somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিএনপির জন্ম যেভাবে সেনানিবাসে: ২ জিয়া রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা পূরণে যাদু মিয়াকে ব্যবহার করেছিলেন

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ দুপুর ১২:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

স্টিফেন আইজেনব্রাউনকে অনেকবারই আমাদের বাসায় দেখেছি’, স্মরণ করেন মশিউর রহমান যাদু মিয়ার ছেলে আনোয়ারুল গনি। তাহলে আপনিই কি সেই তরুণ, যে আইজেনব্রাউনকে ডেকে আনতে মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছিলেন? প্রতিবেদকের এ প্রশ্নে সায় দেন আনোয়ারুল গনি। তাঁর বয়স এখন ৫৯। ১৫ সেপ্টেম্বর তাঁর সঙ্গে কথা হয়। দীর্ঘ আলাপে প্রকাশ পায়, জিয়া যাদু মিয়াকে তাঁর রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণে ব্যবহার করেছেন। আবার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেও ছাড়েননি। তবে জিয়া কিংবা বিএনপি সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করেননি গনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জিয়া দল গঠনে সেনা গোয়েন্দা সংস্থাকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৭৭ সালে যাদু মিয়াকে গৃহবন্দী ও তাঁর দুই ছেলেকে (আনোয়ারসহ) গ্রেপ্তার করিয়েছিলেন। পরে জিয়া তাঁর আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। এরপর যাদু মিয়া আবার জিয়ার সঙ্গে সক্রিয় হন। ’৭৭ সালের গণভোট প্রশ্নে যাদু মিয়ার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের মতভেদ হয়। সে কারণে তাঁরা হয়রানির শিকার হন। আনোয়ারুল গনির ভাষায়, ‘আমি যদিও ন্যাপ করতাম, কিন্তু আমার ভাই তরিকুল গনি (বর্তমানে সুদানে) তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সাদা পোশাকের পুলিশ বাসা থেকে আমাদের ধরে নিয়ে গেল। প্রথমে মতিঝিল, পরে রমনা থানায়। ডিজিএফআই ও এনএসআই থেকে লোক এসে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করল। একদিন জিয়া নিজেই রমনা থানায় ফোন করলে আমরা ছাড়া পাই।’
’৮৫ সালের ১১ এপ্রিল যাদু মিয়ার ভাই মোখলেসুর রহমান সিধু মিয়া জাতীয় জাদুঘরের কথ্য ইতিহাস প্রকল্পকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও এ বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করেন। বরেণ্য শিক্ষাবিদ সরদার ফজলুল করিম ও মুস্তাফা নূরউল ইসলাম যৌথভাবে এই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। প্রথম আলোকে তাঁরা উভয়ে তা নিশ্চিত করেন। দুই ভাতিজার গ্রেপ্তারের ঘটনা সম্পর্কে সিধু মিয়া তাঁর ওই অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘গণভোটের যে পোস্টার দেয়ালে সাঁটা হয়েছিল, সেগুলো নাকি তারা ছিঁড়েছিল, সেই অভিযোগে তাদের আটক রাখা হয়। যাদু মিয়ার দুই ছেলেকে প্রায় তিন সপ্তাহ, মানে গণভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত থানাহাজতে আটক রাখা হয়। তারা যাদু মিয়ার ছেলে, শুধু এ কারণেই আটক করা হয়েছিল।’ সিধু মিয়ার দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে জিয়ার বিএনপি গঠন-প্রক্রিয়ায় মদদ, গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকারি অর্থব্যয়ের দিকটিও ফুটে উঠেছে।
ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সিধু মিয়া (ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেলের বাবা) পেশায় ব্যবসায়ী হলেও প্রগতিশীল ধারার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। তিনি স্বীকার করেন, বিএনপি গঠন-প্রক্রিয়ায় তিনি নেপথ্যে তাঁর ছোট ভাইকে নানাবিধ পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং সেটা ছিল ‘গণতন্ত্রে উত্তরণের স্বার্থে, ছোট ভাইকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর জন্য নয়।’
গণভোট নিয়ে বিরোধ: সিধু মিয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘জিয়াউর রহমান হঠাৎ করেই যাদু মিয়ার সঙ্গে আলোচনা বন্ধ করে দিয়ে গণভোটের সিদ্ধান্ত নিলেন। যাদু মিয়া তো একেবারে খেপে লাল। সে আমাকে বলল, “জিয়া আমার সঙ্গে বেঈমানি করেছেন। আমি একটা সংবাদ সম্মেলন করব।” আমি বললাম, “কীভাবে সংবাদ সম্মেলন করবে? এখন তো মার্শাল ল চলছে।” যাদু বলল, “না, সংবাদ সম্মেলন করবই”।’
সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয় যাদু মিয়ার মগবাজারের বাসা ‘লুতেশিয়া’য়। সিধু মিয়ার সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, যাদু মিয়ার সেই সংবাদ সম্মেলনের বিবরণ কোনো দিন ছাপা হয়নি। কারণ, সেটা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। জিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ সংযোজনের জন্য কৃতিত্ব দাবি করেছিলেন। যাদু মিয়া তাঁর সংবাদ সম্মেলনে জিয়ার সেই দাবির সূত্র ধরে বললেন, ‘উনি তো “বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম” যোগ করার কথা বললেন। তার আগে একটা লাইন ছিল “আউজুবিল্লাহি মিনাসশায়তোয়ানির রাজিম”—ওটা দেন নাই কেন?’ এ ধরনের প্রশ্ন তুলে তিনি বেশ সমালোচনা করেন। এরপর যাদু সিধু মিয়াকে টেলিফোন করে বলেন, ‘আমি তো যা বলার বলেছি। এখন তো আমার বাড়ি ঘেরাও। বাড়ি থেকে কাউকে বেরোতে দিচ্ছে না, কাউকে ভেতরেও আসতে দিচ্ছে না। যাদু মিয়াকে এভাবে তিন দিন রাখা হয়েছিল।’
যাদু মিয়া রেহাই পেলেন: জিয়া নিজে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে পাঁচ বছর (১৯৫৯-৬৪) ছিলেন। দল ভাঙা-গড়ায় তিনি গোয়েন্দা সংস্থাকে পদ্ধতিগতভাবে ব্যবহার করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ-সংক্রান্ত একটি তথ্য হাজির করেছেন সিধু মিয়া। তাঁর কথায়, ‘ওই ঘটনার সময় ডিজিএফআইয়ের প্রধান আমিনুল ইসলামের (এরশাদের প্রথম মন্ত্রিসভার যোগাযোগ উপদেষ্টা) পক্ষ থেকে একটা ফাইল দেওয়া হলো জিয়াউর রহমানের কাছে। তাতে যাদু মিয়াকে সামরিক আইনে গ্রেপ্তার করার কথা বলা হলো। জিয়া এরশাদসহ অন্যদের ডাকলেন। এরশাদ তখন ডেপুটি চিফ। মঞ্জুর ছিলেন সিজিএস। এরশাদ প্রথমেই নাকি বলেছিলেন (এটা যাদুর কাছ থেকে শোনা), “যাদু মিয়া আমার আত্মীয়। কাজেই আমি এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে থাকতে চাই না।” জিয়া এ কথা শুনে বলেছিলেন, “ইউ আর এক্সকিউজড।” এরশাদ উঠে চলে গিয়েছিলেন। মঞ্জুরের ওপর দায়িত্ব