এক প্রতিবেশী সেদিন আমাদের এলাকায় একটা নতুন বাংলাদেশী মাংসের দোকানের খোঁজ দিলেন। রাষ্ট্রভাষায় 'বুচার শপ'। সময় করে একদিন গেলাম। প্রবাস জীবনে নতুনত্বের অভাব মেটাতে, মতান্তরে এডভেঞ্চারের জোগান বাড়াতে নতুন 'দেশী' মাংসের দোকানও সই।
সারি সারি তীর্যক কাঁচের দেয়ালের ওপাশে নানা রঙের পশু-পাখীর মাংস, পাশে রক্তের মত লাল অক্ষরে দাম লেখা। আমি সেখানে দাঁড়াতেই দোকানী বলে উঠলেন, 'লে লো ভাইয়া, আজ ল্যাম্ব বহুত ফ্রেশ হ্যায়'।
এডভেঞ্চারই বটে। অথবা শক থেরাপি বলা যায়। বাংলাদেশী দোকানের নাম শুনে অনেকটা পথ মাড়িয়ে এসে এই মধুর সম্বোধন। অবশ্য এখানে হিন্দীভাষীদের সংখ্যাটা অন্যান্য সকল ভাষার অভিবাসীদের সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও বেশী। ফলে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয় মোটেই, অন্ততঃ ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোন থেকে। শুধু যে হিন্দীভাষীরাই হিন্দী বলেন, তা নয় - উর্দুভাষীরা বলেন, তামিল-তেলেগু-মালয়লাম-কানাড়াভাষীরা বলেন, গুজরাটী-পাঞ্জাবী-নেপালীভাষীরা বলেন, আর দুই বাংলার বাংলাভাষীরা তো এমনি এমনিই বলেন। এই তল্লাটে দক্ষিন এশিয় প্রবাসীদের লিংগুয়া ফ্রাংকা হলো হিন্দী। এখানে বাংলাভাষীদের সংখ্যা অনেকটা বাংলাদেশে চাকমাভাষীদের সংখ্যার সাথে তুলনীয়। ধরলেই ধর্তব্য, তবে না ধরাটাই কর্তব্য।
আমি হাসিমুখে দোকানীকে পালটা প্রশ্ন করি, রাষ্ট্রভাষায়, 'তুমি কি পাকিস্তানের লোক, পেশোয়ার জালমি'র সাপোর্টার?' ভাবখানা এমন, যেন তার চেহারায় চাঁদ-তারা খোদাই করা আছে। আমার ইংগিতপূর্ণ প্রশ্নে সে সচকিত হয়, অপ্রস্তুতভাবে হাসে। অবশ্য বেশীক্ষণ সময় লাগে না আমাদের বাংলায় অবতীর্ণ হতে। অতঃপর 'দ্যাশের কি অবস্থা আজকাল', 'লইট্যা শুঁটকি নতুন আসছে', ইত্যাদি আলাপে মগ্ন হই আমরা।
ওদিকে আমার ছেলেরা এলাকার আরেক দেশী দোকানের মালিকের নাম দিয়েছে 'বাংলা আংকেল', যেহেতু বাসার বাইরে এই এক জায়গাতেই তারা দু'চার কলম বাংলা বলে। তবে সেই বাংলাটা হয় খিচুড়ী বাংলা - আমি উত্তরবঙ্গীয় টানে আধা-ঢাকাইয়া মেশানো বাংলা চালাই, আর দোকানদার তার ময়মনসিংহের বাংলার সাথে জি-বাংলা মেশায়ে চালায়ে দেন। দুইজনের বুলিতেই প্রচুর রাষ্ট্রভাষার মিশেল, অনেকটা বোম্বের ফিল্মস্টারদের হিংলিশের মত। ছেলেরা পানির মাছ ডাঙ্গায় তুললে যেমন অবস্থা হয়, সেই অবস্থায় পড়ে আমাদের কিম্ভুত ভাষার চাপে। তবে যেহেতু আমি এবং 'বাংলা আংকেল' দু'জনেই ভাষার ক্ষেত্রে 'ফারুকী স্কুল অফ মডার্ণ চলিত ভাষা'র সমর্থক, সেখানে আমার অবাংলাভাষী ছেলেদের এই সামান্য অসুবিধার কথা আমাদের হিসেবের বাইরে থেকে যায়।
এলাকায় একটা নতুন ছেলে এসেছে দেশ থেকে। শুনেছি, সে নৌকায় চেপে এসেছে রোহিঙ্গাদের সাথে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগড় পাডি দিয়ে। ভারতীয়দের মালিকানাধীন কফি-চকোলেটের দোকানে গিয়ে হঠাত আলাপ হলো। দেখলাম, যে ছেলে দেশে হাইস্কুল পাশ করে নি, জীবিকার তাগিদে নানা রকমের শ্রমসাধ্য কাজ করেছে এবং করছে, সে এখানে এসে কাজ পেয়েছে তার হিন্দী ভাষার উপরে দখলের কারণে। ভাষার এমনই তাকত।
প্রবাসে ভাষার বাঁশে ভালই আছি। তবে চান্স পেলেই ভারতীয় সেই কফির দোকানে ঢুঁ মারি - অনেকটা ফেসবুকের কোন ইভেন্টে চেক-ইন দেওয়ার মত। আজাইড়া। সেই দেশী ছেলেটির সাথে দেখা হলে বলি, ভাইজান, কফিতে ঠিকমত চিনি দিতেছেন তো? না হলে মিষ্টি হবে ক্যামনে? সে বলে, ভাই আপনে মাঝে মইধ্যে আইসা আমারে একটু চিনি মিশাইয়া দিয়া যাইয়েন। এইখানে সব ইন্ডিয়ান কাস্টমার, হিন্দী বলতে বলতে বাংলা ভুইলা যাইতেছি।
আমি মনে মনে বলি, বাংলা ভুলবেন, সে কি এত সহজ কথা নাকি? বললেই হলো? বিদেশে থাকেন আর স্বর্গ-নরকে যান, সেটি আর হচ্ছে না। জন্ম যদি তব বঙ্গে, তবে বাংলাভাষা হলো আপনার 'হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া'। You can check-out any time you like, But you can never leave.
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৪৭