somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ওহ জেরুজালেম !

২৬ শে মার্চ, ২০১৫ রাত ১১:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


জেরুজালেম! সভ্যতার ইতিহাসে এক বিস্ময়কার নাম! সভ্যতার ইতিহাসকে জেরুজালেম যতটা নাড়া দিয়েছে আর কোন শহর তা পারেনি। ইহুদী, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের হৃদয়ে ঝংকার তুলে এই নাম- জেরুজালেম!

ইহুদী হৃদয় নিংড়ে এ শহরের জন্য ধ্বনিত হয় প্রার্থনার স্তোত্র “জেরুজালেমের শান্তির জন্য প্রার্থনা করো।” জেরুজালেম ইহুদীদের হৃদয়ে যেভাবে স্থান দখল করে আছে একইভাবে স্থান দখল করেছে খ্রিস্টানদের হৃদয়ে। এমনকি মুসলমানদের হৃদয়েও। এটা সেই শহর যা পৃথিবীর এতো বেশি বৈদেশিক শক্তির পদানত হয়েছে যা আর কোন শহরের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।

এ শহরের পতন হয়েছে প্রাচীন জিবুসাইটসদের হাত থেকে ইহুদীদের রাজা দাউদের হাতে, ইহুদীদের হাত থেকে ক্যালদীয় সম্রাট নেবুচাদনেজারের হাতে, ক্যালদীয়দের হাত থেকে পার্সীয় সম্রাট সাইরাসের হাতে, পার্সীয়দের হাত থেকে মেসিডোনীয়দের হাতে, মেসিডোনীয়দের হাত থেকে রোমানদের হাতে। এক সময় রোমান শাসকদের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের ফলে জেরুজালেমে প্রতিষ্ঠিত হয় খ্রিস্টান কর্তৃত্ব। রোমান-খ্রিস্টান কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে এক সময় জেরুজালেম পদানত হয় খলীফা উমরের মুসলিম সেনাবাহিনীর কাছে। এটা সেই শহর যাকে হাজার হাজার বছর ধরে ইহুদীরা নিজেদের মাতৃভূমির ভালোবাসায় সিক্ত করে রেখেছে। ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে তারা নিপীড়িতও হয়েছে তাদের আপন শহর জেরুজালেমেই। এমনকি খ্রিস্টানরাও নিপীড়িত হয়েছে তাদের ভালোবাসার এই শহর জেরুজালেমেই।

রোমান সম্রাট কনস্টানটাইন খ্রিস্টান ধর্মকে গ্রহণ ও স্বীকৃতি প্রদানের পূর্বে জেরুজালেমের ইহুদী ও খ্রিস্টানরা রোমান প্যাগান শাসনকর্তাদের হাতে ভয়ানক নিষ্ঠুরভাবে নিপীড়িত হয়েছিল। ৩১৩ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট কনস্টানটাইন খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণের পরে রোমান সম্রাজ্যের খ্রিস্টানদের জীবনে স্বস্তি ফিরে এলেও ইহুদীরা ছিল জীবনের নিরাপত্তা ও শান্তি থেকে বঞ্চিত। ৩৯১ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট থিওডোসিয়াস খ্রিস্ট ধর্মকে রাজধর্ম ঘোষণা করার পরে খ্রিস্টধর্ম আগ্রাসী রূপ ধারণ করে ঝাপিয়ে পড়ে ইহুদীদের ওপর। রোমান প্যাগান শাসকরা আগে যে কায়দায় ইহুদী নিধনযজ্ঞ চালাত খ্রিস্টান যাজকরা রাজশক্তির মদদে সেই একই কায়দায় ধর্মের ফণা উচিয়ে ইহুদীদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছে ছোবল মারার জন্য।

খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের কাছাকাছি সময়ে রাজা দাউদের নেতৃত্বে ইহুদীরা কেনানীয় গোত্রের শাখা জিবুসাইটসদের হাতে থেকে জেরুজালেম দখল করেছিল। দাউদের পুত্র সোলায়মানের (সলোমন) সময় স্বাধীন ইহুদী রাজ্য সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌছে গিয়েছিল। সলোমনের মৃত্যুর পর ইহুদী জাতি দু’ভাগ হয়ে দুটি আলাদা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে- ইসরাইল ও জুডা। এর ৩০ বছর পরে অ্যাসিরীয়রা ইসরাইলের রাজধানী সামারিয়া দখল করে নিলে ইতিহাস থেকে এই রাষ্ট্রটি চিরতরে হারিয়ে যায়, থেকে যায় জুডা। জুডার রাজধানী জেরুজালেম। দাউদ ও সোলায়মানের সময় থেকে শুরু করে জুডা রাজ্য যতদিন স্বাধীন ছিল- সেটাই ছিল ইহুদী জাতির সাড়ে তিন হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে সোনালী সময়। এই কয়েকশ বছর তারা নিরংকুশ স্বাধীনতা ভোগ করতে পেরেছিল। কিন্তু এক সময় তাদের এই স্বাধীনতা মধ্যপ্রাচ্যের উদীয়মান শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলোর কাছে শেকলবন্দী হয়ে পড়ে।

ক্যালদীয় সাম্রাজ্যের অধিপতি নেবুচাদনেজার খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে জুডার রাজধানী জেরুজালেম দখল করে হাজার হাজার ইহুদীকে শেকলবন্ধী করে নিয়ে যান তার রাজধানী ব্যাবিলনিয়ায়। সেখানে তারা পরিণত হয় ভূমিদাসে।

খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ সালে পারস্য সম্রাট সাইরাস দ্যা গ্রেট ক্যালদীয় সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে মধ্যপ্রাচ্যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তার দয়ায় কিছু ইহুদী জেরুজালেমে ফেরার অনুমতি পায়। ৪৯ বছর পরে জেরুজালেমে ফিরে এসে তারা মুসার বাণী লিপিবদ্ধ করার কাজে হাত দেয়। মুসার মৃত্যুর প্রায় ৭৬৩ বছর পরে লোক পরম্পরায় চলে আসা মুসার বাণীর ভেজালমিশ্রিত অপভ্রংশের সাথে ধর্মবেত্তাদের নিজেদের সুবিধামত চালু করা বিধি-বিধান মিশিয়ে শুরু হয় ওল্ড টেস্টামেন্ট রচনার কাজ। এ কাজের সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয় খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৪ সালে পারসিক সম্রাটের অনুমতি পেয়ে ব্যাবিলনের বাদবাকি সকল ইহুদীরা আচার্য ইষ্রার নেতৃত্বে জেরুজালেমে ফেরার পরে।

৯৩ বছর ধরে ওল্ড টেস্টামেন্ট রচিত হওয়ার সময় যত মনগড়া বিধান চালু হয়, আচার্য ইষ্রা এক ধাক্কায় তার চেয়েও বেশি এগিয়ে যান। বিশুদ্ধ ইহুদি জাতি গড়ার জন্য তিনি সংরক্ষণবাদ চালু করেন। কিন্তু বিশুদ্ধ রক্তের দম্ভে দম্ভিত ইহুদি জাতি আর মুক্তির দেখা পেল না। পরাধীনতা তাদের বুকে আরও বেশি চেপে বসল। অন্য মহাদেশ থেকে আসা মেসিডোনীয় সাম্রাজ্যের অধিপতি আলেকজান্ডার যখন পারসিকদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করলেন।
এটা খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সালের ঘটনা। আলেকজান্ডারের পরে তার সেনাধ্যক্ষ টলেমির মিশরকেন্দ্রিক সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায় জেরুজালেম।

