somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাঙালি মুসলমানদের দুঃসময়ের চাঞ্চল্যকর ইতিহাস

২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৫:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


চিরস্থায়ী হিসেবে জমিদারির বন্দোবস্ত দেয়ার প্রস্তাব করে ১৭৯৩ সালের ৬ই মার্চ লর্ড কর্ণওয়ালিস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লন্ডনস্থ ডিরেক্টরদের কাছে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন, “বেশ কিছু সংখ্যক নেটিভদের হাতে যে বিপুল পরিমাণে মূলধন রয়েছে তা বিনিয়োগ করার আর কোনও পথ নেই। তাই জমিদারির বন্দোবস্ত নিশ্চিত বা চিরস্থায়ী করা হলে শিগগির উল্লেখিত সঞ্চিত মূলধন জমিদারি ক্রয়ে বিনিয়োগ হবে।”


লর্ড কর্ণওয়ালিস এর চিন্তাধারা ইংরেজদের দৃষ্টিকোন থেকে সময়উপযোগীও সঠিক ছিল। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু করার সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ানী, মুৎসুদ্দিগিরি, বেনিয়ানি এবং ব্যবসার মাধ্যমে কোলকাতার সুবর্ণ বণিক শ্রেণীর হাতে যে বিপুল পরিমাণ মূলধন সঞ্চিত হয়েছিল তা খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে জমিদারি ক্রয়ে বিনিয়োগ হতে শুরু করল। এই নব্য ধনীরা দলে দলে নতুন জমিদার শ্রেণীতে পরিনত হতে লাগলেন।লর্ড কর্নওয়ালিস সে সময় আরও একটা অর্থসহ পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। তিনি জানতেন যে প্রাচীন বনেদী জমিদাররা নির্দিষ্ট দিনক্ষণে রাজকোষে প্রাপ্য টাকা জমা দিতে অভ্যস্ত না, তাই সামান্যতম গাফিলতির দরুন এবং নতুন বন্দোবস্তের কড়া আইনের দরুন সব কঠর নিয়মে প্রচালিত শরু করলেন আর তার কারনে সেসব জমিদারি একে একে নীলামে উঠতে লাগল। আর কোলকাতার নব্য ধনী মুৎসুদ্দি বেনিয়ানরা নীলাম থেকে সেসব জমিদারি কিনে নতুন জমিদার হয়ে গেলেন।

ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার এর বক্তব্য থেকে দেখা যায় যে ১৭৯৬ থেকে ১৭৯৮ সালের মধ্যে ৫৫ লাখ ২১ হাজার ২৫২ টাকার রাজস্বওয়ালা জমিদারি নীলামের জন্য বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। আর সেই টাকা মোট জমির প্রাপ্য খাজনার এক পঞ্চমাংশের মতো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ার পরবর্তী ২২ বছরের মধ্যে বাংলার এক,তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক পরিমান জমিদারি নীলামে বিক্রির মাধ্যমে হস্তান্তর হয়। অর্থাৎ বনেদী জমিদারদের হাত থেকে নব্য ধনীদের নিকট হস্তান্তর করা হয়। উদাহরণস্বরুপ বলা যায় যে, ১৮০০ সালের মধ্যে দিনাজপুর রাজবংশের প্রায় সব সম্পত্তি নিলাম হয়ে যায়। ১৭৯৩ সালেই বাকি খাজনার দায়ে নাটোরের রাজাকে রাজবাড়িতেই বন্দি করা হয়। ১৭৯৫ সালের ২৭শে মার্চ গভর্নর জেনারেল ইন কাউন্সিল এর নিকট দাখিলকৃত সিলেক্ট কমিটির এক রিপোর্ট বলা হয় যে, “বাংলাদেশের বাকি রাজস্বের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই দু’জনের কাছে বাকি : বীরভুম এবং রাজশাহীর জমিদার। সরকারি রাজস্ব থেকে নিজেদের ব্যভিচার এবং বিলাসিতার জন্য প্রচুর অর্থ অপব্যয় করার দরুনই তাদের দেয় রাজস্ব তারা তা দিতে পারেননি এবং তাদেরই বংশদের নির্দেশে জমিদারি থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়।” কিন্তু একথা কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর একেবারে শেষভাগে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের এই নতুন গোত্রাস্তরিত জমিদার গোষ্ঠীর চরিত্র বনেদী জমিদারদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। তাদের চালচলন, আচার ব্যবহার এমনকি পোশাক পরিচ্ছদ পর্যন্ত সব ভিন্ন রকম ছিল। নব্য জমিদাররা তাদের জমিদারিকে এক ধরনের ব্যবসা বলে মনে করতেন। তাই তারা নিজেদের মুনাফা বৃদ্ধির জন্য মধ্য স্বত্বভোগীদের বলগাহীন শোষণের লাইসেন্স প্রদান করল। আর তার ফলেই গ্রাম বাংলায় নতুন শ্রেণী বিণ্যাসের সুচনা হলো।লর্ড কর্ণওয়ালিসের আরও ধারনা ছিল যে কোলকাতার ধনাঢ্য সুবর্ণ শ্রেণীর নব্য জমিদার হিসেবে গোত্রান্তর হলে তাদের জীবনের নতুন প্রেক্ষাপটের সৃষ্টি এবং তারা কর্মক্ষমতা হারিয়ে অতিরিক্ত অর্থ নতুন ধরণের বিলাসিতা এবং মামলা মোকদ্দমায় ব্যয় করবে। কার্যক্ষেত্রে ইংরেজ শাসক গোষ্ঠীর চিন্তা খুবই বাস্তবমুখী বলে প্রমানিত হয়েছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ার পর এবং নব্য জমিদাররা নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যক্তিগত বিলাসিতা, যৌথ সম্পত্তির ভাট বাটোয়ারা সংক্রান্ত মামলা মোকদ্দমা এবং জমিদারিতে উদ্ধৃত প্রজাদের দমনে গুন্ডা এবং লাঠিয়াল বাহিনী ভাড়া করা ইত্যাদি ব্যাপারে কত লাখ লাখ টাকা যে ব্যয় করেছে তার কোনও সঠিক হিসাব পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাছাড়া অন্নপ্রাশন বিবাহ, শ্রাদ্ধ ও নারী, মদ এবং জুয়াখেলায় ব্যয়কৃত অর্থের পরিমানও কেউ বলতেও পারে না।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ায় অল্প কিছু দিনের ব্যবধানে বাংলাদেশে প্রবর্তিত হলো জমির বর্গা প্রথা। এটাকে উত্তরবঙ্গ এলাকায় অধিয়ার প্রথা বলা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকে এই প্রথা চালু হবার প্রাক্কালে বিত্তশালীরা বর্গাপ্রথার সুযোগে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি থেকে এক সঙ্গে বহু জমি কিনে মালিকানা লাভ করল। সে আমলে এ ধরনের জমির মালিকদের লটদার বলা হতো। লট হিসেবে জমি কিনত বলেই তাদের লটদার বলে নাম দেয়া হয়। পরবর্তীকালে তারাই হচ্ছেন গ্রামবাংলার প্রতিক্রিয়াশীল কুলাক অর্থাত রাশিয়ায় জারের আমলে বিত্তশালী কৃষকদের কুলাক মলা বলা হতো, আর তাই লটদার দেরকেও কুলাক সম্প্রদায় এর উপাদি দেয়া হল। এক কথায় গ্রামাঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী বা জোতদার শ্রেণীর মানুষ বা সম্প্রদায় ।এখানে লক্ষনীয় যে ১৯৫৫ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হলেও এই বর্গা প্রথা আজও পর্যন্ত বাংলাদেশে চালু আছে। শুধু মাত্র বর্গা প্রথা কে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত করার লক্ষ্যে ১৯৮৩ সালে তেভাগা সংক্রান্ত কয়েকটি বিধি জারি করা হয়েছে। কিন্তু এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে পরবর্তী প্রায় পৌনে দুইশ বছর পর্যন্ত এই বর্গা প্রথায় চাষের জন্য বাংলার কৃষকরা নির্মমভাবে শোষিত হয়েছে। আলোচ্য সময় শুধুমাত্র জমির মালিকানার বদৌলতে জোতদাররা উৎপন্ন ফসলের অর্ধেকটা লাভ করত। অথচ চাষের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম থেকে শুরু করে কৃষি উপকরণ সবটাই ছিল অধিয়ার কৃষকদের দায়িত্ব।আর এর অন্যথা হলেই যথেচ্ছভাবে জমি থেকে বর্গাচাষিদের উচ্ছেদ করা হতো। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশে জোতদার শ্রেণী গঠনের গোড়ার কথা বা ইতিহাস।

