আপনাকে যদি প্রস্তাব দেয়া হয় আপনাকে ২ ইউরো বিলিয়ন ডলার দেয়া হবে । কিন্ত এর বদলে আপনাকে প্রথম বিশ্ব থেকে সাগ্রহে কিনে নিতে হবে ক্যান্সারের জীবানু এবং মৃত্যুবরন করতে হবে একজন ক্যান্সারের রোগী হিসেবে । বিষয়টি কিভাবে দেখবেন আপনি । হয়ত ভাবছেন পোস্টের শুরুতে কি সব পাগলের প্রলাপ বকছি ।
কিন্ত ঘটনাটি সেরকমই ঘটতে চলেছে আমাদের বহুল প্রত্যাশিত ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে আয়োজিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে । ধারনা করে হচ্ছে এ যাবৎ বিশ্বে কোন সম্মেলনে এত অধিক সংখ্যক দেশের প্রতিনিধি এবং রাষ্ট্রের প্রধানরা অংশগ্রহন করেননি । প্রায় ১৭০ টি দেশ এবং প্রায় ৮০০০ জন পরিবেশবাদী সংগঠনের প্রতিনিধি, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারের প্রতিনিধি এবং পরিবেশ,সমাজ,আবহাওয়া ও জলবায়ু সংক্রান্ত সকল ক্ষেত্রের বিজ্ঞানী ও গবেষকরা এই সম্মেলনে অংশগ্রহন করছেন । সকলের মুখে এবং অন্তরে একই দাবী এই বিশ্বকে সকলের জন্য নিরাপদ এক আবাসভূমি হিসেবে গড়ে তোলা । কিন্ত এই সপ্ন এবং আশার মুখে পানি ঢালা হয়েছে অতন্ত্য ধীর স্থির এবং কৌশলের আশ্রয় নিয়ে ।
গত মংগলবার গার্ডিয়ান পত্রিকা ফাঁস করে দিয়েছে ডেনমার্ক প্রধানমন্ত্রীর তৈরী করা একটি গোপন খসড়া যা কিনা কিছু দিনের মধ্যেই সম্মলনে প্রস্তাবাকারে উথ্থাপন করার কথা ছিল । এই ড্রাফট পেপারের সারমর্ম যা ছিল তা অনেকটা এরকম
১। কৌশলে শক্তি বা বাধ্যকতা আরোপের মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে ধনতান্ত্রিক দেশ বা প্রথম বিশ্বের নিজেদের তৈরী করা কার্বন নিঃসরণের হারকে চাপিয়ে দেয়া ।
২। বেশী বিপদাপন্ন বা The most vulnerable country নামে আরেক টি বিশেষনের মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের গরীব দেশগুলোকে আরেকটি শ্রেনীতে ভাগ করা ।
৩। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ক অর্থলগ্নী খাতের মাধ্যমে জাতিসংঘের ভূমিকাকে দূর্বল বা সংকোচিত করা ।
৪। ২০৫০ সাল পর্যন্ত জনপ্রতি ১.৪৪ টনের বেশী কার্বন নিঃসরনের বাধ্যকতা আরোপ করা গরীব দেশগুলোর জন্য যেখানে এই কার্বন নিঃসরনের মাত্রা ধনী দেশগুলোর জন্য রাখা হয়েছে ২.৬৭ টন ।
এই ধরনের প্রস্তাবনা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো সাথে আলোচনা ছাড়াই এই খসড়াতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে যা সম্পূর্ন সম্মেলনের উদ্দেশ্য উপর চপটোঘাত ছাড়া আর কিছুই নয়।
এই বিষয়ে অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের জলবায়ু নীতিমালা বিষয়ক উপেদেষ্টা এন্টোনিও হিল এই খসড়া সম্পর্কে বলেন যে" যদিও এটা একটা খসড়া এখনও পর্যন্ত কিন্ত এখানে যা বলা হয়েছে সেটা একটা বিষয়ের উপর ঝুঁকি কে বাড়িয়ে তুলছে যে একটা বিষয়ের উপর ধনীদেশগুলো যখন এক হয় তখন সেটা শুধুই গরীব দেশগুলোর জন্য বেদনার কারন হয়ে দাড়ায় ।"
