৩ মে রোববার শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধের জন্মদিন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ সালে বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এই দিনেই তিনি বোধি (জ্ঞান) লাভ করেন আবার এ দিনেই তার মহাপরিনির্বাণ (জীবনাবসান) হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা যথাযথ মর্যাদার সাথে এ দিনটি পালন করে।
বৌদ্ধ ধর্ম বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্মসমূহের অন্যতম। সিদ্ধার্থ গৌতম এর প্রবর্তক। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে তাঁর শিক্ষা ও উপদেশকে কেন্দ্র করে এ ধর্মের উদ্ভব ঘটে। তাঁর পিতা শুদ্ধোদন ছিলেন বর্তমান নেপালের সীমান্তবর্তী রাজ্য কপিলাবস্ত্তর রাজা। মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে সিদ্ধার্থ জীবনে দুঃখের কারণ এবং তা থেকে মুক্তির উপায় অনুসন্ধানের জন্য সব রকম রাজকীয় মহিমা ও সুখভোগ পরিত্যাগপূর্বক কঠোর সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। অবশেষে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে গয়ার নিরঞ্জনা নদীর তীরে একটি বৃক্ষের নিচে বসে তিনি সেই বোধি বা বিশেষ জ্ঞান (সম্মা সম্বোধি) অর্জন করেন। এ ঘটনার পর থেকেই লোকে তাঁকে সম্মানসূচক ‘বুদ্ধ’ নামে আখ্যায়িত করে এবং উক্ত বৃক্ষটি পরিচিত হয় ‘বোধিবৃক্ষ’ নামে। তিনি শাক্যমুনি (শাক্যবংশীয় ঋষি), তথাগত (সম্বুদ্ধ) এবং বোধিসত্ত্ব (বুদ্ধত্বলাভে আগ্রহী) নামেও আখ্যাত হন।
কথিত আছে দুঃখের কারণ সম্বন্ধে জানতে সিদ্ধার্থ যাত্রা অব্যাহত রাখেন। প্রথমে তিনি আলারা নামক একজন সন্ন্যাসীর কাছে যান। তাঁর উত্তরে সন্তুষ্ট হতে না পেরে তিনি যান উদ্দক নামক আর একজনের কাছে। কিন্তু এখানেও কোনও ফল পেলেন না। এভাবে কিছু দিন যাবার পর তিনি মগধের উরুবিল্ব নামক স্থানে গমন করেন। সেখানে প্রথমে একটি উত্তর-পূর্বমুখি শিলাখণ্ডের উপর বোধিসত্ত্ব জানু পেতে বসে আপন মনেই বলেছিলেন যে, "যদি আমাকে বুদ্ধত্বলাভ করতে হয় তা হলে বুদ্ধের একটি প্রতিচ্ছায়া আমার সম্মুখে দৃশ্যমান হোক।" এই কথা উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে শিলাখণ্ডের গায়ে তিন ফিট উঁচু একটি বুদ্ধের প্রতিচ্ছায়া প্রতিফলিত হল। বোধিসত্ত্ব তপস্যায় বসার পূর্বে দৈববাণী হয় যে, "বুদ্ধত্ব লাভ করতে গেলে এখানে বসলে চলবে না; এখান থেকে অর্ধযোজন দূরে পত্রবৃক্ষতলে তপস্যায় বসতে হবে।" এরপর দেবগণ বোধিসত্ত্বকে সঙ্গে করে এগিয়ে নিয়ে যান। মধ্যপথে একজন দেবতা ভূমি থেকে একগাছা কুশ ছিঁড়ে নিয়ে বোধিসত্ত্বকে দিয়ে বলেন যে, এই