প্রথমেই আমার নিজের কথা বলি... আমি ঢাকার শীর্ষস্থানীয় একটি কলেজের স্টুডেন্ট, এবারের HSC পরীক্ষার্থী। অন্যদের মত আমার পরিবার এবং আমি, উভয়েই চিন্তা করতাম HSC এর পরে বুয়েট বা মেডিকেল বা অন্য কোন পাব্লিক ইউনিভার্সিটিতে পড়ব... কিন্তু হটাত করে কিছু ব্যক্তিগত কারণে সিদ্ধান্ত নিলাম আন্ডারগ্রাজুয়েট আর দেশে করব না, বাইরে চলে যাব। যেহেতু সায়েন্সের স্টুডেন্ট, সেক্ষেত্রে বেস্ট চয়েস হল আমেরিকা, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া। আমার ইচ্ছা আমেরিকা, কেননা অনেক পরিচিত মানুষ থাকে ওখানে, এবং আমার অনেক দিনের ইচ্ছা আমেরিকাতে পড়াশুনা করব।
আমাদের দেশ থেকে সাধারনত আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলে খুব কমই দেশের বাইরে যায়, যারা যায়, তারা বেশিরভাগই UK পড়তে যায়, কারন খরচ কম, যেতে সুবিধাও অনেক, আর UK তে তুলনামূলকভাবে বেশি বাংলাদেশী বাস করে। কিন্তু যারা আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলে আমেরিকা যেতে চায়, তারা পরে আসল বিপদে। ইন্টারনেট ঘেঁটেও তেমন কিছু উপকারি পাওয়া যায়না, আবার সামহোয়্যার এও আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলে আমেরিকা যাওয়া নিয়ে তেমন কোন ব্লগ নেই। এক্ষেত্রে অনেকেই ভুল বোঝেন, বা অনেক স্টুডেন্ট কনসালটেন্সি ফার্মে গিয়ে অহেতুক অনেক টাকা খরচ করেন। তাই আমেরিকাতে থাকা আমার বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন এবং নানা জায়গায় খোঁজ নিয়ে যা জানতে পারলাম, টা বুঝে ভাবলাম এই পোস্টটা লেখি…
আমেরিকাতে পড়তে চাইলে যা যা থাকা প্রয়োজনঃ
১. ফান্ডঃ
এটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। আমরা বাংলাদেশীরা সাধারণত এই বিষয়টাকে খুবই গুরুত্তের সাথে বিবেচনা করি, কেননা একজন আমেরিকানের নেট ইনকামের সাথে বাংলাদেশের কারো তুলনা করতে গেলে আকাশ পাতাল পার্থক্য দেখা যাবে। আমেরিকাতে পড়াশোনার খরচও ওদের হিসেবেই ধরা হয়। আমাদের দেশে যেমন সরকারি কোন ইউনিভার্সিটি থেকে B.Sc. পাশ করতে গেলে ৪ বছরে সব মিলে প্রায় ২০ হাজারের মত খরচ হবে, এবং প্রাইভেট থেকে ৬ থেকে ৮/৯ লাখ, সেখানে আমেরিকাতে কোন স্টেট ভার্সিটিতে ৪ বছরের জন্য B.Sc. পড়তে গেলে প্রায় $1,20,000 থেকে $1,60,000 এর মত খরচ হবে, যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৳৯৩,৬০,০০০ থেকে ৳১,২৪,৮০০০০ এর সমান। আবার, প্রাইভেট কোন ভার্সিটিতে পড়তে গেলে ৪ বছরে B.Sc. এর জন্য খরচ হবে প্রায় $1,60,000 থেকে $2,24,000 পর্যন্ত, যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৳১,২৪,৮০০০০ থেকে ৳১,৭৪,৭২০০০ পর্যন্ত... অবশ্য আরও কমেও পড়াশোনা করা যায়, কিন্তু খরচটা ভার্সিটির রাঙ্কিং, হোস্টেল ফিস আর খাবার খরচের উপর মুলত নির্ভর করে।
তবে যত কমেই করুন না কেন, খারাপ রাঙ্কিং এর কোন ভার্সিটিতে পড়তে গেলেও প্রায় ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত টাকা খরচ হয়। টাকার কথা প্রথমেই চিন্তা করতে হয়, এবং আপনাকে ফান্ড রেডি রাখতে হবে। নাহলে যদি এমন চিন্তা করে থাকেন যে ১/২ সেমিস্টারের টাকা নিয়ে যাবেন, এবং জব করে পড়ার খরচ চালাবেন, তাহলে আপনি ভুলের মধ্যে বাস করছেন। ক্যাম্পাসের অড জব গুলা থেকে মাসে $300-$800 এর বেশি আসবে না। তাই ফান্ড রেডি করে আমেরিকা যাবার প্রস্তুতি গ্রহন করুন।
তবে, আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলে আমেরিকাতে যদি টাকা খরচ করে ভাল কোন ভার্সিটিতে পড়ে ভাল রেজাল্ট নিয়ে বেরোতে পারেন, তাহলে আপনার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাবে। আপনি আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলে ভাল রেজাল্ট করলে M.Sc. করার সময় ফুল ফ্রী স্কলারশিপ পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক, তাও আমেরিকাতেই। আবার, আমেরিকার সার্টিফিকেটের গ্রহনযোগ্যতাও চাকরির ক্ষেত্রে অন্যান্য সবখানের থেকে একটু বেশি। তাই টাকা খরচ হলেও, আপনারই লাভ। এটা বুঝলে এই টাকা খরচটা আর আপনার তেমন গায়ে লাগবে না।
