায় নারী এসেছে সৌন্দর্য, নির্ভরশীলতা, সহনশীলতা ও আনুগত্যের প্রতিমূর্তি হিসেবে। নারীর অবয়ব নির্মাণ হয় পুরুষালি অবয়বের বিপরীতে। আজও অধিকাংশ পুরুষের মনে ঢেউ তোলে নারীর ললিত লোভন লীলা;
আঙিনাতে যে আছে অপেক্ষা করে
তার পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্ত্রী মৃণালিনীর মধ্যে স্বপ্নের প্রেমিকাকে খুঁজে না পাওয়ার বেদনা ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর কবিতায়। প্রেমের স্বরূপ নিয়ে বিশেষ ভাবে চিন্তাভাবনা করেন তিনি। চিত্রাঙ্গদায় প্রকাশ হয় কবি মনের নারীর মধুর ও শক্তিশালী রূপের দোলাচলের অপূর্ব চিহ্ন। সেই সময় থেকেই নারীর খরতর ও ললিত দুই রূপের দোলাচল প্রকাশ পেতে থাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায়, যার সবচেয়ে স্পষ্ট প্রকাশ চিত্রাঙ্গদার কুরূপা ও সুরূপার মধ্যে, তথাকথিত পুরুষালি আর নারীর দ্বন্দ্বে;
পুরুষের বিদ্যা করেছিনু শিক্ষা
লভি নাই মনোহরণের দীক্ষা
খরতর স্বয়ংসিদ্ধা কুরূপা তখন মোহের বশে রূপ ভিক্ষা করে মদনের কাছে, নারী হতে চায় অর্জুনের মন জয়ের আশায়;
শুধু এক বরষের জন্যে
পুষ্পলাবণ্যে
মোর দেহ পাক তবে স্বর্গের মূল্য
মর্ত্যে অতুল্য।
আবার কিছু দিনের মধ্যে মোহভঙ্গ হয় তার, সে ফিরে চায় তার আত্মপরিচয়, কুরূপার অহঙ্কার, ধিক্কার দেয় মিথ্যা দেহ পরিচয়কে;
এই ছদ্মরূপিণীর চেয়ে
শ্রেষ্ঠ আমি শতগুণে।
সেই আপনারে করিব প্রকাশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জানতেন, পুরুষের জন্য শ্রুতি সুমধুর নয় স্বয়ংসিদ্ধা নারীর কাহিনী, তবু চিত্রাঙ্গদার মুখে তিনি নারীর আত্মচেতনার গৌরব বাক্য দিয়েছেন;
আমি চিত্রাঙ্গদা।
দেবী নহি, নহি আমি সামান্যা রমণী।
পূজা করি রাখিবে মাথায়, সেও আমি নই;
অবহেলা করি পুষিয়া রাখিবে
পিছে সেও আমি নহি। যদি পার্শ্বে রাখো
মোরে সংকটের পথে, দুরূহ চিন্তার
যদি অংশ দাও, যদি অনুমতি কর
কঠিন ব্রতের তব সহায় হইতে,
যদি সুখে দুঃখে মোরে কর সহচরী
আমার পাইবে তবে পরিচয়।
কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় শুধু নারী বা মাতৃভক্তির বর্ণনা দিয়েই সম্পন্ন করেননি বরং কালের অভিরুচি শিল্পী সত্তাকে বরাবরই বিকশিত করেন প্রকৃতির নির্যাসে। মাতৃসমা কিছু নারীর অপরিসীম প্রভাব, তাদের স্নেহ, অপত্য শাসন আর বুকে আগলে রাখার মাতৃত্ব বোধই কবিকে পথের নির্দেশ দিয়েছে;
তোমার মমতা-মানিক আলোকে চিনিনু তোমারে মাতা তুমি লাঞ্চিতা বিশ্ব-জননী!
তোমার আচল পাতা নিখিল দুঃখী নিপীড়িত তবে,
বিষ শুধু তোমা দহে যথা তব মাগো পীড়িত নিখিল ধরনীর ভার বহে।
মাতৃভক্তির ক্ষেত্রে যেমন কবি আকুল হয়ে ওঠেন, তেমনি প্রেয়সীকে কাছে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। প্রিয়তমা প্রেয়সীর জন্য হৃদয় তাঁর হাহাকার করে উঠলেও এ সম্পর্কে বিরূপ অনুভূতি ও মনকে তাড়িত করে;
বারে বারে মোর জীবন প্রদীপ নিভিয়া গিয়াছে প্রিয়া
আমি মরিয়াছি, মরেনি নয়ন, দেখ প্রিয়তমা চাহি।
কবির ভিতরের যে মানব সত্ত্বা তা কারো জন্য অপেক্ষ্যমান। মনের সে আকুতি গভীর ভাব রসে প্রকাশ করেছেন কবিতায়। অপেক্ষামান প্রিয়ার জন্য কবির ব্যাকুলতা;
প্রিয়া রূপ ধরে এতদিনে এলে আমার কবিতা তুমি,
আখির পলকে মরুভূমি যেন হয়ে গেল বনভূমি।
কিংবা;
ফুল কেন এত ভালো লাগে তব, কারণ জান কি তার!
