এবার গ্রীষ্মের ছুটিটা নিরালায় কাটিয়েছি । সেই দূরে পাহাড়ের ঢালে জনবসতিহীন অতিব সুন্দর প্রকৃতির সাথে । স্কটল্যান্ডের হাইল্যান্ডের প্রায় শেষ মাথায় ছিল জায়গাটি । অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ডুবু ডুবু চারিদিক । যেখানে আমরা ছিলাম সেখানে কোনই বসতি নেই , কারন শীতের সময় ওখানে বসবাস করাই মুশকিল। ওখানে গ্রীষ্মে ক্যাম্প করতে যায় ভ্রমনবিলাশিরা । প্রকৃতি আমি এতো ভালবাসি যে সে ভালোবাসার সীমানা নির্ধারণের সুযোগ্য ভাষার ব্যবহার আমি এখনো শিখিনি !! পাহাড় , সবুজ আর জলাশয় - আপরূপ সে দৃশ্য যেন কখনোই ভোলার নয় !!
সুইজারল্যান্ডের সৌন্দর্যও দেখেছি আর স্কটল্যান্ডের হাইল্যান্ড এরিয়ার সৌন্দর্যও দেখলাম , সেই একই পাহাড়ি ল্যান্ডস্কেপ , তবুও যেন দুটি দু'ধরনের সৌন্দর্যে মহীয়ান । সুইজারল্যান্ডে আল্পসের পর্বতমালা ভীষণ উঁচু এবং বিস্তীর্ণ । আর সবচেয়ে বড় ব্যপার হলো - ওখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে মানুষের হাতের ছোঁয়া লেগেছে । অতি যত্নে লালিত সুইজারল্যান্ডের প্রকৃতি, এবং ভীষণ পরিপাটি আর পরিচ্ছন্ন । সুন্দর নারী যখন রূপের চর্চায় আরও বেশী সুন্দরি হয়ে ওঠে , ঠিক সেরকমটিই বলা যেতে পারে সুইজারল্যান্ডকে । আর স্কটল্যান্ড হলো কিছুটা প্রকৃতির আপন নিয়মে বেড়ে ওঠা ন্যচারাল বিউটি । এখানে বারতি কোন যত্ন নেই তবুও সে স্ব-মহিমায় মহীয়ান , অতুলনীয় রূপে অপরূপা ।
বাচ্চাদের স্কুল হলিডে ছয় সপ্তাহ । অনেকটা সময়ই বাচ্চাদের জন্য বরাদ্দ ছিল । তাইতো চলে গেলাম শহর ছেড়ে বহু দূরে স্কটল্যান্ডের গেনক্ল নামক একটি জনশূন্য পাহাড়ি এলাকায় । হলিডেতেও বেশ অনেকটা কাজ নিয়েই গিয়েছি । একটি রিসার্চ প্রপোজাল তৈরির কাজ হাতে নিয়ে গিয়েছিলাম এবার । ওটা আমাকে শেষ করতেই হবে , তাই ঘোরাঘুরির ফাঁকে ফাঁকে নিজের কাজটিও করছিলাম । একদিন তো পুরো দিন ক্যারাভ্যানে আমি আর বিড়াল লুনা ছিলাম একা । সবাই চলে গেছে দূরে কোথাও ঘুরতে । আর আমি বসে বসে কাজ করছি । তবে বেশ আনন্দই হচ্ছিল - নিস্তব্দ , নিরালায় বসে কাজ করার আনন্দই অন্যরকম । এরকম পরিবেশে লেখালিখির কাজ অনেক দূর এগিয়ে যায় । ওখানে ইন্টারনেট কানেকশন একেবারেই ছিল না বলতে গেলে , মাঝে মাঝে একটু একটু ফ্রিকোয়েন্সি পাওয়া যেত । ইন্টারনেট ছাড়া যে জীবন এতো আনন্দময় হয় , ওখানে না গেলে হয়তো বুঝতেই পারতাম না ।
একা থাকতে আমার ভীষণ ভালো লাগে । একা থাকলে এই আমি দুজন হয়ে যাই , কখনো কখনো অনেক জন । নিজের ভেতরের অনেক গুলো সত্ত্বার খোঁজ মেলে । সেই সত্ত্বাগুলোকে জানার সুযোগ হয় , আত্মতৃপ্তি মেলে । ভয় পায়িয়ে দিলাম তো , ভয়ের কিছু নেই । আমি বরাবরই এরকম , কথা বলি কম , তাইতো এরকম কল্পনা বিলাসী । আমাকে যারা চেনে সবাই জানে আমি কথা বলি কম । আমি শুধু দেখি , দু'চোখ ভরে দেখি । দেখি আর মনযোগ দিয়ে শুনি , খুব ভালো শ্রোতা আমি । থাক ওসব কথা , যেটা বলছিলাম - একা থাকার আনন্দটাই অন্যরকম । নিজের সাথে , প্রকৃতির সাথে অন্যরকম বন্ধন গড়ে তোলা যায় একা একা সময়গুলোতে । অনেক কথা হয় , অনেক বোঝা পড়া হয়, নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে প্রকৃতির সাথে ।
লিখতে লিখতে অনেকটা সময় পার হয়ে গেল । আমার রিসার্চ টাইটেল ছিল " 21st century’s discrimination against women in legal workforce." বেশ ফেমিনিস্ট ফেমিনিস্ট ভাব এসে গিয়েছিল লিখতে লিখতে, ভীষণ একঘেয়ে লাগছিল । বেরিয়ে পড়লাম হাঁটতে , একা একা বহু দূর চলে গেলাম । মনে হচ্ছিল এই পৃথিবীতে আমি একা , সাথে রয়েছে মেঘলা আকাশ , সবুজ পাহাড় , জলাশয় , মাঠ ভরে রয়েছে ভেড়ার পাল , একটি রাখালও নেই কোথাও !! শুধু আমি আর এই জনশূন্য প্রকৃতি ।
কবিতা লিখতে ইচ্ছে হচ্ছিল , তাজা কবিতা , প্রকৃতির রসে তরতর করে বেড়ে ওঠা তাজা কবিতা , কিন্তু হলো না । মাথায় ফেমিনিজম ঘুরছিল আর কাজ শেষ করার তাড়া । প্রকৃতিকে চোখ দিয়ে শুষে নিয়ে পরিতৃপ্ত হওয়া ছাড়া আর কিছুই করা গেল না । চলতে চলতে বেশ শীত শীত লাগছিল তাই চলে এলাম ক্যারা ভ্যানে । ক্যারা ভ্যান থেকেও অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতি উপভোগ করা যাচ্ছিল । দিনগুলো সত্যিই চমৎকার ছিল । রবীন্দ্রনাথ দিন গুলো সোনার খাঁচায় ধরে রাখতে পারেনি , তবে আমি রেখেছি। সেটা সোনার খাঁচা নয় ঠিকি , সে এক অদৃশ্য খাঁচা । সেখানেই বন্দি করে রেখেছি সবগুলো দিন ।