somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দিনলিপি: ট্রেনষ্টেশনের টিকিট কাউন্টারে কি জ্যোৎস্নার টিকিট পাওয়া যায়!

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ভোর ৫:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এপ্রিল 1997,
পশ্চিম চান্দপুর,
গয়ামবাগিচা রোড, কুমিল্লা।
================
আলোকচিত্র:
জসীম অসীম: 1996: কুমিল্লা।

‘অমলকান্তি’ কবিতাটি আমাদের বাসার সবাই পছন্দ করে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী-র কবিতা। আসলে এই কবিতাটিতে করুণ এক গল্প রয়েছে। এই কারণেই এ কবিতার প্রতি আমাদের এমন ভালো লাগা। অমলকান্তির বন্ধু চমৎকার করে বলে এ গল্প। ইস্কুলে ‘অমলকান্তি’ রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারত না, শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে, দেখে ভারী কষ্ট হতো।
কিন্তু আমার ছোট ভাই পিয়াস খুব ভালো ছাত্র হয়েও এবং রোজ দেরি করে ক্লাসে না গিয়েও অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে। সেটা কি অমলকান্তির কথা মনে করে! অমলকান্তির বন্ধুরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিল, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল। কিন্তু আমাদের পিয়াস কী হতে চায়! কেন তার এ উদাসীনতা! অবাক হয়ে কেন সে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে! ‘অমলকান্তি’ মাষ্টার-ডাক্তার-উকিল হতে চায়নি। সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল! পিয়াসও কি তবে তেমন ভরা পূর্ণিমার জ্যোৎস্না হতে চায়! কেন সে মাকে ফাঁকি দিয়ে এমন দূরে হারিয়ে যায়! কেন সে মায়ের চোখের জল এভাবে ঝরায়! পিয়াস কি তবে ছবিই আঁকবে শেষে! মাষ্টার-ডাক্তার-উকিল কিছুই হতে পারবে না!

‘অমলকান্তি’ রোদ্দুর হতে পারেনি। সেই দুঃখে আমারই আরেক ছোট ভাই দামালও ভীষণ ভারাক্রান্ত হয়। ‘অমলকান্তি’ শেষে অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে। মাঝে মধ্যে আমারও মনে হয়, ‘অমলকান্তি’র মতো ছাপাখানায় কাজ করেই পিয়াস তার জীবনটা পার করে দেবে। তা না হলে স্কুলে পড়া কোনো বালক গোমতি নদীকে এত ভালোবাসে! প্রায়ই সে গোমতি নদীর সঙ্গে দেখা করতে যায়। তারপর আবারও মায়ের কাছে ফিরে। সে কি তাহলে ‘অমলকান্তি’ই হবে!