চাপে। মঞ্জুর বলেছিলেন, “যাদু মিয়া যে সামরিক আইন লঙ্ঘন করেছেন, সেটা আপনি কী করে জানলেন?” জিয়ার জবাব, “আমার কাছে টেপ আছে।” টেপ বাজানো হলো। টেপ শুনে দেখা গেল, সামরিক আইনকে তিনি আক্রমণ করেননি। জিয়াকেও তিনি ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেননি। এসব শোনার পর মঞ্জুর বললেন, “আমার ধারণা, মশিউর রহমান সামরিক আইনের কোনো ধারাই লঙ্ঘন করেননি। সুতরাং তাঁকে গ্রেপ্তার করার আমি কোনো যুক্তি দেখি না”।’
এক প্রশ্নের জবাবে আনোয়ারুল গনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাবা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কারণ গণভোট ছিল জিয়ার ব্যক্তিগত বৈধতার প্রশ্নের। এর সঙ্গে জাতীয় রাজনীতি ও গণতন্ত্রে উত্তরণের বিষয় ছিল না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হাজতে থাকাকালে ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের লোক জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। তবে কয়েক সপ্তাহ নয়, আমরা দুই ভাই ১১ দিন হাজতবাস করেছিলাম। দুইবার রিমান্ডে আনা হয়। আমার বিয়ের তারিখ স্থির ছিল। হাজতবাসের কারণে তা পিছিয়ে যায়।’
জিয়ার দুঃখ প্রকাশ: ওই সময় এনএসআইয়ের প্রধান ছিলেন এ বি এম সফদার। সিধু মিয়ার বিবরণ অনুযায়ী, ‘জিয়া ওই বৈঠকে সফদারকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার কী মত?” সফদার নাকি বলেছিলেন, “আমরা তো আগের সব খবর জানি স্যার। উনি তো আমাদের বন্ধু। হি ইজ অ্যা ফ্রেন্ড অব দি অথরিটি। আপনার সঙ্গে তো তাঁর অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। তাঁকে গ্রেপ্তার করার পক্ষে আমি পর্যাপ্ত ভিত্তি বা কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।” যাদু মিয়া সে-যাত্রায় রেহাই পান। এরপর গণভোট হলো। গণভোটে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একটি করে ভোট পড়ল। বিদেশি পত্রপত্রিকায় কঠিন সমালোচনা বেরোল। ২১ এপ্রিল, ১৯৭৭ জিয়া রাষ্ট্রপতির শপথ নেন। এরপর কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দিতে লন্ডনে যান। ফিরে এসে জিয়া যাদুকে ডাকেন। “ভাই, এবার আপনি ছাড়া কেউ আর আমার মানসম্মান রক্ষা করতে পারবে না। মানসম্মান বলতে আর কিছু নেই।” যাদু মিয়া বললেন, “কেমন করে করব?” জিয়া বলেছিলেন, “আমাকে জনসাধারণের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে দেন।” জিয়ার সঙ্গে তাঁর এসব কথা হলো অনেক রাত পর্যন্ত। তারপর সকাল ছয়টার দিকে যাদু মিয়ার ফোন পেলাম। ঈষৎ শঙ্কিত গলায় আমি বললাম, “কী হয়েছে তোমার?” বলল, “না, কিছু হয়নি। আপনি একটু আসেন।” আমি গেলাম। যাদু বলল, “জিয়া আমাকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি তো তাঁকে কথা দিয়ে এসেছি যে তাঁকে আমি জনসাধারণের সরাসরি ভোটে পাস করাব।” আমি বললাম, “কথা দিয়ে এসেছ, অথচ তুমি কি তা পারবে? তুমি একলা কথা দিয়ে এলে কেন? জিয়াউর রহমানকে জনসাধারণের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার ক্ষমতা কি তোমার আছে?” যাদু মিয়া বলল, “না, আমি পারব না বলেই আপনাকে খবর দিলাম। কথা যখন দিয়ে এসেছি, এখন বলেন, আমি কী করতে পারি”?’