মুসলমান বিত্তশালীরা নিজেদের হাত থেকে ইংরেজদের কাছে শাসনভার চলে যাওয়ার ‘অভিমানে’ এবং একশ্রেণীর মোল্লা মৌলভীদের প্ররোচনায় শাসক গোষ্ঠীর প্রতি কিছুটা অসহযোগীতা প্রদর্শনের জের হিসেবে সযত্নে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখায় হিন্দু বনিক সরকারি কর্মচারী এবং বিত্তশালীরা জমির মধ্যস্বত্ব লাভের সুযোগ পূর্ণভাবে গ্রহণ করেন। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশে নতুন আর এতে শুরু হয় আরেক ধরনের জমিদার শ্রেণীর সৃষ্টি। এটা সৃষ্টির গোড়ার কথা। আর এই জমিদার শ্রেণী সৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সামাজিক পটভূমির ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। আর তারই ফল হিসেবে আমরা দেখতে পাই, যেসব বাঙালি হিন্দু বিত্তশালীরা ভারতের তৎকালিন কোলকাতা নগরীতে ইংরেজদের অনুকরণে ব্যবসা এবং শিল্প স্থাপনের প্রচেষ্টা করছিলেন তাদের অনেকেই আবার জমির উপর প্রলুব্ধ হলেন এবং রাতারাতি জমিদার হিসেবে নিজেদের চিহ্নিত করলেন। এরই জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে দ্বারকানাথ ঠাকুর। কার ঠাকুর কোম্পানি’ এবং রানীগঞ্জ কোলিয়ারীতে মুলধন বিনিয়োগ করে যে দ্বারকানাথ ঠাকুর অর্থাত রবী ঠাকুরের পিতা একসময় বিশিষ্ট শিল্পপতি হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন তিনিই শেষ পর্যন্ত জমিদার পরিনত হলেন।আর সে আমলের সার্বিক সামাজিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলাদেশে প্রায় কয়েক দশক পর্যন্ত ‘অস্থিরতা আর আর অরাজকতার পর ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের নয়া সহযোগী হিসেবে স্থানীয়ভাবে বাঙালি শিক্ষিত হিন্দুদের মাঝ থেকে শহরভিত্তিক যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠতে শুরু করেছিল তা নানা ঘাত প্রতিঘাতের মাঝ দিয়ে জমিদারি এবং জোতদারি প্রথার প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তা পূর্নতাপ্রাপ্ত হলো। অবশ্য সমসাময়িক কালেই বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠা শিক্ষক, আইনজীবী, ডাক্তার এবং চাকুরিজীবী প্রভৃতি পেশায় লিপ্ত ব্যক্তিরা ইতিমধ্যে এই উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল,আর তাদের মধ্যে প্রায় সবই হিন্দু ছিলেন।

''তথসূত্র''+মূল উৎস কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবি পৃষ্ঠা ২৭–২৯
ব্লগার উৎস মূলধারা।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৫:৩০
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×