ওরা যে আমার কোটি জনমের ছিন্ন অশ্র হার!
কল্পনা বিলাসী কবি নারীর চুলের সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে মনের গোপন ইচ্ছা কাব্যিক ভাব রসে প্রকাশ করেছেন;
সেই এলোকেশে বক্ষে জড়ায়ে গোপনে যেতাম চুমি!
তোমার কেশের সুরভি লইয়া দিয়াছি ফুলের বুকে
আঁচল ছুইয়া মূর্ছিত হয়ে পড়েছি পরম সুখে!
নারী পুরুষ নির্বিশেষে সমান অধিকারই সাম্যবাদী দর্শনের মূল চেতনা;
আমার চোখে পুরুষ-রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
নারীর প্রতি যে অন্যায় করা হচ্ছে, নারীকে অবমাননা করছে এর জন্য শাস্তি পেতে হবে। যে কথা পুরুষ শাসিত সমাজকে বুঝিয়ে দিয়েছেন কবি নারীর মর্যাদার কথা বলে;
নর যদি রাখে নারীরে বন্ধী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে
যুগের ধর্ম এই
সমাজের সর্বস্তরের নারী যে সন্মানীর তা কবিতায় প্রকাশ করেছেন। সমাজের নারীদেরকে আলোর পথ দেখিয়েছেন;
কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা
কে দেয় থুথু-ও-গায়?
হয়ত তোমার স্তন্য দিয়াছে-সীতা সম সতী মায়
নাই হলে সতী তবুও তোমরা মাতা-ভগিনীরই জাতি,
স্বর্গ বেশ্যা ঘৃতচী পুত্র হল মহাবীর দ্রোণ
কুমারীর ছেলে বিশ্ব পূজ্য কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন
অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ সন্তান হয়
অসৎ পিতার সন্তান ও তবে জারজ সুনিশ্চয়।
কাজী নজরুল ইসলাম নারীকে মঙ্গলকামী কল্যাণীয়া হিসেবেই বিবেচনা করেছেন;
পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ
কামিনী এনেছে যামিনী-শান্তি, সমীরণ, বারিবাহ।
দিবসে দিয়াছে শক্তি-মাংস, নিশীথে হয়েছে বধু,
পুরুষ এসেছে মরুতৃষা লয়ে নারী যোগায়েছে মধু।
কাজী নজরুল ইসলাম স্রষ্টাকে ব্যবহার করেছেন প্রেমিক রূপে। প্রেমিক স্রষ্টা আদরের নারীকে স্বম্বোদন করেছেন ’প্রিয়া’। কবি তাঁর নিজের ভিতরের কাব্যিক সৌন্দর্য শৈল্পিক রসে প্রকাশ করেছেন এভাবেই;
স্রষ্টা হইল প্রিয়-সুন্দর সৃষ্টিরে প্রিয়া বলি
কল্পতরুতে ফুটিল প্রথম নারী আনন্দকলি!
নিজ ফুলশরে যেদিন পুরুষে বিধিল আপন হিয়া
ফুটিল সেদিন শূন্য আকাশে আদিবাণী- ”প্রিয়া, প্রিয়া”
কবি জীবনানন্দ দাশ যাপিত জীবনে চলার পথে মোহাচ্ছন্নতা আর বিভ্রান্তির কথা লিখেছেন ঐতিহ্যের নিবিড় পতনের শব্দ মাধুর্যে। হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার গভীর অন্ধকার বিদিশা তার বস্তু পরিচয় ঝেড়ে ফেলে নারীর কোমলকান্তির মোড়ক পরিধান করে নেয় আর প্রিয়তমার চুলের কালোর অতলতার বিভ্রমে আটকে যায় তাঁর চেতনা। প্রেম কাতর পাগল হৃদয়ের জন্য কবি নির্মাণ করেন ভালোবাসা আর আশ্বাসের বিরাট ভূমি;
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ‘পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