স্টিফেন আইজেনব্রাউন তাঁর সাক্ষাৎকারে অবশ্য যাদু মিয়ার সাংগঠনিক সামর্থ্যের প্রশংসা করেন। আইজেনব্রাউনের কথায়, ‘যাদু মিয়ার কারণেই নতুন রাজনৈতিক দল বিএনপি ’৭৯-র নির্বাচনে ২০৮টি আসন পেয়েছিল।’
সবুর খানের কাছে ব্র্যান্ডি: সিধু মিয়া তাঁর ওই সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমরা একটা রাজনৈতিক রণকৌশল ঠিক করেছিলাম। আওয়ামী লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অংশটিকে আমি বলেছিলাম “সাইলেন্ট মেজরিটি”। তারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কিছু বলতেও সাহস পায় না। আবার তাকে সমর্থনও করতে পারছিল না। আমি বললাম, “এদের ডাকা যেতে পারে।’’ যাদু মিয়া আমাকে বলল, “আওয়ামী লীগ সামরিক বাহিনীর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই প্রস্তাবিত জোটে আওয়ামী লীগের সে রকমের কোনো প্রতিষ্ঠিত নেতা আসতে পারবেন না।” আমি বললাম, “তাহলে ব্যাপারটা হবে কী করে? তাদের বাদ দিয়ে কিছু হলে সেটা হবে অত্যন্ত দুর্বল কিছু।” যাদু মিয়া বলল, “মুসলিম লীগকে আনতে পারব।” আমি বললাম, “মুসলিম লীগ মানেই তো সবুর খান। তাঁকে তো বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করবে না।” তখন যাদু বলল, “একটা কাজ করা যায়, সবুর ভাইকে কিছু ভালো ব্র্যান্ডি-ট্র্যান্ডি দিয়ে তাঁর সঙ্গে আজ রাতেই একটু কথা বললে হয় না! তাঁকে যদি কিছুদিনের জন্য সরিয়ে দিতে পারি, আর শাহ আজিজকে মুসলিম লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট করতে পারি, অর্থাৎ দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে সবুর খান যদি সরে যায়, তাহলে শাহ আজিজ আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারে।” সবুর সাহেবের কাছে খুব ভালো ব্র্যান্ডি নিয়ে গেলেন যাদু মিয়া। আর রাতের মধ্যেই সবুর সাহেব দু-এক মাসের জন্য শাহ আজিজকে দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিয়ে দেশের বাইরে চলে গেলেন। এসব কিছু করার জন্য সব ধরনের টাকাকড়ির জোগান দিয়েছিল সরকার বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান। এ ঘটনার পরপরই শাহ আজিজ যাদু মিয়ার সঙ্গে যোগ দিলেন। এ ঘটনা ঘটেছিল “জাগদল” হওয়ার পর।’
উর্দু লেখা ও পায়ে হাঁটা: এভাবে একটা রাজনৈতিক মঞ্চ তৈরি হলো। এর মধ্যে কাজী জাফরও (বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায়) ভিড়লেন। যাদু মিয়া ন্যাপকে আনলেন। সিধু মিয়ার মতে, এই প্লাটফর্ম থেকেই জিয়াকে প্রেসিডেন্ট করা হলো। কারণ, তাঁরা জানতেন যে জিয়াউর রহমানকে প্রেসিডেন্ট করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। তাঁর একটা জনপ্রিয়তা ছিল এবং সত্যি বলতে কি, তাঁকে রাজনীতিবিদ বানানোর যে প্রক্রিয়া, সেটা ছিল খুবই মজার একটা ব্যাপার।