‘অমলকান্তি’ রোদ্দুর হতে পারেনি। সেই ‘অমলকান্তি’ রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে ভাবতে-ভাবতে যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। পিয়াসও কি শেষ পর্যন্ত জ্যোৎস্না হতে পারবে! নাকি রক্তখেকো ভয়ংকর সব রাক্ষসীরা তার জ্যোৎস্না খেয়ে ফেলবে! নাকি একদিন হঠাৎ করে সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে জ্যোৎস্না ধরে মায়ের কাছে ফিরবে! আমি শৈশবে মামার বাড়ির তেতুলগাছে উঠে ভূত দেখিনি কোনোদিনও। তবে রোদ্দুর আর জ্যোৎস্না দেখেছিলাম। সেই থেকে আজ অবধি শেষ রাতের ট্রেনে করে ঢাকা থেকে কুমিল্লায় ফেরার পথে আমি অন্ধকার রাতেও জ্যোৎস্না দেখতে পাই। এমনকি আমি কঙ্কালের ভিতরও জ্যোৎস্না দেখতে পাই। রাত হলেই তাই আমি ট্রেনষ্টেশনে চলে যাই বটগাছের চূড়ায় জ্যোৎস্না দেখবো বলে।
কিন্তু আমিও পারিনি জ্যোৎস্না ছুঁতে কখনো। অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি। আমিও পারিনি জ্যোৎস্না ছুঁতে। চাঁদ থেকে জ্যোৎস্না তো অনেক আগেই খসে গেছে। সেই অমলকান্তিও রোদ্দুরের কথা ভাবতে ভাবতে ভাবতে ভাবতে, যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। পিয়াসও কি শেষ পর্যন্ত জ্যোৎস্না হতে পারবে! পিয়াসও কি শেষে জ্যোৎস্নার কথা ভাবতে-ভাবতে ভাবতে ভাবতে যে এখন জ্যোৎস্না হতে চায়!
আমিও যেমন জ্যোৎস্নার কথা ভাবতে-ভাবতে ভাবতে-ভাবতে যে আমি জ্যোৎস্না হতে চেয়েছিলাম। তারপরও কেন রাত হলেই আমি গোমতি নদীর পারে কিংবা ট্রেনষ্টেশনে চলে যাই বটগাছের চূড়ায় জ্যোৎস্না দেখবো বলে? ট্রেনষ্টেশনের টিকিট কাউন্টারে কি জ্যোৎস্নার টিকেট পাওয়া যায়! যে আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখিনা, যে আমি শৈশবে চাঁদকেই ঈশ্বর ভেবে বড় হয়েছি, সে আমি কেন এখনও ঈশ্বরের বদলে জ্যোৎস্না খুঁজে মরি! কারণ শৈশবে চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝেও জ্যোৎস্নার দেখা পেতাম। ছিলো ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক।
আমার বাড়ি বরিশাল জেলার কীর্তনখোলা নদীর পাশেও যদি হতো, আমি তবু এই গোমতি নদীর কাছেই চলে আসতাম জ্যোৎস্নার খোঁজ করে করে। ছোটবেলা থেকেই আমি এমনই ছিলাম। কিন্তু কথা তো ছিলো আমাদের পরিবারে শুধু একজনই অমলকান্তি হবে। পিয়াস কেন আবার অমলকান্তি হতে চায় এখন! সে কেন এমন নদী ভালোবাসে! সে কেন জ্যোৎস্না হতে চায়! সন্ধ্যার পর গোমতি নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে আগেও একটু-আধটু জ্যোৎস্নার দেখা পাওয়া যেত। কিন্তু এখন আর জ্যোৎস্নার দেখা পাওয়া যায় না। আমিও পারিনি জ্যোৎস্না ছুঁতে তাই। কারণ চাঁদ থেকে জ্যোৎস্না তো অনেক আগেই খসে গেছে। আর নৌকায় বসে যে জ্যোৎস্না দেখে, সে কি আর মাস্টার-ডাক্তার-উকিল হতে পারে! তাই আমি পারিনি।
আমার বাবাও গিয়েছিলেন কতো কিছু করতে। পারেননি। অমলকান্তি শেষে অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে। আমি মনে হয় একটি ছাপাখানায়ও কাজ করতে পারবো না। মাঝে মধ্যে আমারও মনে হয়, অমলকান্তির মতো ছাপাখানায় কাজ করেও পিয়াস তার জীবনটা পার করতে পারবে না। যেমন পারছি না আমি। কারণ ছাপাখানার কাজও এত সহজ নয়। স্কুল জীবনেই আমি এই গোমতি নদীকে ভালোবেসেছিলাম। স্কুলে পড়া কোনো বালক গোমতি নদীকে যদি এত ভালোবাসে, তা হলে আর এই দেশে এই ছেলে কোনো কাজেই লাগে না। এমনকি অমলকান্তিও হতে পারে না। পিয়াস প্রায়ই গোমতি নদীর সঙ্গে দেখা করতে যায়। মাকে খুব একা করে না বলেও যায়। আর তার গোমতি নদী দেখে বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায়ই খুব সন্ধ্যা হয়ে যায়। ফেরার সময় সে হনহন করে হাঁটে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বর্বর সৈনিকদের মারবে বলে যেমন করে মুক্তিযোদ্ধারাও কখনো কখনো এমন হনহন করে হাঁটতো। কোনো কোনো ছাতিম অথবা হিজল গাছের পাশ দিয়ে।