রোমানরা জেরুজালেম দখল করে খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে। রোমান শাসনের অধীনস্ত জেরুজালেমেই সূচনা হলো ইতিহাসের নতুন আরেক দিগন্তের। এটা হলো খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাব। শোষিত ও বঞ্চিত মানুষদের মুক্তির বার্তা নিয়ে একদিন নবী ঈসা (যীসাস) জেরুজালেমে আবির্ভূত হলেন।

অত্যাচারি রাজশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মুসা যে ধর্মের বাণী প্রচার করেছিলেন তা কালের আবর্তে হারিয়ে গিয়েছিল। মুসার প্রচারিত মূল ধর্ম থেকে সরে গিয়ে ইহুদী ধনীক শ্রেণির ভাঁড়াটে ধর্মযাজকরা মনগড়া যে ধর্ম সৃষ্টি করে তাতে তাদের নিজেদের ভেতরেই ধনী-গরীবের বৈষম্য ও শোষণ স্বীকৃত ছিল। তাই এ ধর্ম রোমান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শোষিত ইহুদি জনগণকে সংগঠিত করতে ব্যর্থ হয়। ধর্মব্যবাসায়ী ইহুদী ধর্মযাজকরা তাদের নিজেদের সুবিধার জন্যই রোমান শাসন ও শোষণের কবল থেকে মুক্ত একটি স্বাধীন ইহুদি ধর্মরাজ্য চাইত। ধনী ইহুদীরা ও ধর্মব্যবসায়ী যাজকরা সমাজ থেকে শোষণ ও বৈষম্যের শর্তকে নির্মূল করার জন্য নয় বরং বিদেশীদের স্থলে নিজেরাই সাধারণ মানুষকে শোষণের অধিকার লাভ করার জন্য বিদেশী রোমান শাসনের অবসান চাইত। এজন্য তারা ইহুদী বিদ্রোহকে সমর্থন করত। কিন্তু সে বিদ্রোহের নেতৃত্বের একটি সংকট ছিল। সেসময়কার ইহুদিদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী তাদেরকে রোমান শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য একজন মাসিহের আবির্ভাব হওয়ার কথা ছিল যিনি তাদেরকে স্বাধীনতার পথে নেতৃত্ব দেবেন। নবী যিসাসই ছিলেন সেই প্রতিশ্রুত মাসিহ। আনুমানিক ৩০ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি নিজেকে মাসিহ ঘোষণা করেন এবং রোম শাসিত এহুদিয়া ও গালীল প্রদেশের ইহুদিদের মাঝে কাজ শুরু করেন।

নবী যিসাস ইহুদিদের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য একত্ববাদী চেতনারই পূনর্জাগরণ ঘটাতে চাইলেন। মানুষকে তিনি একমাত্র খোদার অনুগ্রহের প্রতি আস্থা রাখার জন্য আহবান জানালেন। একত্ববাদকে পুনরুজ্জ্বীবিত করার জন্য তিনি ছড়িয়ে দিলেন আশা ও আলোর বার্তা। যিসাস যে একত্ববাদ প্রচার করছিলেন তাতে ধর্মব্যবসায়ী ইহুদি যাজকগোষ্ঠীর কোন স্থান ছিল না এবং যিসাস যে খোদার কথা প্রচার করছিলেন সে খোদা কোন মধ্যসত্ত্বভোগী যাজকশ্রেণিকে ধর্মের পাহারাদার হিসেবে নিযুক্ত করেননি। সে খোদার কাছে পৌছার জন্য কোন মধ্যসত্ত্বভোগী যাজককে ঘুষ দিতে হত না এবং সরাসরি খোদাকে পাওয়ার বেলায় কোন মাধ্যমের প্রয়োজন পড়ত না। যিসাসের এই একত্ববাদের প্রসার দেখে ধর্মব্যবসায়ী ইহুদি যজকশ্রেণি প্রমাদ গুণল। তারা দেখল যদি যিসাসের শিক্ষা প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে খোদা ও মানুষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তারা এতদিন যে রমরমা বাণিজ্য করেছে তা মাঠে মারা যাবে। তারা হিসেব কষে দেখল যিসাসের শিক্ষা যদি কোনদিন ইহুদিদের স্বাধীনতা এনেও দেয় তাহলে তাতে তাদের কোন লাভ হবে না। সেই স্বাধীন ইহুদি ধর্মরাজ্যের উপাসনালয়ে খোদাকে ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য কোন হাট খোলা যাবে না। তাই নিজেদের ধর্মব্যবসা বাঁচিয়ে রাখার জন্য তারা মুখোশ খুলে ফেলতে আর দেরী করল না। যিসাসের খোদার রাজ্যকে অস্বীকার করতে তারা আর দ্বিধা করল না। তারা ঘোষণা করল যিসাস সেই প্রতিশ্রুত মাসিহ নন। আর এরপরই তারা যিসাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজনে নেমে যায়। তারা যিসাসকে হত্যার পথ খুঁজতে শুরু করে। ইহুদিদের মহাইমাম ধূর্ত কাইয়াফা বুঝতে পারে তারা নিজেরা যদি যিসাসকে হত্যা করে তাহলে সেটা রোমান কর্তৃপের চোখে বেআইনী বলে গণ্য হবে। তাই তারা বৈধভাবে যিসাসকে হত্যার একটি পথ খুজতে শুরু করে।

এ উদ্দেশ্যে তারা নতুন নবী যিসাসকে কাফের আখ্যা দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে সাধারণ ইহুদীদেরকে ক্ষেপিয়ে তোলে। এদের অপপ্রচারের কারণেই সাধারণ ইহুদীরা সেসময় বিপথগামী হয়েছিল। ইহুদী যাজকদের ষড়যন্ত্রে রোমান কর্তৃপক্ষ তাকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ প্রদান করল। এটা রোমান সম্রাট টিবেরিয়াস সিজারের সময়ের ঘটনা। এরপর ইহুদিদের মধ্যে আর কখনোই অন্য কোন মাসিহের আবির্ভাব হয়নি এবং রোমান শাসনের গোলামীর শেকল তাদের গলায় আরও চেপে বসে। আরও ৬০০ বছর ধরে তাদেরকে এ গোলামীর ধকল সইতে হয়েছিল। অবশেষ ইসলামের উত্থানের পর ৬৩৮ সালে তাদের এ গোলামীর অবসান ঘটে।

যিসাসের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে ইহুদীরা নতুন জাগরণকে সাময়িকভাবে স্তব্ধ করে দিতে সফল হলেও নিজেরা অচিরেই ভয়াবহ শাস্তির মুখোমুখি হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ইহুদিরা কোন মাসিহের নেতৃত্ব ছাড়াই রোমান শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নামতে বাধ্য হয়। তাদের অবাধ্যতায় ক্ষিপ্ত হয়ে সম্রাট টিটাস জেরুজালেম অবরোধ ও ধ্বংস করেন। ৭০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট রোমান সৈন্যরা সলোমনের উপাসনালয় সিনাগগ ধ্বংস করে ফেলে এবং দাউদের প্রাচীর ধূলায় মিশিয়ে দেয়। প্রাচীরের একটি ক্ষুদ্র অংশ দাঁড়িয়ে থাকে যা এখন Wailing Wall বা বিলাপ প্রাচীর নামে পরিচিত। টিটাসের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত জেরুজালেমের দশ লাখ ইহুদীদের অধিকাংশই পৃথিবীর অন্যান্য দেশে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে সম্রাট হাডারিয়ানস জেরুজালেম নগরী পুণঃনির্মাণ করলেও বিদেশে পালিয়ে যাওয়া ইহুদীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ১৩৫ সালে শুরু হওয়া এ নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয় ৫০৩ বছর পরে অর্থাৎ ৬৩৮ সালে মুসলিম খলিফা উমরের জেরুজালেম বিজয়ের পর।

