Human Body - বইটা নিয়ে ওল্টাচ্ছি শুধু । কিছু ঢুকছেনা মগজে । অথচ দুদিন বাদেই ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা । পরীক্ষায় যে নৌকা ভালভাবেই ডুববে, সেটা বেশ টের পাচ্ছি । মরচে পড়া ফ্যানের ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দটাও অমনযোগী করে দিচ্ছে শুধু । বিরক্ত হয়েই বইটা তুলে বেডের উপর দিলাম এক আছাড় । কিছুই হলনা । ধপ্ করে একটা শব্দ হল কেবল ।
ব্যাংকার হবার ইচ্ছে ছিল এককালে । আর পরিবারের ইচ্ছে, ডাক্তার বানাবে আমাকে । বড় ভাইয়া ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে । তাই আমায় হতে হবে ডাক্তার । গলা টিপে মেরে ফেললাম নিজের সাধ আহ্লাদ । পরিবারের চাপিয়ে দেয়া দায়িত্বের ভারেই ভর্তি হলাম একটা সনামধন্য প্রাইভেট মেডিকেলে ।
একদম বোরিং লাইফ । বিদ্যা গায়ে মেখে তা ফলাতে হয় মানুষের দেহে । ডাক্তার বলে কথা । মেডিকেলের স্টুডেন্ট মানে, সারাদিন বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকা । এমনকি কখনও কখনও জান যায় যায় অবস্থা হয় । তবুও থেমে থাকার জো নেই । মেডিকেলের এমন বন্ধুর পথের যাত্রায় হোঁচট খেয়ে পড়ি । আবার সঙ্গে সঙ্গেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দৌড়োই । থেমে থাকলেই হারিয়ে যেতে হবে অন্ধকারে । সে অন্ধকার পেরোনোর পথ আজও কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি । পারলে হয়ত ঠিকই নোবেল পেত ।
দরজায় ঠক ঠক করে শব্দে ঘোর কাটল । দরজার ওপাশটায় একজনেরই অস্তিত্ব টের পাচ্ছি ।
আদিবা ।
আমার রুমমেট । বন্ধুমহলে আদি বলেই ডাকা হয় ।
শুধু রুমমেট বললেও ভুল হবে । একই কলেজে পড়ার সুবাদে গভীর দোস্তী আমাদের । তার উপর আবার ওর পরের রোলটাই ছিল আমার । কলেজের নিয়মেই ইন্টারমিডিয়েটের প্রতিটা পরীক্ষায় পাশাপাশি বসাটা আমাদের কাছে টেনে এনেছে আরেকটু । বন্ধুত্বের খাতিরে একই মেডিকেলে পড়ছি এখন ।
দরজাটা খুলে দিয়ে এসেই শুয়ে পড়লাম ।
অবেলায় শুতে দেখে অবাকই হয়েছে হয়তো আদি । বিস্ময় কাটাতে জানতে চাইল, কিছু হয়েছে কিনা ।
ভাল লাগছেনা কিছু । আবার খারাপ লাগারও কোন কারণ নেই । তাই কিছু বললাম না ।
উত্তরের আশা না করে আবার বলল “তোর জন্য একটা সুখবর আছে রে”
বলতে গিয়ে কন্ঠটা কেমন যেন ভারী হয়ে গেল ওর ।
মাথা না ঘুরিয়েই তাকালাম ওর দিকে ।
সুখবরটা জানতে চাওয়াতে মলিন একটা হাসি দিয়ে বলল,
“তোর চির শত্রু ফিনিশ । আর কেউ তোর ক্ষতি চাইবেনা কখনও”
ওর এরকম হাসিতে আঁতকে উঠলাম একটু । আমার প্রতি তীব্র ক্ষোভের প্রতিফলন দেখলাম যেন । এছাড়া আর কিছুই বুঝিনি । প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললাম,
“ক্লিয়ার করে বলবি ?”
“ক্লিয়ার করে বলার কি আছে? তোর আবার শত্রু কজন? চিনতে পারছিস না?”
কিছুটা বিস্ময় নিয়ে অতীত হাতড়ালাম । নাহ্ মনে পড়ছেনা । জানতে চাইলাম আরেকবার ।
“খুলে বলবি ? নাহলে বলতে হবেনা, যা ।”
“গতকাল রাতে নীল সুইসাইড করেছে”
বলেই হ্যাংগারে ঝোলানো টাওয়েলটা নিয়ে শাওয়ারে চলে গেল আদি ।
বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে হঠাৎ করে । কি শুনলাম আমি ? নিজের কানকেই অবিশ্বাস হচ্ছে ।
ঠিক শুনলাম তো ?