ইস্কুলে অমলকান্তি রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারত না, শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে, দেখে তার কবি বন্ধু নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ভারী কষ্ট হত। কিন্তু পিয়াস খুব ভালো ছাত্র হয়েও এবং রোজ দেরি করে ক্লাসে না গিয়েও অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে। সেটা কি অমলকান্তির কথা মনে করে! অমলকান্তির বন্ধুরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিল, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল। কিন্তু পিয়াস কী হতে চায়! কেন তার এ উদাসীনতা! নাকি সে নদী হতে চায়! অবাক হয়ে কেন সে জানলার দিকে এমন তাকিয়ে থাকে! অমলকান্তি মাষ্টার-ডাক্তার-উকিল হতে চায়নি। সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল! পিয়াসও কি তবে তেমন ভরা পূর্ণিমার জ্যোৎস্না হতে চায়! কেন সে মাকে ফাঁকি দিয়ে এমন দূরে হারিয়ে যায়! কেন সে মায়ের চোখের জল এভাবে ঝরায়! পিয়াস কি তবে ছবিই আঁকবে শেষে! মাষ্টার-ডাক্তার-উকিল কিছুই হতে পারবে না!
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি। সেই দুঃখে আমারই আরেক ছোট ভাই দামাল এখনও ভীষণ ভারাক্রান্ত হয়। অমলকান্তি শেষে অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে। কিন্তু আমরা কি শেষে কোনো ছাপাখানায়ও স্থির হয়ে কাজ করতে পারবো! নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অমলকান্তির মতো! স্কুলে পড়া কোনো বালক গোমতি নদীকে কিংবা জ্যোৎস্নাকে যদি এত ভালোবাসে, তা হলে এই দেশে এই ছেলেরা আর কোনো কাজেই লাগে না। এমনকি অমলকান্তিও হতে পারে না। রাত হলেই তারা হয়তো ট্রেনষ্টেশনে যায় বটগাছের চূড়ায় জ্যোৎস্না দেখবে বলে। কিন্তু তারা পারে না জ্যোৎস্না ছুঁতে কখনোই। অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি। আমি এবং পিয়াসও পারিনি জ্যোৎস্না ছুঁতে। তাই। চাঁদ থেকে জ্যোৎস্না তো অনেক আগেই খসে গেছে।
সেই অমলকান্তিও রোদ্দুরের কথা ভাবতে ভাবতে ভাবতে ভাবতে, যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। পিয়াসও কি শেষে জ্যোৎস্নার কথা ভাবতে-ভাবতে ভাবতে-ভাবতে...যে এখনও জ্যোৎস্না হতে চায়! আমিও যেমন জ্যোৎস্নার কথা ভাবতে-ভাবতে ভাবতে-ভাবতে...যে আমি জ্যোৎস্না হতে চেয়েছিলাম। তারপরও কেন রাত হলেই আমি এখনও গোমতি নদীর পারে কিংবা ট্রেনষ্টেশনে চলে যাই বটগাছের চূড়ায় জ্যোৎস্না দেখবো বলে? ট্রেনষ্টেশনের টিকিট কাউন্টারে কি জ্যোৎস্নার টিকিট পাওয়া যায়! নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অমলকান্তি শেষে ছাপাখানার কাজটা কোনোরকমে করতে পেরেছিলো। রবীন্দ্রনাথ বিলাত গিয়েও ব্যারিষ্টার হতে পারেননি। অবহেলায়-অনাদরে-অবজ্ঞায় বেঁচে থাকা রবীন্দ্রনাথ শেষ জীবনে অবশেষে জ্যোৎস্না অথবা রোদ্দুরের দেখা পেয়েছিলেন। তাই রক্ষা পেলেন। কিন্তু আমি অথবা পিয়াস কিংবা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অমলকান্তি...আমরা কখনোই হতে পারবো না জ্যোৎস্না কিংবা রোদ্দুর।


সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:১১
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×