১৫ই আগস্ট সকালে আমাদের প্যারিসের উদ্দেশে রওনা দেয়ার কথা ছিল। এই কারণে ১৪ আগস্ট রাতে সানাউল হক সাহেবের বাসায় আমাদের জন্যে আনুষ্ঠানিক ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল । এক বেলজিয়াম নাগরিকের সঙ্গে বিবাহিতা এক বাঙ্গালী মহিলা বিজ্ঞানী ও তার বিজ্ঞানী স্বামীকেও দা ওয়াত করা হয়েছিল উক্ত ডিনারে। খাওয়া-দাওয়া শেষ হয় রাত দশটার দিকে। এরপর ব্রাসেলসস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারী আনোয়ার সাদাত আমাদের নিয়ে যায় তার বাসায় রাত সাড়ে দশটার দিকে। সেখানে পৌছেঁ হাসিনা বুজতে পারে যে, আনোয়ার সাদাতের স্ত্রী ওর স্কুলের সহপাঠিনী ছিল। রাত সাড়ে বারোটার দিকে আমরা আনোয়ার সাদাতের বাসা থেকে রাষ্ট্রদূত সানাউল হক সাহেবের বাসায় ফেরার জন্য উক্ত বাসার দোতলা থেকে নীচে নেমে আসি। যদিও আমি গাড়ীর সামনের আসনে বসেছিলাম, কিন্তু রেহানা-হাসিনার ফেছনের আসনে উঠে দরজা বন্ধ করার সময় আমার বাঁ হাতের সব কটি আঙ্গুল উক্ত দরজার ফাকেঁ আটকে পড়ে মারাত্মকভাবে পিষ্ট হয়। এ দুর্ঘটনায় আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে এটা সেটা ভাবতে থাকি। এক পর্যায়ে পরের দিন অর্থাৎ ১৫ই আগস্ট তারিখে প্যারিস যাওয়ার কর্মসূচী বাতিল করার প্রস্তাব করি। কিন্তু রেহানা ও হাসিনা আমার প্রস্তাবে রাজি হলো না।
১৫ই আগস্ট (১৯৭৫) শুক্রবার সকাল সাড়ে ছয়টায় ঘুম ভাঙ্গে ম্যাডাম রাষ্ট্রদূতের ডাকে। তিনি জানান যে, জার্মানীর বন থেকে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী আমাদের জন্য ফোন করেছেন। প্রথমে হাসিনাকে পাঠিয়ে দিই তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু দুই-এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এসে হাসিনা আমাকে জানায় যে হুমায়ুন চৌধুরী সাহেব আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। হাসিনাকে তখন ভীষণ চিন্তিত ও উৎকন্ঠিত দেখাচ্ছিল। আমি দ্রুত নীচে দোতালায় চলে যাই। তখন সেখানে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় মাথা হেঁট করে রাষ্ট্রদূত সাহেব ধীরে ধীরে পাঁয়চারি করছিলেন। আমাকে দেখেও তিনি কোন কথা বললেন না। ফোনের রিসিভারটি ধরতেই হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে বললেন, ''আজ ভোরে বাংলাদেশে 'ক্যু-দেঁ-তা' হয়ে গেছে। আপনারা প্যারিস যাবেন না। রেহানা ও হাসিনাকে একথা জানাবেন না। এক্ষুনি আমার এখানে বনে চলে আসুন'' প্রকৃতপক্ষে কি ঘটেছে'' এ কথা আমি তাকেঁ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ''এর বেশি আপাতত আমি আর কিছুই জানি না।'' এ কথা বলেই তিনি আমাকে ফোনের রিসিভারটি সানাউল হক সাহেবকে দিতে বললেন। অতঃপর আমি আস্তে আস্তে তিনতলায় আমাদের কক্ষে চলে যাই। সেখানে পৌঁছাতেই হাসিনা অশ্রুসজল কন্ঠে আমার কাছ থেকে জানতে চায় হুমাযুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে কি বলেছেন। তখন আমি শুধু বললাম যে, তিনি আমাদের প্যারিস যাওয়ার প্রোগ্রাম বাতিল করে সেদিনই বনে ফিরে যেতে বলেছেন। এ কথা বলেই আমি বাথরুমে ঢুকে পড়ি। সেখানে এটা সেটা ভাবতে থাবতে বেশ খানিকটা সময় কাটাই। ততক্ষণে রেহানা সজাগ হয়ে আমাদের কামরায় চলে আসে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই রেহানা ও হাসিনা দু'জনই কাঁদতে কাঁদতে বলে যে নিশ্চয়ই কোন দুঃসংবাদ আছে যা আমি তাদেরকে বলতে চাই না তারা আরও বলে যে, প্যারিসে না যাওয়ার কারণ তাদেরকে বলি যে, বাংলাদেশে কি একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে যার জন্য আমাদের প্যারিস যাওয়া যুক্তিসঙ।গত হবে না। একথা শুনে তারা দু'বোন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে, তাদের কান্নায় ছেলেমেয়েদেরও ঘুম ভেঙ্গে যায়।