প্রেমিক কবির কাছে প্রেম ছিলো জীবনেরই নামান্তর ও রূপান্তর। তিনি বিশ্বাস করতেন সময়ের অন্ধকার দূর করতে পারে কেবল প্রেমিকার স্বরূপ। জীবনানন্দ দাশ তাঁর প্রেমিকাদের সবচেয়ে শরীরী কিংবা অশরীরী করে তুলেছিলেন বিভিন্ন নাম ধরে ডেকে ডেকে; বনলতা সেন, অরুণিমা সান্যাল, সুদর্শনা, সুরঞ্জনা প্রভৃতি নামে। জন্ম জন্মান্তরে যার সাথে পথ চলা যায়, এমন এক স্বপ্ন মানবীর রূপ তিনি বারবার ভেবেছেন; হয়তো পৃথিবীর আলো বাতাসে খুঁজেছেনও তাকে। অদেখা কোনো এক বনলতাকে নিয়ে কবির অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে তাঁর কবিতায়;
আমরা মৃত্যুর থেকে জেগে উঠে দেখি
চারিদিকে ছায়া ভরা ভিড়
কুলোর বাতাসে উড়ে খুদের মতন
পেয়ে যায়-- পেয়ে যায়-- অণুপরমাণুর শরীর।
একটি কি দুটো মুখ-- তাদের ভিতরে
যদিও দেখিনি আমি কোনো দিন-- তবুও বাতাসে
প্রথম জানকীর মতো হয়ে ক্রমে
অবশেষে বনলতা সেন হয়ে আসে।
ক্লান্তিহীন পথ চলার আর অন্তহীন আনন্দের সাথী হিসেবে যে মানুষকে পাওয়া যায় বা মনে মনে ভাবা যায়, সে নারীর মোহময়তা যেন এই নিবিড় প্রেমলগ্ন কবির জীবনে বারবার বনলতার মুখ হয়ে ভেসে ওঠে। অন্য একটি কবিতায় জীবনানন্দ দাশ বনলতাকে তুলে ধরছেন এভাবে;
বনলতা সেন, তুমি যখন নদীর ঘাটে স্নান করে ফিরে এলে
মাথার উপরে জ্বলন্ত সূর্য তোমার,
অসংখ্য চিল, বেগুনের ফুলের মতো রঙিন আকাশের পর আকাশ
তখন থেকেই বুঝেছি আমরা মরি না কোনো দিন
কোনো প্রেম কোনো স্বপ্ন কোনো দিন মৃত হয় না
আমরা পথ থেকে পথ চলি শুধু-- ধূসর বছর থেকে ধূসর বছরে--
আমরা পাশাপাশি হাঁটতে থাকি শুধু, মুখোমুখি দাঁড়াই:
তুমি আর আমি।
কখনো বা বেবিলনের সিংহের মূর্তির কাছে
কখনো বা পিরামিডের নিস্তব্ধতায়
কাঁখে তোমার মাদকতাময় মিসরীয় কলসি
নীল জলের গহন রহস্যে ভয়াবহ
জীবনানন্দ দাশের বনলতাকে দেখি গভীর রাতের অনুপস্থিতি উপস্থিতির দোলাচলের রঙিন মোড়কে;
শেষ হ’ল জীবনের সব লেনদেন
বনলতা সেন।
কোথায় গিয়েছ তুমি আজ এই বেলা
মাছরাঙা ভোলেনি তো দুপুরের খেলা
শালিখ করে না তার নীড় অবহেলা
উচ্ছ্বাসে নদীর ঢেউ হয়েছে সফেন,
তুমি নাই বনলতা সেন।
তোমার মতন কেউ ছিল না কোথাও?
কেন যে সবের আগে তুমি চলে যাও।
কেন যে সবের আগে তুমি
পৃথিবীকে করে গেলে শূন্য মরুভূমি
(কেন যে সবার আগে তুমি)
ছিঁড়ে গেলে কুহকের ঝিলমিল টানা ও পোড়েন,
কবেকার বনলতা সেন।
কত যে আসবে সন্ধ্যা প্রান্তরে আকাশে,
কত যে ঘুমিয়ে রবো বস্তির পাশে,
কত যে চমকে জেগে উঠব বাতাসে,
হিজল জামের বনে থেমেছে স্টেশনে বুঝি রাত্রির ট্রেন,
নিশুতির বনলতা সেন।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সভ্যতার বিবরণে ভেসে ওঠে বনলতার মুখ, তার ছবি;
হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো:
চারিদিকে চিরদিন রাত্রির নিধান;
বালির উপরে জ্যোৎস্না দেবদারু ছায়া ইতস্তত
বিচূর্ণ থামের মতো: দাঁড়কাক;-- দাঁড়ায়ে রয়েছে মৃত, ম্লান।
শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের-- ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন;
“মনে আছে?” শুধাল সে-- শুধালাম আমি শুধু “বনলতা সেন?”
অসহায়তার আড়ালে কবিতায় নির্মিত হয়েছে আশ্বাস বার্তা, আশ্রয় ইঙ্গিত আর সবশেষে নিথর পৃথিবীর ভয়াবহ নির্জনতা;
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে-- সব নদী-- ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৫ রাত ১১:৪৫