somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাজমহল থেকে পলাশী: দু’টি ঐতিহাসিক ভুল

২৪ শে জুন, ২০১৩ রাত ২:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঐতিহাসিক ২৩ জুন। পলাশী ট্রাজেডির ২৫৫তম বার্ষিকী। বলা হয়ে থাকে এই দিনে বাংলার আকাশ থেকে দীর্ঘ দুইশ বছরের জন্য স্বাধীনতার সূর্য্য অস্তমিত হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর আগে অর্থাৎ ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার শেষ স্বাধীন শাসকের পতন হয়। তাই বাংলা তথা এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা হারানোর ঘটনা ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। অত্র অঞ্চলে মোসলেম শাসনের ক্ষেত্রেও এই ইতিহাসের বিশেষ ভুমিকা রোয়েছে। কিভাবে কালক্রমে পলাশীর প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছিল তা অনুধাবন কোরতে হোলে আমাদেরকে মোসলেম জাতির পতনের দিকটি অত্যন্ত গভীরভাবে বিশ্লেষণ কোরতে হবে। কারণ, এই পরাজয়ের পেছনে রোয়েছে এক ঐশী সাবধানবাণীর লঙ্ঘণ এবং অবধারিত ফলাফলের বাস্তবায়ন। বলা আবশ্যক- আল্লাহর ঘোষণা মোতাবেক মোসলেম জাতি কখনো পরাজিত হোতে পারে না। কারণ তিনি পবিত্র কোর’আনে মোমেনদেরকে দুনিয়ার কর্তৃত্ব ও শাসনক্ষমতা দেওয়ার অঙ্গীকার কোরেছেন (সূরা নূর ৫৫) তিনি বোলেছেন, মো’মেনদের সঙ্গে যুদ্ধে কাফেররা কখনও বিজয়ী হবে না (সূরা ফাতাহ ২৩), মো’মেনরাই সর্বদা বিজয়ী হবে (সূরা এমরান ১৩৯), আল্লাহ নিজে মোমেনদের পক্ষে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন (সূরা আনফাল ১৭), তিনি স্বয়ং মোমেনদের অভিভাবক (বাকারা ১৫২), মোমেনদেরকে সাহায্য করা তাঁর কর্তব্য (সূরা রূম ৪৭) তার মানে পলাশির যুদ্ধে ‘মোসলেম’ বাহিনীর পরাজিত হওয়ার অর্থ হোল তখন আর এই জাতি প্রকৃত মোমেন ছিল না। এ ব্যাপারে রসুলাল্লাহর ভবিষ্যতবাণী ছিলো এই যে তিনি বোলেছেন, “আমার উম্মাহর আয়ু ৬০/৭০ বছর।” অর্থাৎ রসুলাল্লাহর (সঃ) এন্তেকালের পর এই জাতি জাতি হিসেবে ৬০/৭০ বছর পর্যন্ত তার আরদ্ধ কাজ চালিয়ে যাবে। কি কাজ? এই প্রশ্নের জবাবে এখানে কিছু কথা না বোললেই নয়। তাঁর কাজ সম্বন্ধে জানতে হলে আমাদেরকে জানতে হবে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে কি দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন।
রসুলাল্লাহর উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব ছিল সমস্ত বাতিল দ্বীন বা জীবনব্যবস্থাগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে দীনুল এসলামকে সমস্ত পৃথিবীর ওপর প্রতিষ্ঠা করা (সুরা ফাতাহঃ ২৮, সুরা সফঃ৯, সুরা তওবাঃ৩৩)। সমস্ত পৃথিবীতে এসলামকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আল্লাহর শেষ রসুল (সঃ) একটি জাতি বা উম্মাহ গঠন করলেন যারা প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী নামে পরিচিত ছিলেন। রসুল (সঃ) এর জাতিকে একটি জাতি না বলে সামরিক বাহিনী বলাটাই যথার্থ হয়। উম্মতে মোহাম্মদীর সঠিক আকিদার মধ্যে যে জাতীয় চরিত্র আল্লাহর রসুল (সঃ) গেঁথে