বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র ‘বঙ্গভূমি’র দাবিদার দু’টি গোষ্ঠী গত ২৫ মার্চ ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’ গঠনের দাবিতে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী শহর বনগাঁ ও উত্তর ২৪ পরগণার ঠাকুরনগরে আলাদা দু’টি সমাবেশের আয়োজন করে। তাদের বঙ্গসেনা নামক সশস্ত্র বাহিনীর মার্চ অবশ্য সরাসরি বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। তার আগেই বনগাঁ ও ঠাকুরনগরে পুলিশ তাদের গতিরোধ করে।
উল্লেখ্য, ১৯৮২ সালের ২৫ মার্চ প্রস্তাবিত বঙ্গভূমির ‘প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি’ পার্থ সামন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র ‘বঙ্গভূমি’ প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়ে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ জারি করেন। তারই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ২৫ মার্চ বঙ্গসেনাদের এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। দু’টি স্বতন্ত্র সংগঠনের একই ধরনের অনুষ্ঠানের কারণ হচ্ছে, শিশিরকুমার সরকার ও পঞ্চানন বিশ্বাসের নেতৃত্বে বঙ্গসেনার একটি গোষ্ঠী কালিদাস বৈদ্যের নেতৃত্বের প্রতি অনাস্খা জানিয়ে একই লক্ষ্যে সংগঠনের আলাদা শাখা গঠন করে। এই শিশিরকুমার সরকার ও পঞ্চানন বিশ্বাস এখন ভারতে বঙ্গভূমির এক ‘প্রবাসী সরকার’ গঠন করেছেন। শিশির ও পঞ্চানন এই ‘সরকারে’র রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী।
তবে পার্থ সামন্তের নেতৃত্বাধীন বঙ্গভূমি রাষ্ট্রের সেনাপ্রধান কালিদাস বৈদ্যকে শিশির আর গুরুত্ব দিতে নারাজ। তিনি অবশ্য বঙ্গভূমির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি পার্থ সামন্তের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। শিশির এই প্রতিবেদককে জানান, তারা পার্থ সামন্তকে বঙ্গভূমির ‘জাতির পিতা’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
কে এই পার্থ সামন্ত তা নিয়ে অবশ্য রহস্য রয়েছে। পার্থ সামন্ত কখনোই জনসমক্ষে আসেননি। অনেকেই মনে করতেন, বাংলাদেশের সাবেক আওয়ামী লীগ এমপি চিত্তরঞ্জন সুতারই পার্থ সামন্ত নাম নিয়ে বঙ্গভূমি প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এ প্রসঙ্গে শিশিরকুমার সরকার দাবি করেন, চিত্তরঞ্জন সুতার পার্থ সামন্ত নন। তাহলে কে তিনি? তার আসল নাম প্রকাশে শিশিরকুমার সরকার রাজি হননি।
২৫ মার্চ বনগাঁতে বঙ্গসেনাদের সমাবেশে বক্তব্য রাখেন শিশিরকুমার সরকার ও পঞ্চানন বিশ্বাস। এই সমাবেশে ‘বঙ্গভূমি প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করার’ ঘোষণা দেয়া হয়। এই সমাবেশে ‘রাষ্ট্রপতি’ শিশিরকুমার সরকার, ‘প্রধানমন্ত্রী’ পঞ্চানন বিশ্বাস ও ‘উপরাষ্ট্রপতি’ নির্মল মজুমদার উপস্খিত ছিলেন। পরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তারা জানান, তারা ‘বঙ্গভূমির দখল চান’। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছে, ‘মাতৃভূমি ফিরে পেতে বঙ্গসেনারা সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত।’ প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘এই যুদ্ধে সমস্ত দায়িত্ব বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের। বঙ্গভূমির মাটিতে রক্তের গঙ্গা বয়ে গেলেও তার দায়িত্ব বর্তাবে বাংলাদেশের সরকারের ওপর।’ প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ‘বঙ্গভূমির রাষ্ট্রপতি’ শিশিরকুমার সরকার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্খানকারী বঙ্গসেনাদের নির্দেশ দিয়েছেন, তারা যেন ‘বাংলাদেশের পতাকা ফেলে বঙ্গভূমির পতাকা উত্তোলন করেন।’ রাষ্ট্রপতি শিশিরকুমার সরকার এই হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেছেন, ‘বঙ্গভূমির সব সীমান্ত দিয়ে আমরা একযোগে আক্রমণ করব।’
পরে শিশিরকুমার সরকার এই প্রতিবেদককে বলেন, বর্তমানে তাদের সশস্ত্র বাহিনী বঙ্গসেনার ক্যাডাররা বিভিন্ন জেলায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এ ছাড়া আগামী ২২ জুলাই তারা বনগাঁয় আরো একটি বড় সমাবেশ করবেন। শিশিরকুমার সরকার বলেন, যেকোনো উপায়ে তারা বঙ্গভূমি প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। তবে এখনো তিনি চান, সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে শান্তিপূর্ণভাবে বাংলাদেশ সরকার যেন বঙ্গভূমি রাষ্ট্র মেনে নেয়। তা না হলে বাংলাদেশে এক ভয়াবহ রক্তপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, বঙ্গভূমি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে অবস্খিত হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান এবং ভারতে অবস্খিত শরণার্থীদের সমস্যার স্খায়ী সমাধান হতে পারে।
শিশিরকুমার সরকার হিন্দুদের এই অবস্খার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে চলে আসা বাংলাদেশী হিন্দুদের সে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো ব্যবস্খাই করেননি। সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও শেখ মুজিবুর রহমান উদ্যোগ নেননি। আর তাই এই অবস্খার সৃষ্টি হয়েছে। আর এখন বঙ্গভূমি প্রতিষ্ঠা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই।
এ দিকে বঙ্গভূমি আন্দোলনের আরেক সংগঠক কালিদাস বৈদ্য গত কয়েক বছর নিûিক্রয় থাকলেও এখন আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। তারা পশ্চিমবাংলা ও বাংলাদেশের মতুয়া সম্প্রদায়কে তাদের আন্দোলনে অনেকটাই সংযুক্ত করতে পেরেছেন। এই মতুয়ারা নিুবর্ণের হিন্দু বলে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে এদের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখের মতো। এদের বেশির ভাগের বাস দুই চব্বিশপরগনা এবং নদীয়ার বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে।
কালিদাস বৈদ্য এদের নিয়ে বঙ্গসেনাকে সংগঠিত করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন।
দুই গোষ্ঠীর অবশ্য একটি জায়গায় মিল রয়েছে তারা উভয়ই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হিন্দুদের জন্য বঙ্গভূমি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সশস্ত্র আন্দোলনে বিশ্বাসী এবং উভয়েরই জাতীয় প্রতীক হচ্ছে ‘শ্রী’ শব্দ যুক্ত। দু’টি গোষ্ঠীই এখন বঙ্গসেনাদের আরো বেশি করে সংগঠিত করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০০৯ সকাল ৮:০১