ইহুদীরা যখন রোমান রাজশক্তির কোপানলে পড়ে অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে সে সময়ে চোখের আড়ালে খ্রিস্টধর্ম বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছে। ইহুদীরা গ্রহণ না করলেও ঈসার বাণীর বিভিন্ন খন্ড-বিখন্ড অংশ নিয়ে খ্রিস্টধর্মীরা গরীব মানুষকে আকৃষ্ট করতে শুরু করেছে। খ্রিস্টধর্ম দরিদ্র রোমান বিশেষ করে দাস ও জেলেদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়। এতে খ্রিস্টধর্মীদের ওপরও রোমান শাসকদের অত্যাচার নেমে আসে। কিন্তু এটা খ্রিস্টধর্মকে নির্জীব করতে পারেনি। বরং ক্ষয়িষ্ণু রোমান সাম্রাজ্যকে ঠিকিয়ে রাখতে এক পর্যায়ে সম্রাটরা খ্রিস্টধর্মকে স্বীকার করে নিলেন।

মুসার মত ঈসার বাণীও সুসংরক্ষিত হতে পারেনি। ফলে এ ধর্মও লোভী মানুষের হস্তক্ষেপ মুক্ত নয়। ধর্মাচার্যরা ঈসার বাণীর সাথে নিজেদের চিন্তা ভাবনাও মিশিয়ে দিয়ে ইচ্ছানুযায়ী ধর্মীয় বিধানকে পরিবর্তন করতে পারতেন। ফলে রাজধর্ম হওয়ার পরে খ্রিস্টান যাজকরা হয়ে ওঠে পরাক্রান্ত। ধর্মকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার শুরু করে। প্রথমদিকে এ ধর্ম ছিল দাস ও দরিদ্রদের কাছে সুস্থ ও সুন্দর জীবনের প্রতীক। রাজধর্ম হওয়ার পর ধর্মের জন্য নিপীড়িত হওয়ার দিন আর রইল না বরং ধর্মের প্রতিনিধিরা ক্ষমতা ও সম্পত্তি লাভের সুযোগ পেয়ে গেল। তাই ধর্মকে ব্যবহার করে এক শ্রেণীর যাজকরা লাভবান হতে চাইল। ধর্মের মৌলিক চরিত্র সুনির্ধারিত না থাকায় ইহুদী ধর্মের মত এ ধর্মেও আচার্য ইষ্রাদের দেখা মিলল। গরীব ও দুঃখী মানুষদের হৃদয়ের স্থান ছেড়ে দিয়ে এ ধর্ম শাসক শ্রেণির সাথে গাটছাড়া বাধল। ইহুদী ধর্মে ধনী ইহুদীদেরকে যেভাবে গরীব ইহুদীদের শোষণ করার অধিকার দেওয়া হয় সেভাবে খ্রিস্টান ধর্মাচার্যরাও যীসাসের ভালবাসার বাণী ভুলে গিয়ে বিধর্মীদের ওপর অত্যাচারের অধিকার পেয়ে যায়। আর এটা প্রথমেই চালু হয় ইহুদীদের ওপর দমন পীড়ন শুরুর মধ্য দিয়ে। রোমক সৈন্যদের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত ইহুদী ও খ্রিস্টানরা এক সময় নিজেদের মাঝে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নিত। কিন্তু ক্ষমতায় যেয়ে খ্রিস্টধর্মীরা তাদের চেহারা পাল্টে ফেলল।

জেরুজালেমের ক্ষমতায় গিয়ে চেহারা বদলায়নি একমাত্র ইসলাম ধর্ম। ইসলাম যখন জেরুজালেমের ক্ষমতায় যায় সেখানে বিজিতদের উপর কোন হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়নি। তাই মুসলমানদের জেরুজালেম বিজয় নিপীড়িত ইহুদীদের জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনল। ইসলাম ক্ষমতায় আসায় তারা প্রাণে বাঁচার নিশ্চয়তা পেল। এমনকি খ্রিস্টানরাও কোন হুমকির সম্মুখীন হয়নি।

৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে খলীফা উমরের মুসলিম বাহিনী জেরুজালেম অবরোধ করলে খ্রিস্টান যাজক প্রধান (প্যাট্রিয়ার্ক) সোফরোনিয়াস শর্ত দেন যে, এই পবিত্র নগরী তিনি তুলে দেবেন সরাসরি মুসলিম খলীফার হাতে এবং তারই সাথে তিনি নগরী সমর্পনের চুক্তি স্বাক্ষর করবেন, অন্যথায় নয়। তার শর্ত মেনে নিয়ে খলীফা সুদূর মদীনা থেকে এলেন। জেরুজালেম নগরীর প্রবেশ দ্বারে খলীফাকে অভ্যর্থনা জানাতে দাঁড়িয়ে আছেন সোফরোনিয়াস। খলীফা উটের পীঠ থেকে নেমে তার সামনে দাঁড়ালে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন যাজক সোফরোনিয়াস। কোন জাঁকজমক নেই। আড়ম্বর নেই। একদমই একজন সাধারণ মানুষ। বেশভূষাও সাধারণ, পরিধেয় ধূলিমলিন, দাড়ি অবিন্যস্ত। মুসলিম জাহানের সর্বময় ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে এভাবে দেখতে হবে দূর কল্পনাতেও আসেনি সোফরোনিয়াসের। নির্বাক দাঁড়িয়ে খলীফার দিকে তাকিয়ে থাকেন। ইতিহাসবেত্তারা বলেছেন, পাশে দাঁড়ানো অনুচরকে তিনি গ্রিক ভাষায় বলেন- “পবিত্র স্থানে দাঁড়িয়ে নবী ড্যানিয়েল ঘৃণা শূণ্য হওয়ার যে উক্তি করেছিলেন, এই-ই তার সত্যি সত্যি প্রতিরূপ।”

অভ্যর্থনা পর্ব শেষে খলীফা যাজক প্রধান সোফরোনিয়াসের সঙ্গে শকটে চড়ে শহর প্রদক্ষিণে বেরুলেন। যখন তারা রিসারেকশন গির্জায় গেলেন তখন নামাজের সময় হয়ে গেল। সোফরোনিয়াস তাকে সেখানেই নামাজ আদায়ের অনুরোধ করেন। কিন্তু তা না করে তিনি কনস্টানটাইনের গির্জার সিঁড়ির ওপরে নামাজ আদায় করেন। খলীফা বিধর্মীদের ধর্মীয় স্থাপনাকে চুক্তি অনুসারে রক্ষা করলেন। গির্জাকে সেখানেই মসজিদ বানিয়ে তিনি তার ভেতর নামাজ পড়তে পারতেন। কিন্তু পরধর্মের প্রতি আচরণের যে শিক্ষা ইসলাম দিয়ে থাকে তা তিনি কীভাবে ভুলে যাবেন?