দিয়েছিলেন তা হচ্ছে ওয়ার্ল্ড ওরিয়েন্টেড বা দুনিয়া অভিমূখী। রসুলাল্লাহ (সঃ) এর এন্তেকালের পর তাঁর হাতে গড়া চরম দরিদ্র, অনাহারে, অর্ধাহারে যার থাকতো, সেই উম্মতে মোহাম্মদী একটা একটা করে নয়, একসাথে সামরিকভাবে আক্রমণ করে তদানীন্তন দুই বিশ্বশক্তি একদিকে অগ্নি-উপাসক পারস্য ও অন্যদিকে খ্রিস্টান রোমান সাম্রাজ্যকে পরাজিত ও ছিন্ন ভিন্ন করে অর্ধ-পৃথিবীতে এক নতুন আদর্শ, নতুন সভ্যতার জন্ম দিলেন অর্থাৎ, আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্ধ-পৃথিবীর শাসক এবং সর্বদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হয়ে গেলেন। এভাবে সঠিক আকিদা নিয়ে উম্মতে মোহাম্মদী জাতি হিসেবে মোটামোটি প্রায় ১০০ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে মানবজাতিকে শান্তি দেয়ার জন্য সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যদ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে গেলেন। কিন্তু এরপর ঘোটল এক সাংঘাতিক ঘটনা। জাতির আকিদার মধ্যে ভিন্নতা প্রবেশ কোরল। ৬০/৭০ বছর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে এ জাতির উমাইয়া, আব্বাসীয়া, ফাতেমীয়, এবং উসমানীয় খলিফা নামধারী শাসকেরা পৃথিবীর অন্যান্য রাজা-বাদশাহদের মত বাদশাহী উপভোগ করা শুরু কোরল। উম্মতে মোহাম্মদী বিশ্বশক্তির অন্যতম পারস্য শক্তি পরাজয়ের পর যেটাকে আমরা ইরান বলি, সেই ইরানী জাতিটি এসলাম গ্রহণ করে মোসলেম হয়ে গিয়েছিলো। তারপর মোসলেম জাতি যখন ভারতে প্রবেশ করে, এখানেও তারা বাদশাহী উপভোগ আরম্ভ করলো। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে মোসলেম শাসকেরা বাংলায় রাজতন্ত্র চালাতে থাকেন।
এই সময়ে, অর্থাৎ খ্রিস্টীয় আঠারো শতকের প্রথম দিকে এই উপমহাদেশের দুর্বল মোঘল সম্রাট এবং বাংলার শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মুঘলদের নিযুক্ত সুবেদারগণ অর্থাৎ নবাবদের দেশ পরিচালনার ব্যর্থতা, সীমাহীন দুর্নীতি, ভোগবিলাস এবং বিলাসিতার সুযোগে উপমহাদেশে আসা ইস্ট ই-িয়া কো¤পানী সামরিকভাবে নিজেদের অবস্থান সুসংহত কোরতে শুরু করে। নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর তার প্রিয় দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা চরম প্রতিকূলতার মধ্যে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব হিসেবে মসনদে অধিষ্ঠিত হন। সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনে বসার পর থেকে ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর হয়ে ওঠে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য। ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে ছিলেন ঘষেটি বেগম, রাজা রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ, রাজা কৃষ্ণবল্লভ, মানিক চাঁদ, আমির চাঁদ, আমির বেগ, খাদিম হোসেন, ইয়ার লতিফ খান, ওয়াটস, নবকুমার, এবং প্রধান সেনাপতি মীরজাফর। সেই সময়ে বেশকিছু হিন্দু সরকারী কর্মকর্তা এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু জমিদাররা নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে অপসারণ কোরতে ষড়যন্ত্রকারীদের মদদ দেয়। এক পর্যায়ে ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ই-িয়া কো¤পানি ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে হাত মেলায় এবং মীরজাফরকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব বানাতে কাশিমবাজার কুঠিতে মীরজাফর-ক্লাইভের মধ্যে এক গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই গোপন চুক্তির ধারাবাহিকতায় আসে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন। সেই যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি মীরজাফর, জগৎশেঠ, রাজবল্লভসহ কতিপয় কুচক্রী মহলগুলোর বিশ্বাসঘাতকতার পরিণতি হিসেবে নবাব সিরাজের নেতৃত্বাধীন ৫৭ হাজার বাহিনী ক্লাইভের ৩ হাজার বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ইংরেজদের হাতে। ১৭৫৭ সালের ২ জুলাই বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে জাফরগঞ্জের এক কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় মোহাম্মদী বেগ তার নাঙা তলোয়ার দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে সিরাজের দেহ ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। রক্তস্রোতের উপর লুটিয়ে পড়েন বাংলার শেষ মোসলেম শাসক নবাব সিরাজউদ্দৌলা। মীরজাফর পুতুল নবাব হন। পলাশীর বিপর্যয়ের ধারাবাহিকতায় কালক্রমে ইউরোপের খ্রিস্টানরা সামরিক শক্তি বলে এই পাক ভারত উপমহাদেশসহ সমস্ত মোসলেম ভূখ- পদানত করে।
এখানে ইতিহাসে একটি ভুল করা হয়। তা এই যে, বলা হোয়ে থাকে ২৩শে জুন ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ই-িয়া কোম্পানীর সাথে সংঘঠিত লড়াইয়ে পলাশির আম্রকাননে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শাসক নবাব সিরাজুদ্দৌলাহর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সর্বপ্রথম বাংলার স্বাধীনতার সূর্য্য অস্তমিত হয়। প্রকৃতপক্ষে এই বিষয়টি সঠিক নয়। কারণ, এই নবাব বংশীয় শাসকগণ প্রথমত কখনোই এই এলাকার স্বাধীন শাসক ছিলেন না। তারা ছিলেন দিল্লীর মুঘল সম্রাটদের নায়েব, অর্থাৎ প্রতিনিধি। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক জনাব হায়দার আলী চৌধুরী রচিত ‘পলাশি যুদ্ধোত্তর আযাদী সংগ্রামের পাদপীঠ’ নামক ইতিহাস গ্রন্থে তিনি উল্লেখ কোরেছেন যে, “স্বাধীন নবাব বোলে যে কথাটি প্রচলিত তা ঐতিহাসিক সত্য নয়! স্বাধীন নবাব কথাটি নাট্যকারদের লেখা। কিন্তু ইতিহাসের সঙ্গে এর কোন মিল নেই। নবাব কোনদিন স্বাধীন হয় না (পৃষ্ঠা: ৭৭)” তার এই কথা অত্যন্ত যৌক্তিক, কারণ নবাব শব্দটি আরবী নায়েবের অন্যতম রূপ। আর নায়েব মানেই শাসকের প্রতিনিধি। সিরাজুদ্দৌলাহ ছিলেন মোগল শাসকদের নিয়োজিত সুবেদার। সুতরাং প্রমাণিত হয় যে বাংলার শাসনে সর্বশেষ স্বাধীন শাসনকর্তা সিরাজউদ্দৌলাহ নন। সিরাজ উদ্দৌলাসহ তার পূর্বসূরী নবাব আলীবর্দী খানসহ সবাই ছিলেন তৎকালীন দিল্লির মসনদে আসীন মুঘল সম্রাটদের অনুগত প্রতিনিধি। প্রকৃতপক্ষে বাংলার স্বাধীন শাসক এবং স্বাধীনতা গত হয় আরো অনেক আগে। অনুসন্ধিৎসু পাঠককে সত্যিকার ইতিহাস জানতে ফিরে যেতে হবে আরো পেছনে।