এছাড়া হিল আরো বলেন " এই জলবায়ু সম্মেলনের আর্থিক ক্ষতিপূরনের তহবিল গঠনের বিষয়টির ভার প্রস্তবনায় বলা হয়েছে বিশ্ব ব্যান্ক এবং গ্লবাল ইনভায়রনমেন্ট ফ্যাকাল্টি আয়ত্বে রাখা হবে যা আরেকটি চিন্তার বিষয় হয়ে দাড়াবে । কারন এই পদ্ধতির ফলে জাতিসংঘের প্রতক্ষ্য কোন ভূমিকা আর থাকবেনা এই ক্ষতিপূরন বিষয়ে একক সির্ধান্ত দেবার ।" ফলে অদূর ভবিষৎতে জলবায়ু বিষয়ক কোন নীতি জাতিসংঘ ঘোষনা দিলেও অর্থছাড়ের বিষয়টি থাকবে বিশ্বব্যান্ক তথা ধনীদেশগুলোর হাতে । সেইক্ষেত্রে জাতিসংঘের আর কোন কার্যকরী ভূমিকাই থাকবেনা এই জলাবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়ে । অর্থাৎ সোজা বাংলায় বিচার মানি কিন্ত তালগাছ আমার ।
ধনীদেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক শক্তি ,সামরিক শক্তি কে অক্ষুন রাখার জন্য যথেচ্ছার ভাবে পৃথিবীকে করবে কলুষিত এবং অবশ্যই নিজের দেশটিকে বাদ রেখে । আর সেটা কে হালাল করবার জন্য আর গরীব দেশগুলোর চোখে ঠুলি পরিয়ে আরো সামনের দিনগুলোতে কলুর বলদের মত ঘোরাবার জন্য আয়োজন করে এই ধরনের চমক ধাধাঁনো সার্কাসের আসর আর আমরা সেই কলুর বলদ অথবা সার্কাসের জোকারের মত সং সেজে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দাড়িঁয়ে থাকি কিছু পাওয়ার আশায় ।
গত অক্টোবরে সুযোগ হয়েছিলো সুইডেনের স্টকহোমে আয়োজিত ইউরোপীয়ান ডেভেলেপমেন্ট ডে সামিটে দর্শক হিসেবে যোগদানের । সেখানে উদ্বোধনী দিনে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন ভারতের প্রখ্যাত পরিবেশ এবং জ্বালানী বিষয়ক বিজ্ঞানী ডঃ রাজেন্দ্র কুমার পাচৌড়ী । তার নেতৃত্বে Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC) ২০০৭ সালে নোবেলে শান্তি পুরষ্কার লাভ করে ।তিনি বর্তমানে একই সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তিনি তার বক্তব্যে অতন্ত পরিষ্কার করে একটি কথা বলেছিলেন" যে একজন গবেষক একজন বিজ্ঞানী হিসেবে তার বা তার মত যারা এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের পক্ষে আর অবশিষ্ট কিছু করার মত আর বাকী নাই । তাদের কাজের ফলাফল এখন প্রকাশিত। সমস্ত সুপারিশমালা এখন বিশ্ব নেতৃবৃন্দের হাতে । এখন তাদের সির্ধান্তের উপরই পৃথিবীর ভবিষৎ নির্ভর করছে ।এখন আর সময় নাই আশ্বাসের ,সময় নেই পরিকল্পনার । এখন সময় একটাই সেটা হচ্ছে ধনী গরীব সব রাষ্ট্রের এক কাতারে, পৃথিবীকে পরিবেশ দূর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এক প্লাটফর্মে দাড়িয়ে বাস্তবমুখী কাজ করা । তিনি তার বক্তব্য শেষ করেছিলেন মহাত্মা গান্ধীর এক স্মরনীয় বানী দিয়ে তিনি বলেছিলেন "গতি অর্থহীন যখন সেই গতির কোন গন্তব্য নেই" ।
তাই এই পৃথিবী যে সুপারসনিক গতিতে এগিয়ে চলছে সেই পৃথিবীর বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা আর প্রযুক্তির লক্ষ্য যদি পৃথিবী এবং তার মানুষের সামগ্রিক উন্নতি বিধানের না হয় তাহলে সেই গতির আসলে কোন মূল্য নেই ।