খলীফা মাথাপিছু সমান কর ধার্য করে সব গির্জা ও খ্রিস্টধর্মীয় স্থাপনা সোফরোনিয়াসের হাতে সমর্পন করলেন। এটা যেন আরেক মক্কা বিজয়। মক্কা ও জেরুজালেম বিজয়ের মত প্রতিহিংসা মুক্ত বিজয়ের ঘটনা ইতিহাসে বিরল। সামন্ততন্ত্রের সমগ্র ইতিহাসে বিজয়ীদের বিজিতদের ওপর বিভীষিকারূপে নেমে আসতে দেখা যায়। বিজিতরা বিজয়ীদের হাত থেকে প্রাণ রক্ষার জন্য পালিয়ে বেড়ায়। কিন্তু ইসলাম যেখানে বিজয়ী হয়েছে সেখানে বিধর্মীরা বিপুল বিস্ময়ে দেখেছে তাদের ওপর কোন প্রতিশোধ নেয়া হয়নি। বিজয়ী ইসলামকে তারা হাত পেতে গ্রহণ করে নিয়েছে।

জেরুজালেমের খ্রিস্টান ও ইহুদীরা খলীফার সাথে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ভূসম্পত্তির মালিক হতে পারত। মুসলমানদের মতোই সরকারি চাকরির দ্বার তাদের জন্য ছিল উন্মুক্ত। সর্বত্র খ্রিস্টানদের গির্জা ও মঠ ছিল। খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীদের জেরুজালেমে ঢোকার অবাধ অধিকার ছিল। পরবর্তী শত শত বছর ধরে ইসলামের মূলনীতি থেকে বিচ্যুত খিলাফতের নামে উমাইয়া, আব্বাসীয় ও ফাতেমী রাজতন্ত্রের সময়েও জেরুজালেমের মুসলমানরা খ্রিস্টানদের সাথে শান্তি ও সৌহার্দ্য বজায় রাখার জন্য যা যা করণীয় তার সবই করতেন।

ক্ষমতাসীন মুসলমানদের সাথে শুধু খ্রিস্টানদের সহাবস্থানই নয়, বরং ইহুদী খ্রিস্টান ও ইহুদী মুসলমান সহাবস্থানও যথেষ্ট শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল। এ সহাবস্থান মহানবীর প্রতিষ্ঠিত খিলাফতের সময় থেকে শুরু করে ইসলাম থেকে বিচ্যুত রাজতন্ত্রী খিলাফতেরও দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ঠিকেছিল। এ সম্প্রীতিতে কিছুটা ফাটল ধরে যখন সেলজুকরা মিশরের ক্ষমতায় যায়। সেলজুকরা ফাতেমীদের হাত থেকে মিশরের ক্ষমতা দখল করে ১০৫৮ সালে। জেরুজালেম দীর্ঘ সময় ধরে মিশরকেন্দ্রিক ফাতেমী রাজতন্ত্রী খিলাফতের অধীনে শান্তিতেই ছিল। জেরুজালেম মুসলমানদের দখলে আসার ৪৫৯ বছর পরে খ্রিস্টানদের সাথে অসদাচরণের ঘটনা প্রথমবারের মত ঘটায় মুসলিম নামধারী সেলজুক সুলতান।

১০৯৫ সালের দিকে খ্রিস্ট ধর্মাচার্যকে সে অপমান করে বন্দী করে পরে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়। জেরুজালেম থেকে মুসলিম আধিপত্য উচ্ছেদের জন্য এরকমই একটি ঘটনার অপেক্ষায় ছিল ইউরোপের খ্রিস্টান নরপতি ও ধর্মাচার্যরা। এ ঘটনায় তারা সেই কাঙ্খিত মহাসুযোগ পেয়ে গেল। খ্রিস্টধর্মের ধ্বজ্জাধারী বিষাক্ত সর্পরা লকলকে জিহ্বা নিয়ে গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে ছোবল মারতে উদ্যত হল জেরুজালেমের নিরীহ মানুষদের ওপর। খ্রিস্টধর্মের প্রধান কর্তা পোপ আরবান-২ মানুষের খোলস ছেড়ে রক্তলোলুপ দানবের বেশে বেরিয়ে এলেন।

ক্যাথলিক ইউরোপের রাজ-রাজড়াদের ওপর ধর্মের ছড়ি আরও বেশি ঘুরিয়ে নিজের ক্ষমতা যাতে আরও বেশি বাড়ানো যায় সেজন্য ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে সবাইকে সংগঠিত করে তিনি ঘোষণা করলেন ধর্মযুদ্ধ-ক্রুসেড। পোপ ফ্রান্সের ক্লারমন্টে কাউন্সিল ডেকে সবাইকে নিয়ে ক্রুসেডে অংশ নেয়ার শপথ করলেন। এ শপথ একজন মানুষের হতে পারে না। এ শপথ ধর্মের আলখাল্লার নিচে লুকিয়ে থাকা মানুষরূপী একজন দানবের। ক্রুসেডের পেছনে কোন মহৎ উদ্দেশ্যের ছিটেফোটাও ছিল না। এটা ছিল ক্ষমতালোভী ধর্ম ব্যবসায়ী খ্রিস্ট যাজকতন্ত্র ও রাজ-রাজড়াদের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য রক্তলালসার বহিঃপ্রকাশ। রক্ত লালসায় কাতর ধর্মের ধ্বজ্জাধারীরা মানুষের খোলস ছেড়ে হায়নার বেশে নিরীহ মুসলমান ও ইহুদীদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে জেরুজালেম দখলের সাথে সাথেই।

১০৯৯ সালের ১৫ এপ্রিল। জেরুজালেমের ইতিহাসে এক দুঃখের দিন। চল্লিশ দিন অবরোধের পর এদিনে ক্রসেডাররা জেরুজালেম দখল করে। এরপরই রক্ততৃষ্ণায় কাতর হায়েনারা ঝাপিয়ে পড়ল সাধারণ মানুষের ওপর। রাস্তায় ও বাড়িতে যাকেই সামনে পেল কেটে টুকরো টুকরো করল। পরাজিতদের জন্য জেরুজালেমে কোন আশ্রয় মিলল না। দূর্গ প্রাচীর থেকে লাফ দিয়ে মৃত্যুবরণ করে কয়েকজন ক্রসেডারদের হাত থেকে বাঁচল। অনেকে প্রাসাদ, বুরুজ ও সর্বোপরি মসজিদে ভিড় করল। কিন্তু সেখানেও ক্রসেডারদের তরবারির কোপে তারা কচুকাটা হল। উমরের মসজিদে সারাসিনরা কিছুক্ষণ পর্যন্ত আত্মরক্ষা করল। কিন্তু ক্রুসেডারদের তরবারির কোপে সেখানে মৃত্যুর গোঙ্গানী ও আর্তনাদ ছাড়া আর কিছু শোনা গেল না। হায় উমর! হায় সোফরোনিয়াস! যে খলীফাকে আমরা কনস্টানটাইনের গির্জার সিঁড়িতে নামাজ আদায় করতে দেখেছি তিনিই সেই উমর।

রেমন্ড দ্য এজিলেস নামক এক প্রত্যক্ষদর্শী মাত্র একবাক্যে ক্রুসেডারদের নৃশংসতার ভয়ংকরতা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘মসজিদের বারান্দায় রক্ত হাঁটু পরিমাণ হয়েছিল এবং ঘোড়ার লাগাম পর্যন্ত হয়েছিল’।

মুসলমানদের ভাগ্যবরণ করতে হয় ইহুদীদেরও। যেহেতু তারা মুসলমানদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তার জন্য ভয়াবহ মূল্য দিতে হয়। ক্রুসেডাররা নগরীতে প্রবেশ করে যখন নির্বিচারে হত্যায় মেতে ওঠে তখন অতীত রীতি অনুসরণে ইহুদী প্রবীণরা নগরীর সমস্ত ইহুদী নর-নারী, শিশু-বৃদ্ধ সবাইকে প্রধান সিনাগগে জড়ো হয়ে প্রার্থনায় নিমগ্ন হতে নির্দেশ দেন।
জীবন বাঁচাতে তাদের এই সিদ্ধান্ত ছিল মারাত্মক ভুল। ধর্ম উন্মাদ খ্রিস্টানরা সিনাগগের চারদিক ঘিরে ফেলে এবং আগুন লাগিয়ে দেয়। একটি শিশুও যাতে ঘেরাওয়ের ফাঁক ফোঁকর গলিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে, সেদিকে ক্রুসেডাররা কড়া নজর রাখে। ফলে হাজার হাজার ইহুদী নর-নারী, শিশু-বৃদ্ধ জীবন্ত পুড়ে মারা যায়। ক্রুসেড নামক এই অপরাধের জন্য নয়শত বছর পরে ভ্যাটিকানের পোপ মুসলমান ও ইহুদীদের কাছে ক্ষমা চান।

