somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার নোটবুকে বাসুদেবপুর মাদ্রাসা আর একটি যুদ্ধ

২৪ শে জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



গভীর রাতে একটানা বর্ষার বৃষ্টিতে সামনে বসা বৃদ্ধ লোকটির চোখ দেখে মনে হচ্ছিলো ৪০ বছর আগে সেই একাত্তরের এক নবীন যোদ্ধা কৃষক যেন বসে আছে আমার সামনে। কিছুক্ষন আগে আমার প্লাটুনের সৈনিকদের নিয়ে সেনাবাহিনীর গ্রীষ্মকালীন মহড়া অংশ হিসেবে প্রায় ২০ কিঃমিঃ পথ অতিক্রম করে , এই অজানা এক বাসুদেবপুর মাদ্রাসায় শত্রুর রসদ সরবরাহ কেন্দ্রের উপর রেইড অপারেশন কমান্ডার হিসেবে পরিচালনা করলাম। গভীর রাতে শত্রুর চোখ কে আড়াল করার জন্য প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে প্রায় ৭০০ গজের মত পথ কখন ধানক্ষেত কখনওবা সরু নালা অতিক্রম করতে হয়েছে ক্রলিং করে ,ফলে সারা ইউনিফর্ম কাঁদা পানিতে একাকার আমার সাথে আমার সৈনিকদের অবস্থা একইরকম। কিন্ত রেইড অপারেশনটি বেশ সফলতার সাথে আমরা পরিচালনা করতে পেরেছি বলে সবাই বেশ উৎফুল্ল এবং ক্লান্ত ও বটে।

অপারেশনের মহড়া শেষে মাদ্রাসার মাঠের কোনে চাপকলের পানিতে টিপ টিপ বৃষ্টির মাঝে ইউনিফর্মের কাঁদা পানিতে ধুঁয়ে নিচ্ছিলাম ঠিক তখনই বৃষ্টির মাঝে এই বৃদ্ধের আবির্ভাব। হাতে ধরা হারিকেন আর আরেক হাতে পানি ভর্তি জগ ছাতাটা কৌশলে ঘাড়ের মাঝে চেপে রেখে বৃদ্ধ স্মিত একটি হাসি দিয়ে বললেন " বাজান মনে কিছু নিয়েননা আপনি এই ধানক্ষেত পুরোটা ক্রলিং করে এসেছেন অনেক কষ্ট হইসে একটু পানি খান "। কিছুটা অবাক হলাম অশীতিপর এই বৃদ্ধের মুখে সামরিক শব্দ ক্রলিং কথাটা উচ্চারিত হতে। আমার অবাক হওয়া দেখে সাথে সাথে বৃদ্ধটি বলে উঠলেন তার হারানো যৌবনের কথা ,।

অনেক দিন আগে সেই একাত্তরের টালমাটালের ঢেউ যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে তখন এই দিনাজপুরের চিলিরবন্দর পুলিশ থানা দখল করে নিয়েছে হানাদার বাহিনী আর তার সাথে যোগ দিয়েছে আলবদর আর রাজাকাররা । ঠিক তখনই এই বৃদ্ধের গ্রামে হাজির হলেন পশ্চিম পাকিস্তান এর সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা এক বাংগালী সৈনিক যার গ্রাম ছিলো এই বাসুদেব পুর ,,,,,,,। তার নাম ছিলো মোতালেব ,,,,,;;'',,,,। এই বীর সেনানী গ্রামে এসে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করলেন দিনাজপুরের এই চিলির বন্দরে থানা হামলা করার জন্য। এই থানার চারপাশে তখন ব্যান্কার খুঁড়ে শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছে হানাদার বাহিনী। আর আওটার পেরিমিটারে শক্ত পাহারায় আছে রাজাকার আর আলবদরের সদ্যসরা । এই বীর সেনানীর নেতৃত্বে তখন আমার সামনে বসা এই বৃদ্ধ সেদিনকার যুবক কৃষক স্বল্পকালীন ট্রেনিং এর উপর ভরসা করে আর ৫০০ জনের মত গ্রামবাসীরা হামলা করেছিলো সেই চিলির বন্দর থানা । প্রথমেই কোন বাধা না দিয়ে বরং সব রাজাকার আর আলবদররা আত্মসমর্পন করে মুক্তিবাহিনীর কাছে । কিন্ত তুমুল বৃষ্টির মত গোলাগুলির মাধ্যমে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলে থানার চারপাশে ব্যান্কার থেকে হানাদার বাহিনী।

বৃদ্ধ গভীর রাতে সেই মাদ্রাসার বারান্দায় তখন ও বলে চলেছে সেই ৪০ বছরের আগের ইতিহাস আর আমি সাথে কজন সৈনিক মন্ত্রমুগ্ধের মত তার কথা শুনছিলাম। বৃদ্ধ বললেন আমাদের গ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ সেই সৈনিক মোতালেব সবার সামনে বলে উঠলেন আমি জীবিত থাকতে আমার গ্রামে কোন হানাদার বাহিনীকে থাকতে দিবোনা এই বলে দুহাতে দুই গ্রেনেড নিয়ে তুমুল বৃষ্টির মত গোলাগুলীর মাঝে অকুতোভয় সেই বীর সেনানী শত্রু হানাদারদের ব্যান্কারের নিকটে গিয়ে একটি গ্রেনেড চার্জ করে আর অপর গ্রেনেডটি চার্জ করার আগে এক ঝাঁক বুলেট এসে তার বুকে এসে আঘাত করলে সাথে সাথে সেখানেই সেই বীর সেনানী শাহাদাৎ বরন করেন । তার লাশ যেন শত্রুরা কেড়ে নিতে না পারে সেজন্য কজন গ্রামবাসী এগিয়ে গেলে তারাও হানাদারদের বুলেটে শহীদ হন। অবশেষে দারুন এক সংগ্রামের মাঝে শেষ হয় সেদিনকার থানা দখলের যুদ্ধ ।