সিধু মিয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘জিয়া কিন্তু বাংলা লিখতে-পড়তে জানতেন না। তিনি শেষের দিকে যা কিছুতে সই করতেন, সেটা করতেন শুধু বাংলায় ‘জিয়া’ লিখে। আপনারা যদি তাঁর সই করা ফাইল ইত্যাদি দেখেন, তাহলে এ ব্যাপারটা লক্ষ করবেন। করাচিতে তিনি লেখাপড়া শিখেছেন। যৎসামান্য বাংলা বলতে পারতেন। প্রথম দিকে তিনি বাংলায় যে বক্তব্য দিতেন, সেগুলো প্রথমে বাংলা উচ্চারণে উর্দুতে লিখতেন। লিখে তারপর তা-ই দেখে দেখে ভাষণ দিতেন। যা-ই হোক, ব্যক্তি হিসেবে জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে কোনো বদনাম ছিল না। মানুষ তাঁকে পছন্দই করত। কিন্তু ভালো করে বক্তব্য দিতে পারতেন না। দিতে গেলে খালি হাত-পা ছুড়তেন। এসব দেখে-টেখে যাদু একদিন আমাকে বলল, “এ রকম হলে তাঁকে আমি কী করে চালিয়ে নেব?” আমি বললাম, দেখো, জিয়া বক্তৃতা দিতে পারে না ঠিক আছে। কিন্তু তিনি সবচেয়ে ভালোভাবে কী করতে পারেন, সেটা খুঁজে বের করো।’ জবাবে যাদু বলল, হাঁটতে পারে একনাগাড়ে ২০ থেকে ৩০ মাইল পর্যন্ত। আমি বললাম, এই তো পাওয়া গেল সবচেয়ে ভালো একটা উপায়। তুমি তাঁকে সঙ্গে নিয়ে পাড়াগাঁয়ে হাঁটাও। হাঁটাও আর যেটা পারে, তাঁকে দিয়ে সেটাই করাও। গাঁও-গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাবে আর মানুষজনকে জিজ্ঞেস করবে, কেমন আছেন? প্রেসিডেন্ট, দেশের সামরিক বাহিনীর প্রধান, তিনি গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে, কানা-কানচি দিয়ে ঘোরাঘুরি করছেন আর লোকজনের ভালোমন্দের খোঁজখবর করছেন, তাতেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন। এভাবে দেখতে দেখতে তিনি বক্তৃতা দেওয়াটাও রপ্ত করে ফেললেন।’
জিয়ার জনপ্রিয়তা: ওই সময় ক্রেইগ বেক্সটার ছিলেন মার্কিন দূতাবাসের পলিটিক্যাল কাউন্সেলর (১৯৭৬-৭৮)। আইজেনব্রাউনকে যাদু মিয়া যেসব তথ্য সরবরাহ করতেন, তা বেক্সটারও জানতেন। আইজেনব্রাউনের বস ছিলেন একদা সেনাবাহিনীতে থাকা বেক্সটার। তিনি পরে দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ (ইতিহাসে পিএইচডি, প্রফেসর ইমেরিটাস এবং আমেরিকায় বাংলাদেশ স্টাডিজ গ্রুপের দীর্ঘকালীন সভাপতি) হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ২০০৮ সালে বেক্সটার মারা যান। বাংলাদেশি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তাঁকে বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবেই গণ্য করেন। জিয়ার আমন্ত্রণে বেক্সটারও সেনানিবাসের বাড়িতে আতিথ্য নিয়েছেন। বাংলাদেশের সেনাশাসন ও রাজনৈতিক বিষয়ে তাঁর একাধিক বই এবং এক ডজনের বেশি নিবন্ধ রয়েছে। আইজেনব্রাউন তাঁর সাক্ষাৎকারে বেক্সটারকে তাঁর পেশাদারি কূটনৈতিক জীবনের প্রভাবশালী গুরু হিসেবে বর্ণনা করেন। বেক্সটার তাঁর একটি বইয়ে লিখেছেন, ‘মোশতাক ও সায়েম উভয়ে ’৭৬ সালের আগস্টে রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরুর অঙ্গীকার করেছিলেন। কারণ তাঁরা ’৭৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সামরিক বাহিনীর একাংশ ভেবেছিল, নির্বাচন দেওয়ার সময় হয়নি। সায়েম ক্ষমতা নিয়ে রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু ও নির্বাচন দিতে সক্রিয় হন। প্রায় ৬০টি দল অনুমোদনের জন্য দরখাস্ত করেছিল। প্রাথমিকভাবে ২১টি দলকে অনুমোদনও দেওয়া হয়। কিন্তু সায়েমের মতামত অগ্রাহ্য করে ’৭৬ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন স্থগিত করা হয়। সায়েম সিএমএলএ পদ থেকে ইস্তফা দেন। জিয়া সিএমএলএ হন। অনেক দল ও রাজনৈতিক নেতা নির্বাচন স্থগিত করার সিদ্ধান্তে আপত্তি করেন। এর মধ্যে মোশতাক ও তাঁর ডেমোক্রেটিক লীগও ছিল। মোশতাকের কিছু সহযোগী এ কারণে গ্রেপ্তার হন।’