জেরুজালেমে ক্রুসেডারদের এই অপরাধ তখন বাগদাদের লম্পট খলিফাকে মোটেও ভাবিত করেনি। আসলে ইসলাম ধর্মকে সুবিধাবাদী লম্পট শাসকরা পরিবর্তন করতে না পারলেও ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তারা সুরা পান ও সুন্দরী নারী দিয়ে নিজেদের হারেম পূর্ণ করতে ঠিকই পেরেছে। তাই ইসলাম বারবার জনগণের তরফ থেকেই মাথা উচু করে দাঁড়িয়েছে। জেরুজালেমের কান্না মুসলিম নামধারী লম্পট শাসকদের কানে না পৌছালেও কুর্দি যোদ্ধা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কানে ঠিকই পৌছাল। সালাহউদ্দিনের হৃদয় জুড়ে ছিল জেরুজালেমের কান্না। তাই জেরুজালেম মুক্ত করার জ্ন্য তিনি বাগদাদের লম্পট খলিফার সাথে আপোস করলেন মুসলিম ঐক্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য। বাগদাদের অভিজাত শ্রেণি সাধারণ ঘরে বেড়ে ওঠা সালাহউদ্দিনকে কী হেয় দৃষ্টিতে দেখত তা তিনি জানতেন। কিন্তু তবুও মিশর ও সিরিয়া বিজয়ী সালাহউদ্দিন বাগদাদ আক্রমণ না করে খুতবা থেকে নিজের নাম বাদ দিয়ে বাগদাদের খলিফার নাম যুক্ত করলেন। শুধুমাত্র মুসলিম শক্তির ঐক্যকে রক্ষা করার জন্য।

১১৮৭ সালের ২ জুলাই সালাহউদ্দিনের কাছে পরাজিত হয়ে ষাট হাজারের বেশী ক্রুসেডার জেরুজালেমের ভেতরে আশ্রয় নেয়। সালাহ উদ্দীন তাদেরকে নগর প্রাচীরের কাছে ডেকে বলেন, যদি তারা নগর প্রাচীর থেকে বেরিয়ে চলে যায় তাহলে তিনি তাদেরকে তাঁর কোষাগারের একাংশ ও যত জমি তারা চাষ করতে চায় তা তাদেরকে দান করবেন। কয়েকদিন অবরোধের পর তারা আত্মসমর্পন করলে সালাহউদ্দিন তার প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। ৬৩৮ সালে খলীফা উমর যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন সাড়ে পাঁচশ বছর পরে উমরের উত্তরসূরী গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ূবী সেই দৃষ্টান্ত পালন করলেন। আর রাসূল সা. মক্কা বিজয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন সেই দৃষ্টান্তই উমর স্থাপন করেছিলেন জেরুজালেমে।

আজ জেরুজালেম একজন উমর কিংবা সালাহউদ্দিনের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে। কারণ জেরুজালেম আজ আবার রক্তাক্ত ও বেদনাক্লিষ্ট। ক্রুসেডাররা নয় বরং এক সময়ে ক্রুসেডারদের হাতে মার খাওয়া ইহুদীরাই এখন ক্রুসেডারদের প্রত্যক্ষ মদদে জেরুজালেমকে রক্তাক্ত করছে তাদের এক সময়ের আশ্রয়দাতা বন্ধু মুসলমানদের রক্তে। ক্রুসেডারদের স্থান দখল করেছে যায়নবাদীরা। ক্রুসেডারদের সেই হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রায় হাজার বছর পরে জেরুজালেম আবারও যায়নবাদী বর্বরতার বেদনায় কাতর। তাই আমাদের আবার ফিরে যেতে হবে জেরুজালেমে, আপন ভূমি থেকে বিতাড়িত বেদনার্ত ফিলিস্তিনিদের দুঃখ আর গ্লানির কথায়, যেতে হবে তাদের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী বিষধর সর্পদের চক্রান্তের কথায়।

সালাহউদ্দিনের আঘাত খ্রিস্টধর্মন্ধতার মূলে এমন প্রচন্ড ধাক্কা দেয়, যা তারা শত শত বছর পরেও ভুলতে পারে না। প্রতিহিংসার অনল তারা সযত্নে পুষে রাখে মনের গহীনে। বিংশ শতকের প্রথমার্ধে তারা নিজেদেরকে মৌলবাদী হিসেবে পরিচয় প্রদান করে। অন্যদিকে খ্রিস্ট ধর্ম অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলো পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র ধারণ করে ততদিনে। পুঁজিবাদের বিষফোঁড়া হল সাম্রাজ্যবাদ, যা পৃথিবীকে যুদ্ধ, ধ্বংস ও বিভীষিকা ছাড়া আর কিছুই দেয় নি। অতি মুনাফার লালসায় সাম্রাজ্যবাদী শকুনেরা পৃথিবীর যেখানে খুশী সেখানে ঝাপিয়ে পড়ে যেভাবে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে পেরেছে, তা ইতিহাসের আর কোন অশুভ শক্তি এত স্বল্প সময়ে পারত না।

সভ্যতার সবচেয়ে বড় অভিশাপ হল সাম্রাজ্যবাদ। আজকের দিনে সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে জঘণ্য রূপ হল ইঙ্গ-মার্কিন ও ফরাসী সাম্রাজ্যবাদ। এই সাম্রাজ্যবাদীরা বিংশ শতকের প্রারম্ভে মৌলবাদের সাথে গাঁটছাড়া বাঁধল তৎকালীন মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষয়িষ্ণু ওসমানীয় খিলাফত ভেঙ্গে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়ার আশায়। ইসলামের মূলনীতি থেকে বিচ্যুত অভিজাততন্ত্রী মুসলিম খিলাফতের সর্বশেষ সংস্করণ হল তুরস্কের ওসমানীয় খিলাফত। এই ওসমানীয় খিলাফত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮) ব্রিটিশ ও ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের কাছে জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ হারায়।

সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর ১১৮৭ সালের জেরুজালেম পূণর্দখলের ৭২৯ বছর পর ১৯১৬ সালে মুসলমানদের হাত থেকে জেরুজালেমের কর্তৃত্ব দখল করল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ-প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের ফসল হিসেবে। বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত ওসমানীয় সাম্রাজ্য ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে যখন নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয় ব্রিটেন ও ফ্রান্স, সেই সময় তাদের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা মৌলবাদী বিষাক্ত সাপটি ফণা তোলে। ভাগাভাগিতে ফ্রান্স পায় সিরিয়া ও লেবানন। সিরিয়ার শক্তি খর্ব করার জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা এর একটি অংশ কেটে সৃষ্টি করে লেবানন। প্যালেস্টাইনের অংশ কেটে সৃষ্টি করে জর্ডান। মধ্যপ্রাচ্যে তাদের দখলদারিত্বকে স্থায়ী রাখার জন্য তারা ফিলিস্তিনের বুকের ওপর সৃষ্টি করে তাদের বংশবদ উগ্র মৌলবাদী ইসরাইল রাষ্ট্র। এতে ক্রুসেডে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়া হল আবার মুসলিম অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্যের বুকে নিজেদের একটি স্থায়ী খুটিও গাড়া হল। মুসলমানদের এক সময়ের মিত্র ইহুদীদের মাধ্যমে নব্য ক্রুসেডাররা মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ আদায়ের সুযোগকে কাজে লাগলো। বিশুদ্ধ ও শ্রেষ্ঠ জাতিতত্ত্বের বড়ি খাওয়া ইহুদীদেরকে সাম্রাজ্যবাদীরা এবার স্বাধীন আবাসভূমির বড়ি খাইয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিল। নিজেদের স্বাধীন আবাসভূমির লালসায় আক্রান্ত হয়ে ইহুদীরা ভুলে গেল তাদের প্রতি ক্রুসেডার ও খ্রিস্টান ইউরোপের আচরণের কথা। ভুলে গেল মুসলমানরা কিভাবে তাদের আশ্রয় দিয়েছিল। বরং তারা ক্রুসেডারদের সাথে হাত মিলিয়ে তৎপর হয়ে উঠল নিরীহ ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে।