মুঘল সম্রাট আকবরের সময়ে বাংলার শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন দাউদ খান পন্নী। পন্নী বংশীয় শাসনামলকে অনেক ইতিহাস বইতে কররানী আমল (Karrani Rule) নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। মূলত, আফগানিস্তানের কাররান অঞ্চলের অধিবাসী হওয়ায় তাদেরকে কাররানী বলা হোত, তবে সত্যিকার অর্থে তাদের বংশের নাম ছিল পন্নী। দিল্লির কেন্দ্রীয় সিংহাসনে শক্তিমান শাসক মুঘলগণ আসীন থাকায় সে সময়ে বাংলায় কোন শাসক স্বাধীন ছিলেন না। যারাই শাসন কাজ পরিচালনা কোরতেন, কোরতেন দিল্লীর বাদশাহর অনুগত থেকেই। এরা ইতিহাসে নবাব হিসেবে পরিচিত। এদের প্রায় সবাই আত্মীয়তাসূত্রে দিল্লীর বাদশাহদের সাথে কোন না কোনভাবে সম্পর্কিত ছিলেন।
বাংলা একাডেমী প্রকাশিত গোলাম হোসায়ন সলীম এর ঐতিহাসিক গ্রন্থ রিয়াজুস সালাতিন গ্রন্থে বর্ণিত এই রাজবংশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হোল, ৯৭১ হিজরীতে (১৫৬৩ খ্রিঃ) নিজ ভাইকে হত্যা করে মসনদ দখল কোরে ক্ষমতা লাভ করা অবৈধ শাসক গিয়াস উদ্দিনকে দমন করার জন্য দক্ষিণ বিহারের গভর্ণর সুলায়মান খান পন্নী তাঁর জেষ্ঠ্য ভ্রাতা তাজ খান পন্নীকে গৌড়ে প্রেরণ করেন। গিয়াস উদ্দিনকে হত্যা কোরে তাজ খান পন্নী তার ভ্রাতা সুলায়মান পন্নীর পক্ষে বাংলার গভর্ণররূপে ৯৭১ থেকে ৯৭২ হিজরী (১৫৬৪-৬৫খ্রিঃ) পর্যন্ত শাসন কার্য পরিচালনা করেন। ৯৭২ হিজরীতে তার মৃত্যু হয়। তাজখানের মৃত্যুর পর সুলেমান খান নিজেকে বাংলা ও বিহারের সম্পূর্ণ স্বাধীন সুলতানরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। খারাপ আবহাওয়ার জন্য তিনি গৌড় ত্যাগ কোরে টা-া শহরে রাজধানী স্থাপন করেন। ৯৭৫ হিজরীতে তিনি উড়িষ্যা জয় করেন এবং তথায় একজন গভর্ণরের অধীনে স্থায়ীভাবে এক বৃহৎ সৈন্যবাহিনী রেখে কুচবিহার জয়ের জন্য যাত্রা করেন। কুচবিহারের পাশ্ববর্তী অঞ্চলসমূহ অধিকার করার পর তিনি সংবাদ পান যে, উড়িষ্যায় বিদ্রোহীরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রয়োজনবশত: তিনি কুচবিহার শহরের অবরোধ তুলে রাজধানী টা-ায় প্রত্যাবর্তন করেন। সেই সময় এইভাবে কিছুকাল সমগ্র হিন্দুস্থানে গোলমাল আরম্ভ হয়েছিল। বাদশাহ হুমায়ূন যখন পারস্য থেকে হিন্দুস্থানে ফিরে আসেন, তখন সুলেমান খান পন্নী দুরদর্শিতাবশত: (কৌশলে) উপহারসহ আনুগত্য স্বীকার করে মুঘল সম্রাট হুমায়ূনের নিকট এক পত্র প্রেরণ করেন। অপর পক্ষ তখন শের শাহের বংশধর ও সমর্থকদের ধ্বংসকার্যে ব্যস্ত থাকায় উক্ত উপহারসমূহ গৃহীত হয়; এবং উত্তরে সুলেমান খানের নিকট আস্থাসূচক ও সদিচ্ছামূলক পত্রসহ তাঁকে তাঁর পদে বহাল রেখে এক বাদশাহী ফরমান প্রেরিত হয়।