কুশই সফলতার নিদর্শন স্বরূপ। বোধিসত্ত্ব কুশগ্রহণের পর প্রায় পাঁচ শত হাত অগ্রসর হন এবং পত্রবৃক্ষতলে ভূমিতে কুশগাছটি রেখে পূর্বমুখি হয়ে তপস্যায় বসেন। কঠোর সাধনার ফলে তাঁর শরীর ক্ষয়ে যায়। কিন্তু এ তপস্যায় তিনি ভয়, লোভ ও লালসাকে অতিক্রম করে নিজের মনের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করতে সক্ষম হলেন। সহসা তিনি বুঝতে পারলেন এভাবে বোধিলাভ হবে না। তিনি তাই আবার খাদ্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন। সুজাতা নাম্নী এক নারীর কাছ থেকে তিনি এক পাত্র পরমান্ন আহার করলেন। অতঃপর তিনি নদীতে স্নান করে পুনরায় ধ্যানরত হন। অবশেষে কঠোর তপস্যার পর তিনি বুদ্ধত্বপ্রাপ্ত হলেন। শাক্যমুনি বোধিলাভের পর সাতদিন ধরে বোধিবৃক্ষের দিকে তাকিয়ে থেকে বিমুক্তিলাভের আনন্দ উপভোগ করেন। তিনি দুঃখ, দুঃখের কারণ, প্রতিকার প্রভৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করলেন। এ ঘটনাটিই বোধিলাভ নামে পরিচিত।
পৃথিবীতে বৌদ্ধধর্ম এক বিচিত্র ভাবধারায় প্রতিষ্ঠিত। তারা মৃত্যুতে বিশ্বাস করে না । তিব্বতে কোন বৌদ্ধের মৃত্যু হলে সে লাশটি তারা কবরও দেয়না বা দাহও করে না। প্রথমে লাশটি কয়েক টুকরা করা হয়। পরে সেটি ওদের পাহাড়ের পাদদেশে ছড়িয়ে দেয়া হয় শকুনের খাদ্য হিসেবে। আর লাশ খন্ড করার সময়ে মৃতদেহের কোন একান্ত আত্মীয় অনুমতিসাপেক্ষে উপস্থিত থাকতে পারেন। এরকম আরো অনেক বিচিত্র উপাখ্যান আছে তাদের ধর্মে।
বুদ্ধ কোনো ঈশ্বর ছিলেন না বা কোনো নবী বা ঈশ্বরের অবতারও ছিলেন না। রাজকুমার হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ এবং নিজের চেষ্টায় তিনি জীবনের চরম সত্যকে জেনেছিলেন। বুদ্ধ মানব জাতির কোনো ত্রাণকর্তা ছিলেন না। তিনি বরং তাঁর অনুগামীদের স্বনির্ভর হতে এবং নিজেদের মুক্তির জন্য অধ্যবসায়ের সঙ্গে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাঁর বক্তব্যই ছিল নিজেকে চেষ্টা করতে হবে।
রসায়ন বিজ্ঞানে একটি সূত্র আছে Law of indestructible of matter অর্থাৎ কোন বস্তুর বিনাশ নেই, আছে শুধু রূপান্তর। তেমনি বৌদ্ধধর্মেও কোন বস্তু বা আত্মার বিনাশ নেই-এটি রূপান্তরিত হয় মাত্র। এই ধর্মমতে জীবনের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে সকল বন্ধন থেকে মুক্তি। এটাকে নির্বাণ বলা হয়। আক্ষরিক অর্থে নির্বাণ শব্দটির অর্থ নিভে যাওয়া। তা হলে নির্বাণ কি জীবন বিমুখ কোন দর্শন? সক্রিয় সামাজিক জীবন ত্যাগ করে সন্যাস গ্রহণ করা? সন্যাসই যদি মোক্ষ হয় তা হলে পার্থিব জীবনের অর্থ কি? ভোগবাদ বনাম ভাববাদ- এর মূল দ্বন্দ্বটি কোথায়?