খলীফা উমরের জেরুজালেম দখলের পর ৪৬১ বছর ইহুদীরা মুসলমান শাসনের অধীনে নিরাপদ জীবন যাপন করেছে। এর আগে তারা বারবার ক্যালদীয়, মেসিডোনীয়, রোমান ও খ্রিস্টধর্মীয় অত্যাচারে বিপর্যস্ত হয়েছে। ১০৯৯ সালে যখন ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করে তাদের জীবনে কত বড় বিভীষিকা নেমে এসেছিল তা আমরা জেনেছি। এর ৮৮ বছর পরে ১১৮৭ সালে সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর জেরুজালেম বিজয় আবার তাদের জীবনে ফিরিয়ে আনল স্বস্তি। ১৯১৬ সাল পর্যন্ত আরও ৭২৯ বছর তারা মুসলিম শাসনের অধীনে নিরাপদ জীবন নিয়ে বেঁচে থাকল। কিন্তু সেই সময়ের খ্রিস্টান ইউরোপে তাদের জীবন কত দূর্বিষহ ও গ্লানিকর ছিল তা আরেক লম্বা ইতিহাস। খ্রিস্টান ইউরোপ ইহুদীদেরকে যে নজিরবিহীন ঘৃণা ও বর্বরতার মুখোমুখি করে তা থেকে বাঁচতে তারা আশ্রয় নিত ইউরোপের এক টুকরো মুসলিম অধ্যুষিত ভূখন্ড স্পেনে। মধ্যযুগের ইউরোপে ইহুদীদের স্বাভাবিক জীবন যাপনের অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায় একমাত্র স্পেনে।

খ্রিস্টান ইউরোপ নর্দমার কীট থেকেও হেয় ও ঘৃণ্য জীব হিসেবে তাদেরকে বিবেচনা করত। তাদের জন্য জমি ক্রয়ের অনুমতি মিলত না। চাকরি তাদের জন্য ছিল নিষিদ্ধ। গলায় মোজেসের নির্দেশনামা কিংবা অপমানকর হলুদ ব্যাজ ঝুলিয়ে রাখতে হত। ঘোড়ার গাড়িতে চড়া ছিল নিষিদ্ধ। এক শহর থেকে আরেক শহরে ঢুকতে দিতে হত কর। Ghetto নামে নির্দিষ্ট বস্তি ছিল তাদের ঠিকানা। যখন যেভাবে খুশি তাদেরকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হত। রীতিমত উৎসবের আমেজে ইহুদীদের ধরে ধরে গণবলী দেওয়া হত। ঘরবড়ি মনের আনন্দে খ্রিস্টানরা জালিয়ে দিত। সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে ভর্তি হয়ে যুদ্ধে মরতে হতো। রশিয়ার জাররা ছিলেন আরও এক কাঠি সরেস। জার সরকার সকল ইহুদী নারীর গলায় বেশ্যার চাকতি পরিয়ে দিল। ১৮৮০ সালে জার আলেকজান্ডার-২ হত্যার দায় চাপিয়ে ইহুদীদের ওপর যে বিভৎস গণহত্যা চালানো হয় তা বুঝাতে ইংরেজি অভিধানে Pogrom নামে নতুন একটি শব্দ তৈরী হয়। যার অর্থ নির্বিচারে হত্যা ও লুন্ঠন। এসব বর্বরতায় বেদনাক্লিষ্ট ইহুদীরা নিজেদের জন্য স্বাধীন আবাসভূমির স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। সে আবাসভূমি কোথায় হবে তা নিয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব ছিল। বেশিরভাগ ইহুদী মনে করত দক্ষিণ আমেরিকা বা কানাডায় এটা হবে। অনেকের পছন্দ ছিল আর্জেন্টিনা।

কিন্তু ইতিহাসের নির্মম সত্য হল তারা স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করল তাদের ওপর অত্যাচারী ক্রুসেডারদের সাথে হাত মিলিয়ে সম্পূর্ণ নিরীহ ও নিরপরাধ একটি জাতির বুকের ওপর। যারা ইহুদীদেরকে কোন ফুলের টোকাও দেয়নি সেই ফিলিস্তিনিদের বুকের ওপর তারা ইসরাঈল নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ক্রুসেডার সাম্রাজ্যবাদীদের প্রত্যক্ষ মদদে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মান ও রাশিয়ায় মধ্যযুগ জুড়ে ক্রুসেডাররা ইহুদীদের ওপর যে কায়দায় অত্যাচার করেছে, সেই একই কায়দায় ইহুদীরা অত্যাচার শুরু করল ফিলিস্তিনের নিরীহ নিরপরাধ মানুষদের বিরুদ্ধে। এটাই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ। এটাই ধর্মের পরাজয়। নিপীড়িত ইহুদীদের ধর্মবিশ্বাস নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাদের বিবেককে জাগ্রত করতে ব্যর্থ হল। নিপীড়ন ও অপরাধের প্রতি ঘৃণা নয় বরং নিজেদের নিপীড়িত হওয়ার দিন শেষ হলে নিজেরাই অন্যের ওপর ঝাপিয়ে পড়ার বৈধতা পেয়ে যাবে সে ধরণের নৈরাজ্যবাদী লালসা ধারণ করতে তাদের ধর্ম কোন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি।

ঘৃণা ও অত্যাচারকে সমাজ থেকে নির্মূল নয় বরং নিজেরাই ঘৃণা করার ও অত্যাচারের আনন্দ ভোগ করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আচার্য ইষ্রার উত্তরসূরীরা খ্রিস্টধর্মী নিপীড়নের হাত থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাজ্যের স্বপ্ন দেখত। এটা প্রকাশ পেল যখন সাম্রাজ্যবাদীরা তাদেরকে ফিলিস্তিনের বুকের ওপর স্বাধীন রাজ্য গড়ার সুযোগ করে দিল। আচার্য ইষ্রা সংরক্ষণবাদী ধর্মীয় মৌলবাদের যে বিষ তাদের ধমনীতে ঢুকিয়ে দিয়েছিল তা আড়াই হাজার বছর ধরে তাদের শরীরে প্রবাহিত হয়েছে। অত্যাচার ও জুলুমের শর্তকে নির্মূল করা নয়, নিজেই অত্যাচারির জায়গা দখল করার নাম সফলতা ও মুক্তি। এই সূত্রই মোটামোটিভাবে ইহুদীরা অনুসরণ করেছে। তা না হলে ক্রুসেডের আগের ৪৬১ বছর ও ক্রুসেডের পরের ৭২৯ বছর নিয়ে মোট ১১৯০ বছর মুসলমানদের কাছে তারা স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার মযার্দা ভোগ করার পরেও কেন ফিলিস্তিনে তাদের মুসলমান প্রতিবেশীদেরকে আজ নরকীয় নৃশংসতায় হত্যা করবে?