২. HSC, SAT এবং TOEFL রেজাল্টঃ
যেকনো ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পূর্বশর্ত হল, HSC তে এভারেজ রেজাল্ট, SAT এবং TOEFL এ ভাল একটি নির্দিষ্ট মার্কস। আপনার HSC এর রেজাল্ট প্রধান নয়, বরং আপনার SAT এর মার্কস প্রধান হিসেবে বিবেচিত হবে। আর, আপনি ইংলিশ কেমন পারেন, টা বুঝাতে TOEFL এ মোটামুটি ভাল নাম্বার পেলেই চলে। কিন্তু অধিকাংশ ইউনিভার্সিটিই SAT এ ২৪০০ তে নুন্যতম ১৩৫০ থেকে ১৬০০ নাম্বার চায়। এইটা কোন স্কোরের পর্যায়ে পড়ে না, এই স্কোর পেলে আপনি অ্যাপ্লাই করতে পারবেন। ১৮০০+ স্কোরকে ডিসেন্ট স্কোর বলে ধরা হয়। আপনার নাম্বার যত বেশি, তত ভাল ভার্সিটিতে আপনার সিলেক্ট হওয়ার সুযোগ বেশি।
৩. স্কলারশিপঃ
আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ে সাধারণত তেমন উল্লেখযোগ্য পরিমানে স্কলারশিপ দেয় না। কিন্তু যদি আপনি HSC তে গোল্ডেন পান, SAT এ অনেক বেশি, যেমন ১৯০০+/২১০০+ (পেলে ভাল) নাম্বার পান, এবং TOEFL এ ভাল নাম্বের পান, তাহলে আপনি মেরিট বেসড স্কলারশিপ পাওয়ার আশা করতে পারেন। কিন্তু ফুল ফ্রী তে পড়তে পারবেন না, সাধারণত 20%-50% মত স্কলারশিপ দেয় বলে শুনেছি। কিন্তু ফুল ফ্রি স্কলারশিপ যে দেয় না তা না। ফুল ফ্রি পাওয়ার জন্য এক্ট্রা অরডিনারি আপ্লিকেশন দরকার হয়, এবং একটি এক্ট্রা অরডিনারি আপ্পলিকেশনে থাকে ভাল স্যাট স্কোর, ভাল টোফেল স্কোর, ইন্টারন্যাশনাল/ন্যাশনাল কোন প্রতিযোগিতা/অলিম্পিয়াড এ পদক লাভ- এই টাইপের বিষয়গুলি। বাংলাদেশ থেকে অনেকেই আজ পর্যন্ত ফুল ফান্ডিং পেয়ে টপ লেভেলের ভার্সিটিগুলোতে পড়ছে।
৪. পরিবারের সমর্থনঃ
আপনার ইচ্ছা আমেরিকা যাওয়ার, তাই জন্য জেদ করলেন এবং পরিবারকে মানালেন, এটা করা ঠিক না। কেননা সাধারণত বিদেশ বিভুয়ে পরিবারের মত পরিচিত কাউকে খুঁজে পাবেন না, তখন আপনার নিজের জন্যই অনুশোচনা বোধ হবে। আমার বেশ কিছু বড়ভাইয়ের জীবনথেকে নেওয়া অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।
৫. পড়ার সময় চাকরির উচ্চাশাঃ
অনেকেই মনে করে, পড়তে পড়তে চাকরি করব, কিছু টাকা দেশে পাঠাব, কিছু টাকা দিয়ে টিউশন ফি শোধ করব, কিছু জমাবো। আমিও কিছুদিন আগে এমনই চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু যারা আমেরিকা বা অন্য কোন দেশে পড়াশোনা করছে, তাদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম টা নিছক কল্পনা। পড়ার সময় জব পাওয়া অনেক কস্টকর, আবার ইনকাম ও খুব কম। আমাদের দেশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত একটু বেশি ই, কিন্তু বাইরে টা অনেক কম। দেখা যাবে, নিজের খরচ চালাতে গিয়েই হিমশিম খেতে হচ্ছে, আপনার হাতে টাকা এত কম আছে। তাই পড়ার সময় চাকরি করে ভাল উপার্জন করার চিন্তা বাদ দিতে হবে।
৬. অন্যান্য খরচঃ
আর অনেক খরচ আছে, যেমন একটি ভারসিটির আলাদা আলাদা সাব্জেক্টে অ্যাপ্লাই করতে গেলে আলাদা আলাদা অ্যাপলিকেশন ফর্ম কিনতে হয়, যার প্রতিটির মুল্য প্রায় $50-$120 বা $130 পর্যন্ত হয়, যা টাকায় প্রায় ৪০০০ থেকে ১০০০০ পর্যন্ত লাগে। এইসব খরচ মাথায় রাখতে হবে।
উপরিউক্ত বিষয়গুলো আমার নিজের অভিজ্ঞতা, বর্তমান আমেরিকাতে অধ্যয়নরত আমার পরিচিতজন এবং যারা এই ধাপ পার করে এসেছেন, তাদের অনেকের অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে রচিত। এর মধ্যে অনেক ভুলত্রুটি থাকতে পারে, যা নিজগুনে মাফ করে দিবেন। এবং, আপনার যদি মনে হয় কোন কিছু অ্যাড করা প্রয়োজন, কমেন্টে তা জানাতে পারেন, আমি অ্যাড করে দিব। এই পোস্ট থেকে কেউ যদি বিন্দুমাত্র উপকৃত হয়, তাহলে আমার কষ্টকরে পোস্টটি লেখা সার্থক মনে করব।
সব কিছু বিবেচনা করে এবং পরিবারের সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ২০১৫ সেশনে আমেরিকা যাওয়ার চেস্টা করব। আমি আপনাদের সকলের কাছে দোয়াপ্রার্থী।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ৮:৪৩