কয়েকটা বছর পেছনে ফিরতে ইচ্ছে করছে আজ । এই মুহুর্তে একটা টাইম মেশিন খুব মিস করছি ।
* * * * * * * *
নীল, আমি আর আদিবা । ক্লাসমেট ছিলাম আমরা । একসাথে ঘোরাফেরা । সারা শহর চষে বেড়ানো । সবই করতাম একসাথে ।
কিছু হিংসুটে মানুষের কটুক্তি আর কুনজর উপেক্ষা করে ভালই চলে যাচ্ছিল আমাদের ।
এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে সে দিনটার কথা, যেদিন নীল প্রোপজ করেছিল আমাকে ।
কলেজে শেষ দিন । ফেয়ারওয়েল ।
আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল নীল । কিছু একটা বলতে চেয়েও বলছেনা । তারপর আমিই বারান্দার এক কোণে ডেকে নিয়ে গেলাম ওকে ।
চুপ করে ছিল কিছুক্ষণ । তারপরই দুম করে কাঁপা কাঁপা গলায় প্রোপজ করে দিল ।
প্রথমে কৌতুক ভেবেই উড়িয়ে দিয়েছিলাম ব্যাপারটা । পরে অবশ্য বুঝেছিলাম বেশ ভালভাবেই পেছনে লেগেছে ও । তবুও ব্যাপরটাকে কৌতুক ভাবতেই ভাল লাগত । অন্য দৃষ্টিতে দেখতে চাইনি আর ।
ইচ্ছে করেই হয়তো চাইনি ।
তারপর কেটে যায় কিছুটা সময় ।
এইচ এস সি দিলাম । মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষাও হল ।
কোথাও চান্স না পেয়ে ভর্তি হলাম প্রাইভেটে । আমি আর আদি । নীলের খবর আর রাখা হয়নি । আদিবাকেও বলেছিলাম ওর ব্যাপারে কথা না বলতে ।
জীবনকে এখন নতুন করে চিনতে শিখেছি । জানতে শিখেছি । বুঝতে পেরেছি, আবেগ দিয়ে জীবন চলেনা । তবুও হৃদয় ভালবাসা চায় । রিলেশানে জড়ালাম একটা ছেলের সাথে । ছেলেটা বুয়েটের আর আমি মেডিকেল ।
যেন সোনায় সোহাগা ।
পারফেক্ট ম্যাচিং ।
সময়ের হাত ধরে ও বুয়েট শেষ করল ।
আর আমি মেডিকেলের দ্বিতীয় বর্ষে । আমাদের মাঝে সবকিছুই হয়েছে । বন্ধুরা অনেক বুঝিয়েছিল । সাবধান করে দিয়েছিল বহুবার । যার সাথে রিলেশান করছি সে একটা প্লে-বয় । অনেক মেয়ের সর্বনাশ করেছে ।
অনেক ভালবাসতাম ওকে । তাই অন্যের গালমন্দ কানে তুলিনি । সব সময় ভাবতাম ওরা আমাদের রিলেশানটাকে সহ্য করতে পারছেনা । তাই কানে বিষ ঢালছে ।
শেষে এসে, যা হবার তাই হল । আমাকে একদিন রেস্টুডেন্টে ডেকে বলল,
“শোন বৃষ্টি, আমার বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে । পরিবারের অমতে তোমাকে বিয়ে করাটা সম্ভব না আমার । আমাদের মাঝে যা হয়েছে সবকিছু ভুলে যেও । পারলে মাফ করে দিও আমাকে”
একটা কথাও বলতে পারিনি সেদিন । অবাক হয়ে শুনেছি শুধু । কথাগুলো কিভাবে এত সহজেই বলে ফেলল ! একটুও কি কষ্ট হয়নি ওর ? সেদিন বুঝেছিলাম, জীবনের সবচে বড় ভুলটা আমার কি ছিল । কিন্তু অন্ধকার পেরিয়ে আলোয় যাবার মাঝের দরজাটার চাবি আমার ছিলনা । হারিয়ে ফেলেছি সেটা বহু আগেই ।
* * * * * * * * * *
আদিবা শাওয়ার ছেড়ে বের হতেই, ধরলাম ওকে ।
“কি বললি তুই ?”
“কেন ? খুশি হোসনি ?”