অ্যাসিরীয়, ক্যালদীয়, পারসিয়ান, মেসিডোনীয়, সেলূসিড, রোমান ও খ্রিস্টধর্মীয় শাসকরা তাদেরকে যে নিষ্ঠুরতায় হত্যা করত সেই একই নিষ্ঠুরতায় তারা হত্যা করছে এমন এক সম্প্রদায়ের মানুষকে, একমাত্র যারাই ছিল ইহুদীদের নির্যাতন করা থেকে মুক্ত। ইহুদীরা তাদের স্বাধীন আবাসভূমির জন্য ক্যালদীয়, পারসিয়ান, মেসিডোনীয়, রোমান কিংবা খ্রিস্টধর্মীদের হত্যা করল না বরং একমাত্র যারা তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে সেই মুসলমানরা তাদের হত্যা ও সন্ত্রাসের নির্মম শিকার হল ফিলিস্তিনে।

আচার্য ইষ্রার সন্তানদের ধমনীতে যে ভয়ংকর বিষ প্রবাহিত হচ্ছিল, সাম্রাজ্যবাদের মদদে তা বিষাক্ত সর্পের বেশে বেরিয়ে এল নিরীহ ইহুদীদের খোলস ছেড়ে। হিংস্র অজগরের ভয়াবহতা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল ফিলিস্তিনিদের ওপর। বিজয়ীর ভূমিকায় ইহুদী দর্শনের আসল চেহারা বেরিয়ে এল। এ চেহারা বিজয়ী ওমরের কিংবা সালাহউদ্দিনের চেহারা থেকে একেবারেই ভিন্ন। এ বড়ই ভয়ংকর চেহারা। এ চেহারা দেখে সমগ্র আরব জাহান বিমূঢ় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। হতবাক হয়নি শুধু দুজন- একজন নেজদের প্রয়াত শাসক ইবনে সউদের পুত্র আব্দুল্লাহ আজিজ ইবনে সৌদ এবং অপরজন মক্কার শাসনকর্তা শরীফ হোসেনের পুত্র আব্দুল্লাহ, যাকে সাম্রাজ্যবাদীরা জর্ডানের বাদশাহ বানিয়েছিল। এই ফিলিস্তিনের জনগণের বিরুদ্ধে এই দুজনের বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসও বড়ই করুণ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের এই দুই দালালের সহযোগিতায় ইহুদীরা যে ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে তাতে ক্রুসেডারদের প্রতিহিংসা কাতর আত্মাই শুধু পরিতৃপ্ত হল না, আচার্য ইষ্রার উত্তরসূরীদের এক ভয়ংকর স্বপ্নও বাস্তবায়িত হয়ে গেল। আর সেই সাথে সভ্যতার ইতিহাসের সকল বিশ্বাসঘাতককে পেছনে ফেলে একেবারে শীর্ষে উঠে গেল দুই মুসলমান বিশ্বাসঘাতক। ক্রুসেডারদের এই প্রতিহিংসা জন্ম দিয়েছে নতুন ক্রুসেডের। আজ বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে এক নতুন ক্রুসেড- যাতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা জড়িয়ে পড়েছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক নিরন্তর যুদ্ধে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি ১৯১৬ সালে জেরুজালেম দখল অভিযানে ব্রিটিশ বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন জেনারেল অ্যালানবি। উৎফুল্ল চিত্তে সৈন্যদের নিয়ে জেরুজালেমে প্রবেশ করেই তিনি ঘোষণা দিলেন- ‘একমাত্র এখনই ক্রুসেডের সমাপ্তি ঘটল’। গাজায় ফিলিস্তিনি ও তুর্কি সৈন্যদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ ও মিত্র বাহিনীর যে যুদ্ধ হয় তাকেও ব্রিটিশ পত্র-পত্রিকা ক্রুসেড নামে অভিহিত করে। দি টাইমস বলেন- ‘নয়া ক্রুসেড’, আরেকটি পত্রিকা বলেন- ‘অষ্টম ক্রুসেড’, অন্য আরেকটি পত্রিকা বলেন- ‘এই-ই হচ্ছে সর্বশেষ ক্রুসেড’।

জেনারেল অ্যালানবি আনন্দের অতিশয্যে ক্রুসেডের সমাপ্তি ঘোষণা করলেও আসলে এটা ছিল নতুন ক্রুসেডের শুরু মাত্র। এই নতুন ক্রুসেডে সাম্রাজ্যবাদ, যায়নবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের দালাল আব্দুল আযীয ইবনে সৌদ ও আব্দুল্লাহর মত বিশ্বাসঘাতকরা একসাথে গাঁটছাড়া বাঁধলেও ফিলিস্তিনি শিশুদের কান্না পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে পৃথিবীর অগণিত বিবেকবান মানুষ সাম্রাজ্যবাদীদের মদদে ইসরাঈলের দানবীয় নৃশংসতার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছে। ফিলিস্তিনি শিশুদের রক্তাক্ত ও ছিন্ন-ভিন্ন লাশের মিছিল দেখে ক্রুসেডের মোকাবিলায় এগিয়ে এসেছে বেসরকারিভাবে সংগঠিত মুসলিম শক্তি। ১৯৯৮ সালে আল কায়েদার নেতা শায়খ ওসামা বিন লাদেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। গায়ে সামরিক উর্দি চড়িয়ে সাব-মেশিনগান হাতে ওসামা ঘোষণা দিলেন- যতদিন ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠিত না হবে ততদিন আমেরিকা স্বপ্নেও শান্তির দেখা পাবে না। ওসামা বিন লাদেনের হৃদয় জুড়ে ছিল নির্যাতিত ফিলিস্তিন। ইসরাঈলী বোমায় ফিলিস্তিনি শিশুদের করুণ মৃত্যু আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে টেনে আনে এই আরব ধনকুবেরকে। ফিলিস্তিনীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন ‘নিশ্চয়ই তোমাদের রক্তই আমার রক্ত। আমি হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তোমাদের মুক্ত করার জন্য এগিয়ে যাব’।

আজকের Google যে পরিমাণ সম্পত্তির মালিক ত্রিশ বছর পূর্বে ওসামা ছিলেন তার সমপরিমাণ সম্পত্তির মালিক। ৮০’র দশকের ২০০০ মিলিয়ন ডলারের মালিক ওসামা তার বিপুল বিত্ত ঢেলে দিয়েছিলেন সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত আফগানদের সাহায্যে। সেই সময় আমেরিকার সাথে ওসামার কোন প্রকাশ্য শত্রুতা ছিল না। আমেরিকা নিজেও তার প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়নকে শায়েস্তা করার জন্য সে যুদ্ধে আফগানদের সাহায্য করেছিল। কিন্তু ওসামা সে যুদ্ধে যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমেরিকার চেয়েও বহুগুণ বেশী অর্থ আফগানদের দান করেন তা আমেরিকার জন্য যথেষ্ট মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ওসামা অন্যায়ের একাংশের বিরুদ্ধে নয় বরং অন্যায়ের শর্তকে নির্মূল করার দিকে এগুচ্ছিলেন। শুধু সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ নয় বরং আমেরিকাসহ সকল অত্যাচারি সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তিনি আফগান রণাঙ্গনে তাঁর যোদ্ধাদের প্রস্তুত করছিলেন।

সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে ওসামা ও আমেরিকা এক কাতারে থাকলেও কেউ পরস্পরকে সাহায্য করেনি। ওসামা জানতেন আমেরিকা সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদের চেয়েও বহুগুণ বেশি জঘন্য। এজন্য তিনি আফগান যোদ্ধাদেরকে আমেরিকার সাহায্যে প্রীত হতে পারেননি। তিনি জানতেন ভবিষ্যতে আমেরিকার বিরুদ্ধেই তাকে লড়তে হবে। এজন্য আফগানদের প্রতি আমেরিকার সমর্থন থাকায় খুশি হয়ে তিনি আমেরিকাকে এক কানাকড়িও দান করেননি। পরে অবশ্য তাঁর নিতান্ত অনিচ্ছায় আমেরিকা তার সম্পদের একাংশ লুট করে। ১৯৯৬ সালের এপ্রিল মাসে ক্লিনটন সরকার আমেরিকার ব্যাংকে রাখা ওসামার ৩০০ মিলিয়ন ডলার মেরে দেয়।