যে বীর সেনানীর প্রেরনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এই বিজয় অর্জিত হয় সেই বিজয় আর দেখা হয়ে উঠেনি সেই সৈনিকের । চোখ ছলছল দৃষ্টিতে বৃদ্ধ বয়সের অনিয়ন্ত্রিত আবেগে কাঁপা কাঁপা হাতে বৃদ্ধ মাদ্রাসার পেছনে বটগাছের কোনায় গভীর অন্ধকারে সিমেন্ট দিয়ে বাধাঁনো কবরটি দেখিয়ে বলে উঠলেন ঐ যে ওখানে শুয়ে আছে আমাদের গ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ সৈনিক মোতালেব । তাকিয়ে দেখতে পেলাম কবরটি আর সাথে সাথে মনে পড়লো এই কবরের পাশ দিয়ে কিছুক্ষন আগেই আমি ক্রলিং করে আসছিলাম রেইড করার জন্য।
ভাবতেই মনটা এক অদ্ভুত আনন্দে ভরে উঠলো যে প্রশিক্ষন গ্রহনকারী এক যোদ্ধা তারই এক পূর্বসূরী বীর যোদ্ধার কবরের পাশ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশকে শত্রু মুক্ত রাখার দৃপ্ত শপথে। হৃদয়ের অন্তঃস্হল থেকে গভীর শ্রদ্ধা জানালাম চিলির বন্দর থানা দখলের সেই যুদ্ধের শাহাদাৎ বরনকারী সেই বীর সেনানী আরো নাম না জানা অসংখ্য বীর যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে।

তখনও বৃদ্ধ বলে চলেছেন তার আগুন ঝরানো সেই দিনগুলির কথা আর কথা মাঝে এই অশীতিপর কৃষক বৃদ্ধের মুখ থেকে শুনছিলাম আমাদের সামরিক জীবনের বহুল ব্যবহৃত পরিচিত শব্দ এল এম জি, এস এল আর , ট্রেন্চ ক্রলিং এরকম আরো অনেক শব্দ। বৃদ্ধ বলে উঠলেন "বাজান আপনাদের এই যুদ্ধের মহড়া দেখে আমার সেই একাত্তরের সেই দিনগুলির কথা মনে পড়ায় ছুটে এসেছি আপনাদের কথা বলতে আর আপনাদের একটু পানি খাওয়াতে। ৪০ বছর আগের সেই যোদ্ধার হাতে নতুন প্রজন্মের আরেক যোদ্ধা হিসেবে যেন তার হাত থেকে পানি নয় বরং দেশকে আরো বেশী করে ভালোবাসবার তৃষ্না নিবারনকারী সুধা পান করলাম । কিছুক্ষন পর আমার সৈনিকরা প্রস্তুত হয়ে রিপোর্ট করলো নিজেদের ফার্মবেস এ ফেরত যাবার জন্য । আমিও প্রস্তত হয়ে নিয়ে পিঠের উপর হ্যাভারস্যাক চাপিয়ে এসএমজিটাকে ক্রস করে নিলাম সামনে । আমি বিদায় নিলাম সেই বৃদ্ধের কাছ থেকে , বললাম দোয়া করবেন চাচা আমাদের জন্য আর এই দেশটার জন্য । উনি হাত তুলে বিদায় জানালেন । আমরা দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে চললামা আমাদের গন্তব্যস্থানের দিকে।

পেছন ফিরে আর একবার দেখার চেষ্টা করলাম , দেখি সেই বৃদ্ধ এখনও দাঁড়িয়ে আছে হারিকেন হাতে বাসুদেবপুর মাদ্রাসার মাঠের কিনারায় , তার হারিকেনের আলোয় তার ছায়াটা যেন এক অশারীরির ন্যায় মনে হচ্ছে । ভোর হয়ে আসছে কিছুক্ষন আগে বৃষ্টি থেমে গেছে ,আকাশের মেঘ কেটে যাচ্ছে শেষ রাতের চাঁদ উঠেছে আকাশে। চাঁদের মায়াবী আলোয় ভেজা ইউনিফর্মে আমরা বাসুদেবপুর গ্রামের মেঠোপথ ধরে এগিয়ে চলেছি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক ক্ষুদ্র সেনাদল অগ্রভাগে আমি । সারা আকাশ জুরে চাঁদের আলোয় যেন চারিদিক ভেসে যাছ্চে আলোর বন্যায় ,,,,। দূরে এক বাঁশঝাড় থেকে রাতের পাখি থেকে থেকে ডেকে উঠছে । আমার মন এখনও যেন বাঁধা পড়ে আছে বাসুদেবপুর মাদ্রাসায় সেই বৃদ্ধের কাছে । আর মরা খালের সেই কিনায়ার বটবৃক্ষের ছায়ায় সেই শানবাঁধানো কবরের কাছে ,,। যেখানে শুয়ে আছে নীরবে নিভৃতে এই বাংলার একা দামাল বীর সেনানী মোতালেব যে একদিন ভালোবেসে গ্রেনেড নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো দেশকে স্বাধীন করতে ।

আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি

স্থানঃ বাসুদেবপুর,
চিলির বন্দর দিনাজপুর
সময়ঃ রাত ০৪৩০
তারিখঃ ২০ জুন ২০১১
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:০৬
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×