এরপর বাংলা রাজ্যে সুলেমান খান পন্নী নিজের নামে খোৎবা ও মুদ্রা চালু রেখেছিলেন। তিনি নিজেকে হযরতে-আলা (সর্বপ্রধান) রূপে অভিহিত কোরতেন। তবে কৌশলে মাঝে মাঝে মুঘল বাদশাহ আকবরের আনুগত্যের চিহ্নস্বরূপ উপহার প্রেরণ কোরতেন। প্রায় ষোল বছর স্বাধীনভাবে সালতানাত পরিচালনা করার পর ৯৮১ হিজরীতে তার মৃত্যু হয়। সুলেমান খান পন্নীর পর তাঁর পুত্র বায়াজীদ খান পন্নী বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। একমাস অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই, অন্য সূত্রে এক বছর ছয় মাস শাসন করার পর হাঁসো নামক এক আফগানী কূটকৌশল অবলম্বন কোরে বায়াজীদ খান পন্নীকে হত্যা করে। আড়াই দিন পর সুলেমান খান পন্নীর ছোট ভাই দাউদ খান পন্নী হাঁসোকে হত্যা কোরে ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। এরপর তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন। ঐতিহাসিক বিচারে এই দাউদ খান পন্নীই বাংলার ইতিহাসে সর্বশেষ স্বাধীন শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি ক্ষমতার আসনে আসীন হোয়েই বাংলার সমস্ত অঞ্চল বশীভূত কোরে নিজের নামে খোতবা ও মুদ্রা প্রচলন করেন। তার লোক লস্কর ও সৈন্য সংখ্যা ছিলো প্রচুর। ৪০,০০০ সুসজ্জিত অশ্বারোহী সৈন্য, ৩৩০০ হস্তী, ১,৪০,০০০ পদাতিক সৈন্য এবং এর মধ্যে বন্দুকধারী, গোলন্দাজ, তীরন্দাজ প্রভৃতি সকল শ্রেণীর সৈন্যই ছিল। ২০,০০০ আগ্নেয়াস্ত্র- এর অধিকাংশই ছিল প্রাচীর ধ্বংসকারী কামান, বহু সশস্ত্র নৌযান ও যুদ্ধের অন্যান্য সরঞ্জামও মওজুদ ছিলো। এমতাবস্থায় তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সীমান্তে গোলযোগ সৃষ্টি করেন। পরবর্তীতে আকবরের আদেশ অনুযায়ী তাকে দমন করার জন্য ‘খান-ই-খানান’ উপাধিধারী মুনিম খান- দাউদ খান পন্নীর বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠায়। দাউদ খান তার প্রধান আমীর লোদী খান আফগানকে অগ্রগামী কোরে মুঘল সৈন্যদের বিরুদ্ধে পাঠান। পরবর্তীতে সংক্ষেপে বলতে গেলে তিনি একটার পর একটা দীর্ঘ লড়াইয়ের সূচনা কোরেন। সর্বশেষ দাউদ খান পন্নীকে দমন কোরতে বাদশাহ আকবর স্বয়ং নিজে ময়দানে অবতীর্ণ হোতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে দাউদ খান বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে বাহিনী খুইয়ে বাদশাহের সাথে সন্ধিতে আবদ্ধ হোতে বাধ্য হোন। বাংলার মসনদে নবাব হিসেবে আসীন হন ‘খান-ই-খানান’ মুনিম খান। অল্পদিন পর তিনি খারাপ আবহাওয়ার কারণে ৯৮৩ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করলে দাউদ খান পন্নী আবার আফগানদের সহযোগিতায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পুনরায় মুঘল বাদশাহ আকবর হোসেন কুলী খান তুর্কমানকে খানজাহান উপাধি দিয়ে বাংলায় প্রেরণ করেন। বেধে যায় আবার যুদ্ধ। দীর্ঘ এই যুদ্ধে দাউদ খান পন্নী পরাজিত হোয়ে পালিয়ে গেলে সৈন্যরা তাঁকে ধরে খানজাহানের কাছে হাজির করে। দাউদ খানকে গোলমাল ও বিদ্রোহের উৎস গণ্য কোরে খানজাহান (হোসেন কুলী বেগ) তাঁকে হত্যা করলেন। ঐতিহাসিকরা এই হত্যাকা- সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, মুঘল সেনাপতি খানজাহানের বীরধর্মের সম্পূর্ণ অভাব লক্ষ্য না কোরে পারা যায় না। তার অব্যবহিত পূর্বসূরী খান-ই-খানানের এক চতুর্থাংশ বীরধর্মবোধ যদি এর থাকতো, তাহলে তিনি এরূপ হিংস্র ও কাপুরুষোচিত নৃশংসতা কোরতে পারতেন না। দাউদ শাহের মত যোগ্য ও বীর প্রতিদ্বন্দ্বীর এতদপেক্ষা মহৎ ব্যবহার প্রাপ্য ছিলো। খানজাহানের প্রভু মহান আকবর এই প্রকার দুষ্কার্যের প্রতিরোধের ব্যবস্থা আগে থেকে না করায় তার স্মৃতিও কলঙ্কিত হয়।
