আগেই লিখেছি, ইদানীং পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক মহলের সঙ্গে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক মহলের সম্পর্কটা আবার বেশ মাখো মাখো হয়ে উঠেছে৷ ফেসবুক-অনলাইনের সূত্রে এই প্রেম ও যোগাযোগের বাঁধন আরও খুলে গিয়েছে৷ তাতে কোনও অসুবিধা নেই৷ পশ্চিমবঙ্গবাসীর বেশিরভাগেরই মাতৃভাষা বাংলা৷ বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা-মাতৃভাষা সবই বাংলা৷ অতএব এহেন যোগাযোগ-ঘনিষ্ঠতা স্বাভাবিক ব্যাপার৷ সম্প্রতি এ রাজ্যে বাংলাদেশগন্ধী উৎসব, কবিতা-বই-গান-নাটক থেকে ইলিশ ইত্যাদির যাকে বলে একেবারে জোয়ার উঠেছে৷ একাডেমি চত্বরে রাত জেগে নাকি চলছে গঙ্গা-পদ্মা সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ও জলসা৷ ভালো, খুবই ভালো৷ তবু, ব্যক্তিগত পর্যায়ে একটা জিনিস দেখে বরাবরই খারাপ লেগেছে৷ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কোনও বুদ্ধিজীবীর লেখায় বাংলাদেশের জন্মের পিছনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদানের কথা কখনই সেভাবে তুলে ধরা হয়নি৷ বেশিরভাগেরই বিভিন্ন ধরনের লেখা-স্মৃতিকথা ইত্যাদি পড়ে মনে হয়েছে, এমনকী অনেক ‘মুক্তিযোদ্ধা’রও, বাংলাদেশ রাষ্ট্র তৈরি হওয়ার যুদ্ধটা যেন তাঁরাই আগাগোড়া লড়েছিলেন৷ ভারতের সেনাবাহিনী শেষদিকে খানিকটা ‘জোগাড়ে’র কাজ করেছিল মাত্র৷ বাস্তবে কিন্তু তাঁরা নিজেরাও জানেন, তাঁদের এই ঐতিহাসিক রোমন্থন কতখানি স্বকপোলকল্পিত৷
বাংলাদেশ রাষ্ট্রগঠনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদান সম্পর্কে একজন মুক্তিযোদ্ধাই অকপটে লিখেছিলেন৷ তিনি ‘টাইগার’ সিদ্দিকি৷ তাঁর সেই স্মৃতিকথা এ রাজ্যের বাংলা সংবাদপত্রে প্রথমে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল৷ তার পর বই হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল৷ শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর ‘টাইগার’ সিদ্দিকি বা কাদের সিদ্দিকি ভারতে এসে নিজের প্রাণ বাঁচান৷ সেই থেকে তিনি দীর্ঘকাল কলকাতাতেই ছিলেন৷ তাঁর নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করেছিল ভারত সরকার৷
এক এই ‘টাইগার’ সিদ্দিকি ছাড়া পরবর্তীকালে আর কোনও বাংলাদেশি মুক্তিযুদ্ধের নেতা কিংবা পাকিস্তানের প্রাক্তন সেনানীকে কিন্তু ভুলেও সত্যি কথা লিখতে দেখা যায়নি৷ এমনকী, বাংলাদেশের কোনও বুদ্ধিজীবীকেও না৷ তাঁরা কেউই এ কথাটা বুক ঠুকে লেখেননি যে, ভারতের সেনাবাহিনী ছিল বলেই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল৷ ভারতের সেনাবাহিনী না থাকলে কোনও দিনই বাংলাদেশ গঠিত হত না৷
যে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বাংলাদেশে অজস্র কাহিনি, সেই মুক্তিবাহিনীকেও তালিম দিয়েছিল ভারতেরই সেনাবাহিনী৷ আসলে, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশেই ভারতের সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের তালিম দিয়েছিল৷ না হলে যারা সেই সময় বাংলাদেশ গঠনের ঘোরতর বিরোধী ছিল, সেই পাকিস্তান থেকে শুরু করে তাদের গুরুঠাকুর তদানীন্তন মার্কিন প্রশাসন এবং মাওয়ের বেজিং, তারা প্রত্যেকেই ভারতের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রসংঘে আগ্রাসনের ধুয়ো তুলতে মুখিয়ে ছিল৷
অতএব এমন কিছু মুক্তিযোদ্ধাদের ডিট্যাচমেন্ট ভারতের সেনাবাহিনীকে তৈরি করতে হয়েছিল, যারা অনেকটা গাইডের মতো কাজ করবে কিংবা পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে পার্টিজান ওয়ারফেয়ার চালাবে৷ সেই মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ছবি দেখলে হাসি চাপা মুশকিল৷ লুঙ্গি পরে কাঠের তৈরি ডামি বন্দুক নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যে লেফট-রাইট থেকে শুরু করে গেরিলা যুদ্ধ পর্যন্ত শিখেছিল, ভারতের সেনা অফিসারদের ট্রেনিংয়েই সেটা সম্ভব হয়েছিল৷ না হলে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘অসমসাহসিকতা’ বহু আগেই খানসেনাদের মেশিনগানের সামনে ঝাঁঝরা হয়ে যেত৷ কিন্তু তার জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার বাংলাদেশের কোনও বুদ্ধিজীবীর লেখায় মেলে কি? বোধহয় না৷