২০০৮ সালের ১২ মার্চে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে Conversations with History -শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে সি.আই.এ-এর সাবেক কর্মকর্তা এবং ওসামা বিন লাদেন ইউনিটের প্রধান মাইকেল শ ইয়ার বলেন- ‘আসলে সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগান জিহাদ চলাকালীন সময়েই আমরা বিন লাদেনকে নিয়ে বিস্ময়কর সব তথ্য পাওয়া শুরু করি। সত্যি বলতে কি, এই সময়ে আমরা (সি.আই.এ.) তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করছিলাম। আশির দশকের প্রায় শেষ পাঁচ বছর ধরে আমরা তার সাথে যোগাযোগ করার যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়েছি। কিন্তু বিন লাদেন আমাদের সাথে, আমেরিকার সাথে বিন্দুমাত্র সংস্পর্শও ঘৃণা করতেন। আমাদের কাছ থেকে ধুলো পরিমাণ কিছু নিতেও তিনি আগ্রহী ছিলেন না। তার নিজের বিশাল সম্পত্তি এবং অর্থবিত্ত ছিল। তিনি খুব সহজেই তার নিজের সোর্সের মাধ্যমে অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারতেন। সেজন্য আসলে তার কাছে আমাদের কোন মূল্যই ছিল না এবং আমাদের সাহায্যেরও তার দরকার ছিল না’। (সূত্র: ইন্টারনেট- http://www.youtube.com/watch?v=gxdb5nnRMrU)

মাইকেল শ ইয়ার তার ‘Marching Toward Hell: America & Islam after Iraq’ বইটিতে বলছেন, “বিন লাদেনের উত্থান ঘটেছে মুসলিম বিশ্ব থেকে উঠে আসা একটা শক্তি হিসেবে এবং আমাদের (আমেরিকা) একজন এজেন্ট হিসেবে না.....”
ওসামার সাথে আমেরিকার শত্রুতার মূলে ছিল বিশ্বজুড়ে আমেরিকার নেতৃত্বে পরিচালিত সন্ত্রাস, জুলুম, গণহত্যা, শোষণ ও অত্যাচার। বিশেষত ফিলিস্তিনের মাটিতে অবৈধ ইসরাঈল রাষ্ট্রের ঘোষণার এক ঘন্টার মধ্যেই আমেরিকার স্বীকৃতি প্রদান ও জাতিসংঘকে শিখন্ডি হিসেবে দাড় করিয়ে অবৈধ ইসরাঈলের পক্ষে বিভক্তি প্রস্তাব পাশ করানোর ঘটনা আমেরিকাকে মুসলমানদের স্থায়ী শত্রুতে পরিণত করে। ওসামা ও আল কায়েদা আফগান যুদ্ধে তাদের পক্ষের শক্তি আমেরিকাকে কি দৃষ্টিতে দেখতেন তা উঠে এসেছে আল কায়দার সাইবার যুদ্ধের নেতা ইমাম আনওয়ার আল আওলাকীর কথায়। আওলাকী বলেন, “আজকের আমেরিকা হলো গতকালকের ফেরাউন। আর প্রত্যেক ফেরাউনের বিরুদ্ধে একজন মুসা দাঁড়িয়ে যান।”

১৯৯৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী আফগানিস্তানের খোস্ত প্রদেশের সদর দপ্তর থেকে আল কায়দার অধীনস্ত সমস্ত গ্রুপ একত্রিত হয়ে ‘The International Front For Jihad Against Jwes and Crusaders’ শীর্ষক এক ইশতেহার ঘোষণা করে যাতে ক্রুসেডার আমেরিকার হাত থেকে আরব উপদ্বীপ মুক্ত করার ও যায়নবাদীদের হাত থেকে ফিলিস্তিন মুক্ত করার অঙ্গীকার করা হয়। অন্যদিকে, জেনারেল অ্যালানবী ১৯১৬ সালে জেরুজালেম দখল করে যে ক্রুসেডের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন, ৮৫ বছর পরে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মুখে আবার সেই ক্রুসেডের ঘোষণা শুনে হতবাক হয়ে গেল বিশ্ব। ২০০১ সালে আল কায়েদার আক্রমণে দিশেহারা মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্রুসেড ঘোষণাটি ছিল আসলে নীরবতার আড়ালে চলমান নয়া ক্রুসেডের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধেও যে আমেরিকার গাঁয়ে কেউ আঁচড় বসাতে পারেনি, সেই আমেরিকার হৃদপিন্ডে এক করুণ মোচড় দিয়ে দিল আল কায়দা। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার সামরিক দম্ভের প্রাণকেন্দ্র পেন্টাগনের একাংশ এবং অর্থনৈতিক দম্ভের প্রাণকেন্দ্র ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দুটি ভবন আল কায়েদার বিমান হামলায় ধূলায় মিশে গেল। এ ঘটনায় পোপ আরবান-২ এর মতোই মানুষের খোলস ছেড়ে দানবের চেহারায় বেরিয়ে এসে চলমান অঘোষিত ক্রুসেডের কথা সদম্ভে ঘোষণা দিয়ে দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ জুনিয়র। ২০০১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ফক্স নিউজ বুশ জুনিয়রের সেই ক্রুসেড ঘোষণার সংবাদ পরিবেশন করে এভাবে- “Bush pledges crusade to rid the world of evil doers”| একুশ শতকের এই আরবান-২ অর্থাৎ বুশ জুনিয়র তার ক্রুসেডের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করলেন আফগানিস্তান ও ইরাক দখল করে ১৫ লক্ষ নিরীহ মানুষ হত্যা করে। ইরাক ও আফগানিস্তান পরিণত হল মৃত্যুপূরীতে। ইরাক, আফগান ও ফিলিস্তিনের শিশুরা এমন এক সময় ক্রুসেডার ও যায়নবাদীদের ট্যাংকের তলায় পিষ্ট হচ্ছে যখন সভ্যতা পদচারণা করছে চন্দ্রপৃষ্ঠে।

আধুনিক সভ্যতা যে সব চিন্তা, দর্শন ও মতবাদের জন্ম দিয়েছে ক্রুসেডার ও যায়নবাদীদের দানবীয় নৃশংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য তা করুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ, ক্রুসেডার বা যায়নবাদীরা ও আব্দুল আযীয ইবনে সৌদের বংশধরদের মত ভয়ংকর বিশ্বাসঘাতক সর্পদের হাত থেকে পৃথিবীকে উদ্ধার করার জন্য আজ আবার প্রয়োজন একজন উমরের।

সেই উমর! যিনি খ্রিস্টান যাজক প্রধান সোফরোনিয়াসের হাত ধরে হেটে চলেছেন জেরুজালেমের পথে। বিপন্ন বেদুইন মায়ের সাহায্যে যিনি পৌছে যান ছদ্মবেশে। ক্ষুধার্ত বেদুইন শিশুর কান্না যার হৃদয়ে আলোড়ন জাগায়। ক্ষুধার্ত বেদুইন শিশুদের খাদ্য পৌছে দেয়ার জন্য যিনি মদীনার রাজপথে হেটে বেড়ান ছদ্মবেশে। ফিলিস্তিনের শিশুরা কি সেই ছদ্মবেশী খলীফার মত একজন মানুষের আশা করতে পারেনা যিনি তাদের মুক্ত করবেন কিন্তু ইহুদী শিশুদেরকেও দেবেন নিরাপদ আশ্রয়?

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থি, ইংরেজি বিভাগ, শা.বি.প্র.বি.
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:০০
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×