১০ মে মা দিবস। মা’কে ভালোবাসতে দিন লাগে না তবুও একটা দিন একটু বেশি করে মাকে ভালোবাসার ধারণাটা খারাপ না। জন্মদাত্রী হিসেবে সকলের জীবনে মায়ের স্থান সবার ওপরে। তাই তাঁকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জানানোর জন্য একটি বিশেষ দিনের হয়ত কোনো প্রয়োজন নেই। তারপরও আধুনিক বিশ্বে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারটিকে ‘মা দিবস' হিসেবে পালন করা হচ্ছে, যার সূত্রপাত ১৯১৪ সালের ৮ মে থেকে। সঙ্গে উপহার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সাদা কার্নেশন ফুল। সমীক্ষা বলছে, বছরের আর পাঁচটা দিনের তুলনায় এদিন অনেক বেশি মানুষ নিজের মাকে ফোন করেন, তাঁর জন্য ফুল কেনেন, উপহার দেন। আসলে মায়েদের কি আলাদা করে কোনো উপহারের প্রয়োজন পড়ে? তাঁরা যে সন্তানের মুখে শুধুমাত্র ‘মা' ডাক শুনতে পেলেই জীবনের পরম উপহারটি পেয়ে যান।
আনা জার্ভিস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর ও ওহাইও’র মাঝামাঝি ওয়েবস্টার জংশন এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর মা অ্যান মেরি রিভস জার্ভিস সারা জীবন ব্যয় করেন অনাথ-আতুরের সেবায়। মেরি ১৯০৫ সালে মারা যান। লোকচক্ষুর অগোচরে কাজ করা মেরিকে সম্মান দিতে চাইলেন মেয়ে আনা জার্ভিস। অ্যান মেরি রিভস জার্ভিসের মতো দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সব মাকে স্বীকৃতি দিতে আনা জার্ভিস প্রচার শুরু করেন। সাত বছরের চেষ্টায় মা দিবস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়।
প্রথম মা দিবস উদযাপন শুরু হয় গ্রিসে। গ্রিকরা তাদের মাতা-দেবি ‘রেয়া’র নামে পূজা করত। ১৯১৩ সালে অ্যামেরিকান কংগ্রেস মা দিবসকে সরকারিভাবে পালনের অনুমতি দেয়। তারপর থেকেই বিভিন্ন দেশে মা দিবস উদযাপন শুরু হয়।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে এই দিনটির সূত্রপাত প্রাচীন গ্রীসের মাতৃ আরাধনার প্রথা থেকে যেখানে গ্রিক দেবতাদের মধ্যে এক বিশিষ্ট দেবী সিবেল-এর উদ্দেশ্যে পালন করা হত একটি উৎসব। এশিয়া মাইনরে মহাবিষ্ণু’র সময়ে এবং তারপর রোমে আইডিস অফ মার্চ (১৫ মার্চ) থেকে ১৮ মার্চের মধ্যে এই উৎসবটি পালিত হত। প্রাচীন রোমানদের ম্যাত্রোনালিয়া নামে দেবী জুনোর প্রতি উৎসর্গিত আরো একটি ছুটির দিন ছিল, যদিও সেদিন মায়েদের উপহার দেওয়া হত।
মাদারিং সানডের মতো ইউরোপ এবং যুক্তরাজ্যে দীর্ঘকাল ধরে বহু আচারানুষ্ঠান ছিল যেখানে মায়েদের এবং মাতৃত্বকে সম্মান জানানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট রবিবারকে আলাদা করে রাখা হত। মাদারিং সানডের অনুষ্ঠান খ্রিস্টানদের অ্যাংগ্লিকানসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পঞ্জিকার অঙ্গ। ক্যাথলিক পঞ্জিকা অনুযায়ী এটিকে বলা হয় লেতারে সানডে যা লেন্টের সময়ে চতুর্থ রবিবারে পালন করা হয় ভার্জিন মেরি বা কুমারী মাতার ও ‘প্রধান গির্জার’ সম্মানে। প্রথানুযায়ী দিনটিকে সূচিত করা হত প্রতিকী উপহার দেওয়া এবং কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রান্না আর ধোয়া-পোছার মত মেয়েদের কাজগুলো বাড়ির অন্য কেউ করার মাধ্যমে।
ইসলাম ধর্মেও বলা আছে মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। উপনিষদে আছে, ‘মাতৃ দেব ভব’। অর্থাৎ মা দেবী স্বরূপিনী, জীবন্ত ঈশ্বরী। তাছাড়া হিন্দুধর্মে মহাশক্তি, আদিশক্তি, রক্ষাকর্ত্রীর ভূমিকায় যাঁদের পাওয়া যায়, তাঁদের কিন্তু মাতৃরূপেই দেখা যায়। এ জন্য কুসন্তান বলা হলেও, কুমাতা কখনও বলা হয় না। খ্রিষ্টধর্মেও রয়েছে ‘মাদার মেরির’ বিশেষ তাৎপর্য। সেই মায়ের জন্য কিনা বছরে একটা মাত্র দিন!