বরং, বর্ষীয়ান সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্তর কাছে শুনেছি এবং তাঁর লেখা থেকেও জেনেছি যে, ঢাকা মুক্ত হওয়ার পর দুঘণ্টাও কাটেনি, ভারতেরই দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জড়ো-হওয়া ‘মুক্তিযোদ্ধারা’ অনেক অকথা-কুকথা সহ বলতে আরম্ভ করেছিল— এরা (ভারতের সেনাবাহিনী) এহনও যায় না ক্যান? বলা বাহুল্য, এই ‘কৃতজ্ঞতাবোধ’ পরবর্তীকালে শাখাপ্রশাখায় দশ গুণ-বিশ গুণ হয়ে দাঁড়ায়৷ তাই, সেখানকার সাংস্কৃতিক মহলে ভারতের সেনাবাহিনীর প্রতি কোনও রকম সহানুভূতির বালাই নেই৷
সেখানে বাংলাদেশের জন্মের সারকথা এখন ‘আমরাই হ্যান করছিলাম, আমরাই ত্যান করছিলাম’৷ পাকিস্তানি খানসেনারা যে আমাদের মাইরা উড়ুকুড় করতাছিল, ভারতের সেনাবাহিনী আইস্যা আমাগো বাঁচয়েছিল— এই সত্যকথাটা বাংলাদেশে লেখেন কজন? আর সে কারণেই, এখানে বাংলাদেশ বাংলাদেশ করে কারও আদিখ্যেতা দেখতে আমার ভালো লাগে না৷ যদিও বাংলাদেশের একাধিক কবির কবিতা, একাধিক কথাশিল্পী-প্রাবন্ধিকের লেখার আমি ভক্ত৷ আগে কলকাতা বইমেলায় অনেকেরই বই আমি খুঁজে খুঁজে বের করে কিনেছি৷ কিন্তু যখনই ভারতের সেনাবাহিনীর প্রতি সেদেশের সাংস্কৃতিক মহলের উদাসীনতা ও তাচ্ছিল্য চোখে পড়েছে, খারাপ লেগেছে৷ বিচ্ছিন্নতা ও ফাটল তৈরি হয়েছে আপনা থেকেই৷
কারণ, আমার চোখে বাংলাদেশের যুদ্ধ মানে একটাই ছবি— ভারতীয় সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার সামনে নিঃশর্তে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করছেন পাক জেনারেল নিয়াজি৷ পিছনে দাঁড়িয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জ্যাকব সহ একাধিক ভারতীয় আর্মি অফিসার৷ বাংলাদেশের মুক্তির জন্যই সেই যুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে জীবন দিয়েছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ল্যান্স নায়েক অ্যালবার্ট এক্কা৷ মরণোত্তর পরমবীর সম্মান পেয়েছিলেন তিনি৷
একজন ভারতবাসী হিসাবে যখন সেই গৌরবের কথা ভাবি, অথচ বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিবানদের দিক থেকে সে ব্যাপারে কোনও রকম স্বতোৎসারিত সৌজন্য ও কৃতজ্ঞতার চিহ্নমাত্র দেখি না, তখন ভালো লাগে না৷ তাই যথাসাধ্য তাঁদের থেকে দূরে থাকি৷
আরও যেটা আশ্চর্যের, এ রাজ্যে যাঁরা বাংলাদেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের সব থেকে বড় হোতা সেই বামপন্থী বুদ্ধিজীবীমহল, বিশেষ করে সিপিএমওয়ালারা বাংলাদেশ যুদ্ধের কিন্তু ঘোরতর বিরোধী ছিলেন৷ বাংলাদেশ যুদ্ধের পক্ষে তখন প্রচারে নেমেছিল কংগ্রেসের সহযোগী সিপিআই৷ সিপিএম ছিল একেবারে উলটো দিকে৷ সেই সময়েই পার্ক সার্কাসের পাকিস্তান ডেপুটি হাই-কমিশনে হানা দিয়ে ভারতের গোয়েন্দাবাহিনী এক পাক মেজরের পে-রোলে থাকা ভারত-বিরোধী উসকানিদাতা এজেন্টদের লিস্ট পায়৷ তাতে সিপিএম নেতা প্রমোদ দাশগুপ্তের নামও ছিল৷ সেই সিপিএমের পোষিত বুদ্ধিজীবীরাই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের সব থেকে বড় প্রচারকে রূপান্তরিত হন৷ অবশ্যই সেটা ঘটেছিল মুজিবুর হত্যাকাণ্ডের পর৷
বিদ্বজ্জনেরা বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের কি জিজ্ঞাসা করবেন, ভারতের সেনাবাহিনীর অবদানের কথা স্বীকার করতে তাঁদের অত কুণ্ঠা কেন
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৩০