১৫ই আগস্ট (১৯৭৫) সকাল সাড়ে দশটার দিকে আমরা বনের উদ্দেশে ব্রাসেলস ত্যাগ করি। পথে রেহানা ও হাসিনা সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আমরা বনের হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের বাসায় পৌঁছাই। সেদিন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন যুগোস্লাভিয়ায় সফর শেষে বাংলাদেশে ফেরার পথে প্রাংকফুর্টে যাত্রাবিরতি করে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের বাসায় উঠেছেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের স্ত্রী, ডঃ কামাল হোসেন ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তিনজন মিলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়া রেহানা ও হাসিনাকে ধরাধরি করে বাসার ভিতরে নিয়ে যান। ড্রইংরুমে এভাবে কিছুক্ষণ কাটানোর পর হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের স্ত্রী হাসিনাদের উপর তলায় নিয়ে যায়।
তখন ড্রইংরুমে ড. কামাল হোসেন, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও আমি ভীষণ উৎকন্ঠিত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও অন্যান্য রেডিও স্টেশন থেকে বাংলাদেশের তখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করতে থাকি। এরই এক ফাকেঁ আমি হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে ঘরের বাইরে নিয়ে গিয়ে তাঁর কাছ থেকে ১৫ই আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে চাই। নিরাপদ স্থানে না পৌঁছানো পর্যন্ত হাসিনাদের আমি কোন কিছু জানতে দেবো না এই শর্তে তিনি আমাকে বললেন, ''বিবিসি-এর এক ভাষ্যানুসারে রাসেল ও বেগম মুজিব ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই।'' এই পরিস্থিতিতে আমাদের কোথায় আশ্রয় নেয়া নিরাপদজনক হবে, তাঁর কাছ থেকে এ কথা জানতে চাইলে তিনি বললেন, ''উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একমাত্র ভারত ছাড়া আর কোন দেশ নিরাপদ নয়।''
পরদিন অর্থাৎ ১৬ই আগস্ট সকাল আটটার দিকে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করার জন্য ড. কামাল হোসেন বনস্থ বিমানবন্দরে যাবেন বলে আমাকে জানান। ড. কামাল হোসেন ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে আমিও গাড়ীতে উঠে বসি। বিমানবন্দরে ড. কামাল হোসেন ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী দু'জনে একত্রে কিছু গোপন আলাপ করেন। অতঃপর আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার মূহুর্তে আমি ড. কামাল হোসেন সাহেবের হাত ধরে তাকেঁ বললাম, '' খনদকার মোশতাক আহমেদ খুব আপনাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাখার চেষ্টা করবেন। অনুগ্রহ করে আমার কাছে ওয়াদা করুন যে, আপনি কোন অবস্থাতেই খন্দকার মোশতাক আহমেদের সঙ্গে আপোস করবেন না।'' আমার এই প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল হোসেন আমাকে বললেন, ''ড. ওয়াজেদ, প্রয়োজন হলে বিদেশেই মৃত্যুবরণ করতে রাজি আছি। কিন্তু কোন অবস্থাতেই খন্দকার মোশতাক আহমেদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আপোস করে আমি দেশে ফিরতে পারি না।'' এই কথাগুলো বলেই তিনি আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভেতরে চলে যান।
বিমানবন্দর থেকে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাসায় ফিরে হাসিনার কাছ থেকে জানতে পারি যে, ইতিপূর্বে লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই মোমিনুল হক খোকা (কাকা( ওদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। তিনি আমাদেরকে লন্ডনে তাঁর কাছে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এক সময়ে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর ছোট ভাই কায়সার রশীদ চৌধুরী তাকেঁ ফোন করেন। এই পরিস্থিতিতে খন্দকার মোশতাক আহমদের বিরুদ্ধে কোন কিছু না করার জন্য কায়সার রশীদ চৌধুরী তাকেঁ হুশিয়ার করে দেন। কায়সার রশীদ চৌধুরী রেহানা ও হাসিনার সঙ্গেও কথা বলে তাদেরকে সান্ত্বনা দেন। অতঃপর হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী রেহানা, হাসিনা ও আমাকে বলেন যে, লন্ডনে চলে যাওয়া সাব্যস্ত করলে আমরা সেখানে তাঁর বাসায় গিয়ে উঠতে পারি। তবে তিনি আমাদেরকে হুশিঁয়ার করে দিয়ে বলেন যে, সেখানে মাত্র একটি সমস্যা আছে। ঐ বাসার নীচতলায় কায়সার রশীদ চৌধুরী বসবাস করে এবং সে সে ভুট্টোর অন্ধভক্ত। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ১৫ই আগস্ট তারিখে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার ভুট্টো খন্দকার মোশতাক আহমদের সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন তাঁর সঙে।গ তৎব্যাপারে একাত্মতা ঘোষণা করার জন্য। যা হোক, ঐদিনই হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে কার্লসরুয়ে পাঠালেন সেখান থেকে আমার বইপত্র ও অন্যান্য ভারী জিনিষপত্র নিয়ে আসার জন্য।
আমি সেদিন কার্লসরুয়ে গিয়ে বনে ফিরে আসি রাত সাড়ে দশটার দিকে। কিন্তু সেদিন সাপ্তাহিক ছুটির কারণে অফিস বন্ধ থাকায় আমি কোন বইপত্র বা অন্য জিনিসপত্র আনতে পারিরি নি। রাত এগারোটার দিকে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তাঁর স্ত্রী ও আমাকে সঙ্গে নিয়ে নিজে গাড়ী চালিয়ে বাড়ীর বাইরে যান। পথে তিনি বলেন যে, একটি পূর্ব নির্ধারিত স্থানে ভারতীয় দূতাবাসের তাঁর পরিচিত একজন অফিসিয়াল আমার জন্য অপেক্ষা করে আছেন আমাকে তাদের স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যা হোক, উক্ত নির্ধারিত স্থানে পৌঁছার পর ভারতীয় সেই অফিসিয়ালের সঙ্গে তিনি আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমাকে তাঁর কাছে রেখে দ্রুত বাসায় ফিরে যান। ফিরে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে পরামর্শ দেন যে, তাদেঁর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শেষে রওনা হওয়ার সময় আমি যেন তাকেঁ ফোনে অবহিত করি।
অতঃপর ভারতীয় ঐ অফিসিয়ালের সঙ্গে আমি তাদেঁর রাষ্ট্রদূতের বাসায় যাই। তখন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ছিলেন এক মুসলিম জার্নালিস্ট। একটু ভয়ে ভয়ে আমাদের বিপর্যয়ের কথা আমি তাকেঁ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করি। আমার কথা শোনার পর তিনি আমাকে লিখে দিতে বলেন যে, আমরা ভারতীয় সরকারের কাছ থেকে কি চাই। অতঃপর তিনি সাদা কাগজ ও একটি কলম আমার হাতে তুলে দেন। তখ মানসিক দুশ্চিন্তা ও অজানা শঙ্কায় আমার হাত কাঁপছিল। যা হোক অতিকষ্টে রেহানাসহ আমার পরিবারবর্গের নাম উল্লেথপূর্বক সকলের পক্ষ থেকে আমি লিখলাম, শ্যালিকা রেহানা, স্ত্রী হাসিনা, শিশু ছেলে জয়, শিশু মেয়ে পতলি এবং আমার নিজের কেবলমাত্র ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও প্রাণরক্ষার জন্য ভারত সরকারের নিকট কামনা করি রাজনৈতিক আশ্রয়।''
১৭ই আগস্ট রোববার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সারাক্ষণ বাসায় ছিলেন। ঐ দিন লন্ডন থেকে আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগের নেতা ও বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় রেহানা ও হাসিনাকে ফোন করেন। এক সময় সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর পত্নী আমাদেরকে ফোন করে জানান যে, তিনি ঢাকায় তার স্বামীর সঙ্গে ইতিপূর্বে কথা বলেছেন এবং আশ্বাস দেন যে, আমাদের ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার কোন কারণ নেই। রাতে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমার কাছ থেকে জানতে চান যে, তিনি আমাদেরকে কিছু টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করতে পারেন কি না। আমি তাকেঁ জানাই যে, হাসনারা প্রত্যেকে মাত্র পচিঁশ ডলার সঙ্গে নিয়ে এসেছে। কার্রসরুয়ে গেস্ট হাউসে আমি রেহানার জন্য একটি পৃথক কক্ষ ভাড়া নিয়েছি। অতঃপর আমি তাকেঁ ফোন হাসনার সঙ্গে ঐ বিষয়ে আলাপ করার জন্য পরামর্শ দিই। তখন হাসিনার সঙ্গে আলাপ করে আমরা হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে জানাই যে, মাত্র হাজারখানেক জার্মান মুদ্রা দিলেই আমরা মোটামুটি চালিয়ে নিতে পারব।
সুত্রঃ Click This Link