মওদুদ আহমদের বর্ণনায়, ‘সায়েমকে মূলত প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।’ বিচারপতি সায়েম নিজেও তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘তিনি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা পরিত্যাগ করেননি।’ মওদুদ এটা সমর্থন করেন।
জেনারেল জিয়ার সামনে নতুন দল করা ছাড়া অন্য বিকল্প ছিল কি? এ প্রশ্নের জবাবে মওদুদ প্রথম আলোকে জানান, জিয়ার বড় সুবিধা ছিল তাঁর জনপ্রিয়তা। স্টিফেন আইজেনব্রাউনের কথায়, ‘প্রথম কথা হলো, দেশটি দরিদ্র ছিল। কয়েক বছর আগের যুদ্ধে দেশটি ছিল বিধ্বস্ত। চুয়াত্তরে দেশটি হলো দুর্ভিক্ষকবলিত। পঁচাত্তরে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের ফলে গোটা দেশ যন্ত্রণাক্লিষ্ট হয়ে পড়ে। দেশটি ধীরে ধীরে বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে সেরে উঠছিল।’ আইজেনব্রাউন এ অবস্থা থেকে উত্তরণে জেনারেল জিয়াকে অনেকটা কৃতিত্ব দেন। তাঁর কথায়, ‘জিয়া দৃঢ় প্রশাসক, উদারপন্থী, তাঁর নীতিগুলো ছিল যুক্তিপূর্ণ। উপরন্তু বাংলাদেশের জনগণকে তিনি তাঁর নেতৃত্বে শামিল করতে পেরেছিলেন।’ আবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্ন এড়িয়ে তাঁর সময়ের মার্কিন রাষ্ট্রদূত এডওয়ার্ড ই মাস্টার্সের জিয়া-বন্দনাকে তিনি সুনজরে দেখেননি। তবে জিয়ার জনপ্রিয়তা অর্জনের নেপথ্যের কারণ আইজেনব্রাউনের গুরু বেক্সটার বর্ণনা করেন এভাবে: ‘জিয়া প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করে দেশ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখতেন। তিনি সামরিক নেতা থেকে যেভাবে নিজেকে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে রূপান্তর করেছিলেন, তাতে বেশির ভাগ পর্যবেক্ষক বিস্মিত হন। পঁচাত্তরে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন। সামরিক প্রশাসনের বড় অংশ ছিল তাঁর অধীনে। এ ছাড়া স্বরাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয় ছিল তাঁর হাতে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে জাহির করার সুযোগ সীমিত। কিন্তু এটাও ঠিক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের সঙ্গে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের নির্ভরশীলতা রয়েছে।’
বেক্সটার লিখেছেন, ‘জিয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক ভাবমূর্তি গড়ে তোলেন। “স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী” হিসেবে পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ছিল তাঁর অধীনে। এর ফলে জিয়ার পক্ষে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখার সুযোগ ঘটে। জিয়া ক্রমশ রাজনীতিকের মতো আচরণ করেন। তিনি ব্যাপকভাবে সারা দেশ সফর করেন। তিনি সম্ভবত ফজলুল হক, মুজিবসহ অন্যান্য নেতার চেয়ে বেশি মাত্রায় গ্রাম-বাংলা সফর করেছিলেন।’ (কাল শেষ কিস্তি)

Click This Link
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×