দাউদ খানের পরাজয় এবং হত্যাকা-ের মধ্য দিয়েই মূলত: বাংলার শাসন ক্ষমতা থেকে ‘স্বাধীন’ শাসকের অবসান ঘটে। সুতরাং ১৭৫৭ সালের ২৩ ই জুন নবাব সিরাজউদ্দৌলা নন, ১৫৭৬ সনের ১২ জুলাই বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান দাউদ খান পন্নীর অবসানের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য্য অস্তমিত হয়। এরপর শুধু পন্নী বংশই নয়, কোন শাসকই আর স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন কোরতে সক্ষম হোন নি। পন্নী রাজবংশের পরাজয়ের পর বারো ভূঁইয়াখ্যাত পন্নীদের অনুগত দৃঢ়চেতা কমা-ার ও জমিদারগণ দিল্লীর কেন্দ্রীয় সরকারকে অস্বীকার করে আঞ্চলিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরে অবশ্য তারাও মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হোন। মুঘলদের অধীনস্ত নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর ধীরে ধীরে শাসন ক্ষমতা ইংরেজদের হাতে চোলে যায়। উল্লেখ্য, সুলতান দাউদ খান কররানী যুদ্ধে পরাজিত হোয়ে খানজাহানের হাতে নিহত হওয়াকে দিল্লীর সম্রাট ভালো চোখে দেখেন নি। তিনি এই বীরের প্রতি যথোচিত সম্মানজনক ব্যবহার না করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। পরে তিনি এর জন্য দায় স্বীকার কোরে এর জন্য অনুতপ্ত হোন এবং পন্নী বংশের পরবর্তী সদস্যদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। বাদশাহের আনুকূল্যে পরবর্তী পন্নীগণ বাংলাসহ অনেক এলাকায় শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এখানে বলা আবশ্যক যে, কররানী বা পন্নী এবং মুঘল-এই দুইটি রাজশক্তিই ছিলো মোসলেম দাবিদার। তারা দুনিয়ার আর সব রাজা বাদশাহদের মত বাদশাহীতে লিপ্ত ছিলেন। মোসলেম দাবিদার এই দুইটি শক্তির লড়াই ছিল সত্যিকার অর্থে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ। তারা সত্যিকার মোমেন এবং উম্মতে মোহাম্মদী না হোলেও তাদের রাজ্য পরিচালনা কোরতেন ¯্রষ্টার দেওয়া আইনেই। কিন্তু অন্যসব বিকৃতির মতই তারাও ভোগ বিলাস ও বাদশাহীতে নিমগ্ন হোয়ে নিজেদের মধ্যে ঐক্য নষ্ট কোরে, সংঘাতে লিপ্ত হোয়ে, দুর্বল হোয়ে পড়ার কারণে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সাবধানবাণী মোতাবেক স্বাধীনতা হারায় এবং ভীনদেশী দুর্বল ও ক্ষূদ্র শক্তিসম্পন্ন বৃটিশদের গোলামে পরিণত হয়। জাতীর কপালে জোটে দীর্ঘ দুশো বছরের বিদেশী শক্তির গোলামী। এই গোলামী খাটার পর আপাতত মুক্তি পেলেও আজও তারা স্বেচ্ছায় ইহুদি খ্রিস্টান বস্তুবাদী সভ্যতাকে প্রভুর আসনে বসিয়ে তাদের আইন-কানুন, অর্থনীতি, দ-বিধি সবকিছু পালন কোরে স্বপ্রণোদিত দাস হোয়ে আছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০১৩ রাত ২:৩৬
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×