মৃত্যু যখন অনিবার্য হয় তখন তা যেন হয় বেদনাহীন ও শান্তিময়। ‘প্যালিয়াটিভ কেয়ার’ বিশ্বাস করে যে, মানুষ শুধুমাত্র শরীরনির্ভর প্রাণী নয়; মন, জীবনীশক্তি, আবেগ এমনকি পরিবার, সম্প্রদায় যেখানে সে বাস করে সেটিও তার অস্তিত্বেরই অংশ। সুতরাং একজন অসুস্থ ব্যক্তি এবং তার পরিবারের সঙ্কট শুধুমাত্র শারীরিক নয়; হতে পারে মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক-যা শারীরিক অসুস্থতার মতই গুরুত্বপূর্ণ। কখনও একটি সমস্যা আরেকটিকে ত্বরান্বিত করতে পারে। যেমন মানুষ যখন উদ্বিগ্ন অথবা নিরুদ্যম হয়ে পড়ে তখন তার ব্যথা তীব্রতর হয়। যখন আমরা একজন রোগীকে শারীরিক অসুস্থতাসহ সবকটি ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারবো, কেবলমাত্র তখনি আমরা তাকে ‘সম্পূর্ণ সেবা’ বলে আখ্যায়িত করতে পারবো। প্যালিয়েটিভ কেয়ার এ ক্ষেত্রে সকল বিষয়কে সমন্বিত করে নিরাময়অযোগ্য অসুস্থ মানুষগুলোকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সেবা প্রদান করার বিষয়ে সচেষ্ট থাকতে আগ্রহী। এখানে একটি বিষয় ভেবে দেখা প্রয়োজন যে, সমাজ যেভাবে নতুন জন্ম নেয়া শিশুটির যতœকে অগ্রাধিকার দেয়, ঠিক তেমনি যারা কঠিন নিরাময় হওয়ার নয় এমন অসুখে আক্রান্ত তাদের যতœ নেয়ার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেয়া দরকার। সমাজের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়, চিকিৎসা বিদ্যার জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োগে এটি কঠিন কোন কাজ নয়। প্রয়োজন সকলের ঐকান্তিক সহযোগিতা এবং মানসিকতার পরিবর্তন।
একজন মানুষ যখন এমন রোগে আক্রান্ত- যা আর কখনও ভাল হবার নয়, জীবনকাল সীমিত হয়ে আসছে। সেইসব রোগীর চিকিৎসা এবং সেবার ধারনাটি বর্তমান পৃথিবীতে ‘প্যালিয়াটিভ কেয়ার’ নামে পরিচিত। ধারণাটি নতুন নয়। বহুবছর ধরে কিছু কিছু মানুষ একা অথবা একত্রিত হয়ে নিরাময়-অযোগ্য, মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে সেবা শুশ্র“ষা দেয়ার চেষ্টা করছে। তখন এই প্রচেষ্টার পেছনে থাকতো প্রধানত: মমতা, আবেগ এবং মানুষের জন্য ভালবাসা। আজকাল চিকিৎসা বিজ্ঞান সেই বিষয়টিকেই জ্ঞান ও গবেষণার অন্তর্ভূক্ত করে একটি নতুন আঙ্গিকে একে দাঁড় করানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিষয়টিকে আরো একটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে। কর্ঠিন নিরাময়-অযোগ্য রোগে আক্রান্ত মানুষ এবং তার পরিবার এক নিদারুণ কষ্টকর, হতাশাব্যাঞ্জক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে পরে। নানা ধরনের শারীরিক উপসর্গ, মানসিক সঙ্কট, সামাজিক সমস্যা এবং সর্বোপরি আধ্যাত্মিক অসহায়তা রোগী এবং পরিবারের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। অথচ বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সাধারণত প্রতিরোধ আর অরোগ্যকেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অসুখ-বিসুখ, রোগ-বালাই যেন কখনও না হয়, আর হলেও যেন ভাল হয়ে যায়, লক্ষ্যটা প্রায় সবারই সেদিকে। স্বাস্থ্য কর্মীরাও সাধারনত রোগ ও র্তা প্রতিকারের প্রতি বেশী মনোযোগ দিয়ে থাকে। গত ১শ বছরে চিকিৎসা বিজ্ঞান এই দুই ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্যও অর্জন করেছে। কিন্তু এওতো সত্যি কথা তারপরেও অনেক রোগ আছে-যা ভাল হয় না। তাদের জন্য প্রান্তিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করাই প্যালিয়েটিভ কেয়ার-এর কর্মপরিধি।
বাংলাদেশে ক্যানসার রোগীর কোন নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই। ধারণা করা হয় যে, দেশে প্রায় ১০ লাখ ক্যান্সার রোগী বাস করেন এবং প্রতিবছর ২ থেকে ৩ লাখ নতুন রোগী ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণের অভিমত এই যে, এইসব রোগীর শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভ্গা নিরাময়-অযোগ্য অবস্থায় চিকিৎসকের কাছে আসেন। এইসব রোগীর জন্য আমাদের দেশে কোন সংগঠিত চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থা নেই। অত্যন্ত অল্প ব্যয়ে সীমিত প্রশিক্ষণে পৃথীবির বেশ কটি দেশ তাদের নিরাময়অযোগ্য রোগে আক্রান্ত রোগীর জন্য একটি জাতীয় উপসর্গ প্রশমণ চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থা এবং ব্যথামুক্ত অন্তিম সময় নিশ্চিত করতে পেরেছে। দক্ষিণ ভারত, স্পেন, উগান্ডা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সমাজের সকলে মিলে ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’ নামে এক নতুন মাত্রার সংযোজন করেছে।
বিএসএমএমইউ (পিজি হাসপাতাল)’র সেন্টার ফর প্যালিয়েটিভ কেয়ার ২০১১ সালে যাত্রা শুরুর দিন থেকেই নিয়মিতভাবে নিরাময় অযোগ্য রোগীর চিকিৎসা ও সেবা দিয়ে আসছে। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ সেবা ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিয়ে সব সদস্য রাষ্ট্রকে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে এটি অন্তর্ভুক্ত করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূল ধারায় সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দিয়েছে।
কর্মশালায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেছেন, উপশমসেবা প্রয়োজন-দেশে এমন নিরাময়-অযোগ্য রোগীর সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ। সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানে মাত্র দুই হাজার রোগীর সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। এ পরিস্থিতি কাটাতে দক্ষ জনবলের পাশাপাশি জনসচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি হয়ে পড়েছে।