এক সমুদ্র টিউলিপ!!
ফুল ভালোবাসে না এমন লোক কি আছে? এক কথায় "না" একেবারেই নেই । গম্ভীর , খিটখিটে আর বিষাদপূর্ণ মানুষের মনও নেচে উঠতে চায় এই রঙিন ঢেউয়ে , প্রানের সঞ্চালন হয় গম্ভীর মৌন মনেও । মন পায় অদৃশ্য এক ডানা, উড়ে যেতে চায় সুনীল আকাশে । এ দৃশ্য দেখলে মানুষের প্রাণের দরজাগুলো খুলে যায় , অক্সিজেন বয়ে যায় শিরায় শিরায় ,দ্বিগুণ উৎসাহে সবেগে ধাবিত হয় নতুন দিনের পথে । এভাবেই কয়েক ধাপ এগিয়ে যায় জীবনীশক্তি । আহা!! সে'কি উত্তাল ঢেউ!! এখনো সেই টিউলিপের রং লেগে আছে আমার চোখে।
এক মাস আগে নেদারল্যান্ডে গিয়েছিলাম টিউলিপের সমুদ্র দেখতে। মার্চের মাঝা মাঝি থেকে মে মাসের শেষ অব্দি এই ফুলের চাষ হয় নেদারল্যান্ডে । যদি কেউ বিশেষ করে ফুল দেখতে চায় তবে এই সময়ের মধ্যেই যেতে হবে । তাছাড়া, এই অনিন্দ্য সুন্দর ফুল দেখা হবে না ।
নেদারল্যান্ডে সাধারণত ইউনিভার্সিটির ছেলেমেরা বেশী যায়, কারন তাদের আনন্দের উপকরণ ওখানে অনেক বেশী । আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি তখন স্টুডেন্ট ইউনিয়ন থেকে নেদারল্যান্ড টুরের আয়োজন করা হয়েছি , কিন্তু আমার যাওয়া হয়নি নানান কারনে । তাছাড়া, আমি পাব , ডিস্কতে ফুর্তি করার চেয়ে প্রকৃতি দেখতে বেশী ভালোবাসি । তাই ফ্যামিলি নিয়ে গত মাসে চলে গেলাম স্বর্গীয় প্রকৃতির কাছে ।
উত্তর সাগরের বেশ কাছেই একটি হলি ডে কটেজে আমরা উঠেছিলাম। তার আসে পাশে ছিল মাইলের পরে মাইল ফুলের আবাদ জমি । এই দেশটি পৃথিবীর সর্বচ্চো ফুল উৎপাদনকারী দেশ । ফুলের জন্য খুবই উর্বর এদের ভূমি এবং বেশী ভাগ ভূমিই সমতল।
টিউলিপের জন্য বিখ্যাত হলেও এদেশের জাতীয় ফুল অফিসিয়ালি টিউলিপ নয় , যদিও এদের কোন জাতীয় ফুল নেই অন্যান্য দেশের মত । আন-অফিশিয়ালি টিউলিপকে জাতীয় ফুল মনে করা হয় এর অধিক উৎপাদনের ফলে। টিউলিপ মূলত এসেছে তুরস্ক থেকে এবং তুরস্কের জাতীয় ফুল হচ্ছে টিউলিপ । ষোলশ শতাব্দীতে নেদারল্যান্ড এই ফুলের বাল্ব তুরস্ক থেকে এনে এর প্রচুর ফলন করে এবং পুরো ইউরোপে একে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং ধীরে ধীরে পুরো বিশ্বে এর সমাদর বেড়ে যায় ।
নানান রং এর টিউলিপ!! এই সমস্ত রং গুলো আমি চোখ দিয়ে শুষে নিয়ে আমার হৃদয়ে রেখে দিয়েছি । সত্যিই , রং মানব মনে অন্য রকম প্রভাব বিস্থার করে , তাইতো আমি ছুটে যাই প্রকৃতির কাছে , রং এর কাছে ।
উপড়ে যে বেগুনী, সাদা আর গোলাপি রং এর ফুল দেখা যাচ্ছে , ওগুলোর নাম হচ্ছে হাইসিন্থ( Hyacinth) এই ফুলও কয়েকটি রঙের হয় । আর এর রয়েছে দারুণ সুন্দর গন্ধ । এই ফুলের জমির কয়েক গজ দূরে থেকেও এর মিষ্টি মধুর গন্ধ আপনার ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে নাড়া দিয়ে আপনাকে মাতাল করে দেবে । সে কি অসাধারণ গন্ধ আর স্বপ্নিল দৃশ্য!! মাইলের পরে মাইল ফুলের সমারহ!!
উপড়ে দেখা যাচ্ছে ড্যাফোডিল । আমার কাছে মনে হচ্ছিল ড্যাফোডিলের হলুদ সমুদ্র । সবাই হয়তো নাম শুনেছেন , এবং দেখেছেনও। এই ফুল ইউরোপের বসন্তকালে দেখা যায় খুব । ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ এপ্রিল পর্যন্ত এই ফুল খুব দেখা যায় । এই ফুল নিয়ে ইংলিশ অনেক কবিই কবিতা লিখেছেন । বিশেষ করে রবার্ট হেরিকের " ড্যাফোডিল" কবিতাটি বেশ পরিচিত বাংলাদেশেও। আমাদের ছোটবেলায় এই কবিতাটি পড়েছিলাম ।
Fair Daffodils, we weep to see
You haste away so soon;
As yet the early-rising sun
Has not attain'd his noon.
Stay, stay,
Until the hasting day
Has run
But to the even-song;
And, having pray'd together, we
Will go with you along.
We have short time to stay, as you,
We have as short a spring;
As quick a growth to meet decay,
As you, or anything.
We die
As your hours do, and dry
Away,
Like to the summer's rain;
Or as the pearls of morning's dew,
Ne'er to be found again.
------- Robert Herrick
এই কবি ড্যাফোডিলকে আমাদের জীবনের সাথে তুলনা করেছেন। আমাদের জীবন যেমন ক্ষণস্থায়ী ড্যাফোডিলও অনুরূপ ভাবে খুব তারাতারি প্রকৃতি থেকে বিদায় নেয় ।
বাড়ি ফেরার পথে আমার হাসবেন্ড ফুলের বাগান থেকে অনেক গুলো টিউলিপের কলি এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিল । বাগান থেকে এত্ত গুলো তাজা টিউলিপের কলি নিয়ে বাড়ির পথে অর্থাৎ লন্ডনের পথে যাত্রা শুরু করলাম । বাড়ি এসেও চোখে শুধু রঙিন সমুদ্র ভাসে ।
ফুল গুলো পানিতে ছিল প্রায় দুই সপ্তাহ। তারপর শুকিয়ে যায় । শুকিয়ে যাবার পরও একে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না ।
সত্যিই এখনো চোখে ভাসে সেই এক সমুদ্র ফুল আর ফুল ।
ছবিগুলো সব আমার নিজ হাতে তোলা ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০১৭ বিকাল ৫:৪২