কিছু বলতে পারলাম না । গলায় আটকে যাওয়া কথার ভীড়ে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে । খুব কষ্ট হচ্ছে । দাঁত দিয়ে ঠোট কামড়ে কান্নার শব্দ আটকে রেখেছি । কিন্তু চোখ যে বাঁধ মানতে নারাজ । আমিও বাঁধা দিলামনা । গাল বেয়ে নোনা পানি বইতে দেখে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
“কান্না থামা । তোর চোখে পানি? মানায় না”
কটুক্তিটা ধরতে পেরেও কিছু বলতে পারছিনা আমি । কাঁদছি শুধু ।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল আদি,
“কালকে নীলকে নিয়ে যাবে ওর গ্রামের বাসায় । ওখানেই দাফন দেবে । ওর ভাইয়ের কাছে শুনলাম, মারা যাবার আগের দিন রাতে নাকি তোর সাথে দেখা করতে চেয়েছিল নীল । যদি ইচ্ছে করে, দেখতে যেতে পারিস ।”
নীলের সেই পুরোনো কথাগুলো মনে পড়ছে আজকে । চাপা স্বভাবের ছেলেটার হাসিই ছিল সবকিছু । হাসি দিয়েই বলে দিত সব কথা । মন ভাল থাকলে খুব হাসত ছেলেটা । কষ্ট পেলেও হাসত । তবে সে হাসিতে আনন্দ থাকত না । তখন সবাই বুঝত, মন ভাল নেই নীলের ।
শেষ যেদিন কথা হয়েছিল ফোনে, পুরোটা সময়জুড়ে চুপ করে ছিল ও । শূধু শেষে একা কথাই বলেছিল । আজ খুব মনে পড়ছে কথাটা ।
“যদি কথনও জানতে পারো আমি মারে গিয়েছি, সময় করে দেখতে এসো কিন্তু এই খারাপ ছেলেটাকে । খুশি হব”
বলেই হেসে দিয়েছিল ।
হ্যাঁ যাবো । ওকে দেখবো আমি । ফিরে যাবো ওর কাছে ।
* * * * * * * *
নীলের বাসার সামনে রিক্সাটা এসে থামল ।
একটা ছোটখাট জটলা হয়েছে ওখানটায় । রিক্সা থেকে নামলাম আমি আর আদি । ভাড়া মিটিয়ে টিপটিপ করে এগোচ্ছি । মনে হচ্ছে পায়ে কয়েক শ টনের পাথর বাঁধা । অথবা পেছন থেকে টেনে ধরে রেখেছে কেউ ।
ভীড় ঠেলে এগিয়ে গেলাম ।
শুয়ে আছে নীল । শান্ত সেই ছেলেটা আজও শান্ত রয়ে গেছে ।
সবাইকে ছেড়ে যাবার আগে হয়তো মুচকি হেঁসে বলেছিল, “ আর কেউ কষ্ট দেবে না আমায় । দিতে পারবেনা ।আজ থেকে আমি মুক্ত” । সেই হাসিটা এখনও লেগে আছে নীলের প্রসারিত ঠোটজোড়ায় ।
গুটিগুটি পায়ে কাছে গিয়ে বসলাম ।
হাতটা টেনে নিয়ে চেপে ধরে রেখেছি আমার দু হাতের তালুর মাঝে । হিমশীতল দেহটা যেন ওর অনুপস্থিতিটাকে বারবার জানান দিচ্ছে ।
নীলকে উঠিয়ে নিতে কয়েকটা লোক এগিয়ে এলো । একটু পরেই নিয়ে যাবে ওকে । অনেক দূরে । আর কখনও ফিরবে না । ভেতরটা কেন জানি কেঁপেকেঁপে উঠছে । তাহলে কি ওকে হারাবার পর বুঝলাম ও আমার জীবনের কতটা অংশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিল !!
নীলকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওরা । কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে আমার কাছে থেকে ।
কি যেন একটা দেখলাম নীলের হাতে । ঝাপসা হয়ে যাওয়া চোখটায় স্পস্ট দেখতে পারছিনা ।
হ্যাঁ, কিছু একটা লেখা হয়েছে হাতে । পাগল টা নিজের হাতকে ক্যানভাস বানিয়ে ব্লেডকে তুলি করে এঁকে রেখেছে আমার নামটা ।
“বৃষ্টি”
হু হু করে কেঁদে দিলাম ।
জড়িয়ে ধরলাম নীলকে । আমার নীলকে ।
“নীল, এসো আরেকটা বার । বলোনা , ‘ভালবাসি’ । বলেই দেখো ।
আর ফিরিয়ে দেবনা । বেঁধে রাখব সারাটা জনম । ”
নীল তবুও একটা বারের জন্যেও তাকায়নি সেদিন ।
* * *
আজ বহু বছর পেরিয়ে গেছে, জীবনটাও বদলেছে অনেকখানি ।
সময়ের মূল্য কতখানি এখন তা বুঝতে শিখেছি
জীবনের সবচে দামী জিনিসটা হারিয়ে ।