উপমহাদেশের অন্যান্য ধর্ম যেমন জৈন বা হিন্দু ধর্ম সম্পর্কেও আমার জানার আগ্রহ আছে। বৌদ্ধ ধর্মটি এ অঞ্চল হতে উদ্ভুত। নেপালের লুম্বিনী যেখানে গৌতম বুদ্ধ জন্ম গ্রহণ করেছিলেন কিংবা বিহারের গয়া, যেখানে তিনি বোধিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, জায়গাগুলো বা তার বাতাবরণ অনেকটা আমাদের দেশের মতোই। এই অঞ্চলের জীবন যাপন পদ্ধতি বা মেজাজ, জন্ম সূত্রেই আমাদের পক্ষে বোঝা সহজ।
হিন্দু ধর্মে জীবনের প্রধান চারটি অধ্যায় হচ্ছে, ব্রহ্মাচার্য (ছাত্র জীবন), গার্হস্থ্য (সংসার), বানপ্রস্থ ও সন্যাস। ব্রহ্মাচার্য, গার্হস্থ্য সহজেই বোধগম্য। বানপ্রস্থ হচ্ছে সংসারের বিষয় আশয় থেকে মুঠো আলগা করা। অনেক তো কাম-কামাই হলো, এবার কি পেলাম বা কি পেলাম না, সে হিসেব থেকে একটু দূরে সরা। যা আঁকড়ে ধরে আছি তার বাধন হালকা করে, দান-খয়রাতের মাধ্যমে কিছুটা বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। আর জীবনের শেষ অধ্যায়, সন্যাস হচ্ছে হাত সম্পূর্ণ খালি করা। সংসার ত্যাগ করে, কোন আশ্রমে গিয়ে ধ্যান বা প্রার্থনা করা।
ইসলাম ধর্ম সন্যাস সমর্থন করে না। ধর্মগ্রন্থ কোরান সমাজের মাঝে থেকেই, আমৃত্যু জীবন যাপন করার বিধান দেয়। দান-খয়রাত করার বিধান আছে, তবে জীবনের শেষ বয়সে আয় উপার্জন থেকে দূরে সরে যেতে হবে সে কথা বলে না। অর্থাৎ সংসারের মাঝে থেকেই বানপ্রস্থ চর্চা করতে হবে, সংসার ত্যাগ করা যাবে না। প্রয়োজনের অধিক সম্পদ আহরণ করা যাবে, প্রয়োজন হলে একাধিক বার বিয়েও করা যাবে। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী, পার্থিব অর্জনে নিষেধ নেই, নেই বয়সের কোন সীমাবদ্ধতা।
হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের এই জীবন বিরাগী ও জীবনমুখী দর্শন জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে একটু ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে দেখা যেতে পারে। জীবন যাপনের ক্ষেত্রে মানুষের স্নায়ুতন্ত্রে দুটি বিপরীত সিস্টেম রয়েছে। একটি হচ্ছে সিমপ্যাথেটিক সিস্টেম অপরটি প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেম। সিমপ্যাথেটিক সিস্টেম সক্রিয় হলে মানুষ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে আর প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেম সক্রিয় হলে মানুষ হয়ে ওঠে রক্ষণাত্মক, পলায়নপর। এজন্য এ দুই সিস্টেম এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে ‘ফাইট অথবা ফ্লাইট (fight or flight)’ রেসপন্স বলা হয়। মানুষ কখন ফাইট করবে বা আক্রমণ করবে, আর কখন ফ্লাই করবে বা পালাবে, তা অনেকটা নির্ভর করে পরিবেশ পরিস্থিতির উপর। পরিবেশের প্রভাব একটি গোষ্ঠী বা সমাজকে তূলনামূলকভাবে অধিক আক্রমণাত্মক বা অধিক পলায়নপর করে তুলতে পারে।
বৌদ্ধ ধর্মের অনেক ধারণাই হিন্দু ধর্ম থেকে আসার কারণে মূল সুর রক্ষণাত্মক। তবে বৌদ্ধ ধর্ম সংঘবদ্ধ জীবনের কথা বলে। গৌতম বুদ্ধ বলেছেন জীবন যাতনাময়। জীবন যুদ্ধে জিতে কিংবা জীবন থেকে পালিয়ে, কোনভাবেই জীবনজ্বালা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়। বরং জগতের মায়াজালে জড়িয়ে না পড়াই শ্রেয়, কারণ তা দুঃখ ভোগের কারণ হবে। মুক্তি খুঁজতে হবে জাগতিক বাসনা নির্বাপনের মধ্য দিয়ে। আর সেই মুক্তির সর্বোচ্চ সোপান হচ্ছে নির্বাণ।