কোনো মা, তা তিনি যে পেশাতেই থাকুন না কেন, যত কুৎসিতই হন না কেন, সন্তানের কাছে তিনি কিন্তু দেবীর মতোই। তবে এ রীতিকে বোধহয় একেবারে তাচ্ছিল্য করা ঠিক নয়। অন্তত একটা দিন তো মায়ের কথা, তাঁর সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার কথা ভাবেন বিশ্ববাসী।
বিদেশে সমাজব্যবস্থা ভিন্ন, রীতি-নীতিও আলাদা। সামাজিক নিরাপত্তাও পাশ্চাত্য দেশগুলিতে অনেক বেশি। এমনকি জার্মানিতেও বৃদ্ধ বাবা-মা বৃদ্ধাশ্রমে যাবেন, অথবা তাঁদের নিজেদের খরচ নিজেরাই বহন করবেন – এটাই স্বাভাবিক। কর্ম-জীবনের উপার্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, এ জন্য সরকারি ভাতাও পেয়ে থাকেন তাঁরা। কিন্তু, আমাদের দেশে? আমরা তো দেশকেও ‘মা' বলে ডাকি। দেশের মাটিকে মা জ্ঞান করে তাঁর পায়ে মাথা ঠেকাই আমরা। বড় গলায় গর্ব করি দেশমাতৃকার জন্য।
কিন্তু নিজের মায়ের বেলায়? বেঁচে থাকতে কতদিন, কতবার তাঁকে আদর করেছি আমরা? কতবার বলেছি ‘মা, তোমায় ভালোবাসি'? জীবনচক্রের ঘূর্ণন শুরু হয় সেই জন্মলগ্ন থেকে। এরপর ছোটবেলা কাটিয়ে উঠে কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য, আর সবশেষে অনিবার্য মৃত্যু। এই ধ্র“ব সত্য শুধু আপনার-আমার নয়, সবার জন্য। তাই দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দিন। যতদিন ‘মা' বেঁচে আছেন, ততদিন, প্রতিটি দিন পালন করুন ‘মা দিবস' হিসেবে।
শীর্ষেন্দুর পার্থিব উপন্যাসে মা কে নিয়ে একটা লেখা পড়েছিলাম -মানুষ যখন ভয় পায়, যখন বিপদে পড়ে, যখন মনে হয় একা, তখন ভয়ার্ত শিশুর মত মা'কেই আঁকড়ে ধরে। ‘আসলেই মা’র প্রতি অনুভূতিই এমন। পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিং বলেছেন, মাতৃত্বেই সকল মায়া-মমতা ও ভালোবাসার শুরু এবং শেষ। কথিত আছে, ব্রিটেনেই প্রথম শুরু হয় মা দিবস পালনের রেওয়াজ।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, অন্য বিশেষ দিনগুলোর চেয়ে এ দিনটিতে সবচেয়ে বেশি ফোন কল হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ভিআইপি কমিউনিকেশন এর জরিপে দেখা গেছে, এ দিনটিতে নববর্ষের চেয়ে ৮ শতাংশ, ভালোবাসা দিবসের চেয়ে ১১ শতাংশ এবং হ্যালোয়েনের চেয়ে ৬২ শতাংশ বেশি ফোন কল হয়। ভিআইপি কমিউনিকেশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট পিটার রজার্স বলেন, আমরা ভিআইপি কমিউনিকেশনের ৫০ হাজারেরও বেশি গ্রাহকের ফোন কল বিশ্লেষণ করে দেখেছি মা দিবসে মায়েদের কাছে সবচেয়ে বেশি কল যায়। তিনি আরও বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নববর্ষ বা ভালোবাসা দিবসের চেয়ে মা দিবসে ফোন কল বেশি হয়। দক্ষিণ আফ্রিকানরা মা দিবসে ফোন করে সবচেয়ে বেশি। তাদের ফোন কলের হার বেড়ে ৯১ শতাংশ হয়েছে। যা অন্য বিশেষ দিনগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। এছাড়াও তারা অন্যদের চেয়ে এ দিনটিতে ফোনে বেশি সময় ব্যয় করে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঘানার অধিবাসীরা। বিশ্বে মাত্র দুটি দেশ মিসর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় মা দিবসে ফোন কলের সংখ্যা কমছে।