আবার ফিরে আসি কোপেনহেগেনের সম্মেলনে । সবশেষে যে বিষয়টি এখন আলোচিত সেটি হচ্ছে বৈশ্বয়িক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত রাখার বিষয়ে ধনী এবং গরীব দেশগুলোর মাঝে টানপোড়েন । এখানে আসলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বিষয়টি পরিমানে সামান্য মনে হলেও এর সাথে জড়িয়ে আছে সমুদ্রে উচ্চতা বৃদ্ধি এবং মালদ্বীপ এবং ক্যারাবীয়ান দ্বীপ দেশগুলোর তলিয়ে যাবার বিষয়টি । তাই এই ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর দাবী এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ এর বদলে ১.৫ এর বেশী রাখা যাবেনা । এবং গত ১০ ডিসেম্বর ০৯ বিশ্বের আর্ধেক দেশসমূহ তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস প্রস্তাবটি একযোগে নাকচ করে দিয়েছে।
সবশেষে আরেকটি বিষয় সেই গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত খসড়ার মাঝে অন্তর্ভূক্ত ছিল ক্ষতিপূরনের পরিমানের বিষয়টি । এই প্রস্তবনায় ইউরোপের দেশ সমূহ থেকে ২ বিলিয়ন ইউরো ডলারের কথা বলা হয়েছে ।যার পরিমান ডলারে দাড়ায় প্রায় ১০ বিলিয়নে । কিন্ত এই প্রস্তবনার সমালোচনা করে একজন চীনা প্রতিনিধি বলেন এই পরিমান সংখ্যার দিক হতে বেশী মনে হলেও এই সংখ্যাকে বিশ্বের জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে প্রতিজনের ভাগে পড়ে মাত্র ২ ডলার যা দিয়ে উন্নত বিশ্বে এক কাপ কফি পর্যন্ত খাওয়া যাবেনা ।
অথচ এই টাকার সংখ্যাকে মিডিয়ার প্রচারে কতইনা লোভনীয় ভাবে তুলে ধরা হচ্ছে আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কাছে । এই সম্মেলনের শুরুতে কিছুটা আশাভংগের আশংকা থাকলেও সবার মনে ছিলো নতুন কিছু একটা হবার অথবা পাওয়ার । এই চাওয়া পাওয়ার মাঝে নেই কোন স্বার্থপরতা বরং ছিল সমগ্র মানবের জন্য এক সুন্দর আবাসভূমি গড়ার । কিন্ত আয়োজক দেশের প্রধানমন্ত্রীর গোপন খসড়া যেন সব আশা ভরসার উপর ছাই ঢেলে দিয়েছে । এ কোন বিশ্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা । এই একই সপ্তাহে অবাক বিস্ময়ে দেখলাম পৃথিবীর সবচাইতে মানবতার বিরুদ্ধে যেই দেশটি একের পর এক অত্যাচারের ইতিহাস গড়ে তুলছে সেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে দেয়া হচ্ছে নোবেল শান্তি পুরষ্কার । যেই সম্মেলনে আয়োজকরা শুনালেন এতদিন আশার বানী আজ তারাই মুখোশের আড়ালে তারা তাদের মসনদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত রাখার জন্য ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলেছে যার প্রমান সেই গোপন খসড়া। থলে থেকে বেরিয়ে পড়ছে সেই ইতিহাসের পুরোনো ঔপেনবেশিক ভুত ।
আমরা কোন পৃথিবীতে রেখে যাচ্ছি আমাদের অনাগত এবং আগত এই প্রজন্মকে ? এই প্রশ্ন আজ কম বেশী সবার মনে কিন্ত উত্তর কারো জানা নেই ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:১৯